বহ্নিশিখা by BOURSES_BRAQUE - অধ্যায় ২
প্রথম ভাগ
পরিচ্ছদ ১
নিউ অর্লিন্স
বৃহস্পতিবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি, রাত ১১টা
...কড় কড় কড়াৎ...
একটা প্রচন্ড আলোর ঝলকানি দিয়েই বিভৎস শব্দে কাছেই কোথাও বাজটা পড়ল। অন্য সময় হলে মিসেস হুইটনি তাড়াতাড়ি করে জানলাগুলো বন্ধ করতেন, বৃষ্টির ছাঁটে সব ভিজে যায় যে বড্ডো। কিন্তু আজ সে তাড়া নেই তাঁর মধ্যে। বাইরে যে প্রচন্ডতায় তুফান বইছে, তার থেকেও অনেক, অনেক বেশি জোরে তুফান বইছে তাঁর মনের মধ্যে... তাঁর কানে হয়তো ওই দিকবিদির্ণ করা বাজের শব্দটাই পৌছায় নি। খুব ধীরে ধীরে একটা একটা করে শরীর থেকে পোষাকগুলি খুলে ফেলতে লাগলেন মিসেস হুইটনি, ডোরিস হুইটনি। সমস্ত কটা পোষাক খোলা হয়ে গেলে সেগুলোকে সযন্তে পাট করে খাটের একটা পাশে রেখে দিয়ে হাতে ঘন লাল রঙের নাইটিটা তুলে নিলেন। ঘন লাল... এই রঙের পোশাকে রক্তের রঙ বোঝা যায় কম...
ভালো করে ঘরের মধ্যেটা একবার দেখে নিলেন মিসেস হুইটনি... তিরিশটা বছর... আজ তিরিশটা বছর এই ঘরের মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছেন... ঘরের প্রতিটা আসবাব তার চেনা... অতি পরিচিত... তিল তিল করে শুধু এই ঘরটাকেই শুধু নয়, পুরো বাড়িটাকেই তো সাজিয়ে তুলেছেন নিজের মত করেই... আজও প্রতিদিনকার মতই সেই একই ভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখেছেন ঘরটাকে... এতটুকুও অগোছালো কিছু নেই। যেখানে যেটা থাকার ঠিক সেখানেই সেটা রয়েছে। ‘হু!’ একটা বড় দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের মধ্যে থেকে।
খুব ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে তার ভেতর থেকে পিস্তলটা বের করলেন। পিস্তলের গাটা চকচক করছে ঘরের বৈদ্যুতিক আলোতে। কালো, কৃষ্ণ কালো রঙের পিস্তলটা, গাটা নিটোল পালিশে তেলতেলে, হীম শীতল। পিস্তলটাকে হাতে নিয়ে খানিক দেখে সেটা টেলিফোনের পাশে রাখলেন। রিসিভারটা তুলে নিয়ে ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন মেয়ের নাম্বারে, ফিলাডেলফিয়ায়। ওপাশে রিং হচ্ছে... দূরের রিং... বেশ একটানা... একটু থেমে... আবার একটানা। কয়একবার রিং হবার পর কানে এল অস্ফুট স্বরে – ‘হ্যালো!’
- ‘ট্রেসি?’
- ‘আরে! মা? তুমি! এই সময়?’
- ‘না, এমনি। হটাৎ তোর গলাটা শুনতে ইচ্ছা করল সোনা। ঘুমিয়ে পড়েছিলিস?’
- ‘এ বাবা, না, না। এখনো ঘুমায় নি। একটা বই পড়ছিলাম শুয়ে শুয়ে। এই সবে ভাবছিলাম এবার ঘুমাতে যাবো। ও, জানো তো মা, আজকে না চার্লসএর সাথে ডিনারে বেরুবার কথা ছিল, কিন্তু এতো বাজে ওয়েদার এখানে না, যে বেরুনোই হলো না। সেই দুপুর থেকে সমানে বরফ পড়ছে। কি করে বেরুবো বলো? তোমাদের ওখানকার কি খবর? ওখানকার ওয়েদারও কি খারাপ?’
হা ভগবান, এই মুহুর্তে তাঁর মেয়ের সাথে অনেক, অনেক প্রয়োজনীয় কথা বলার ছিল, কিন্ত সেটা না করে তাঁরা ওয়েদার নিয়ে আলোচনা করছেন। অনেক কিছুই বলতে চান তাঁর মেয়েকে কিন্তু কিচ্ছু বলতে পারছেন না।
- ‘মা, শুনতে পাচ্ছ? লাইনে আছো?’
জানলার বাইরে তাকালেন মিসেস হুইটনি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে যেন আজ পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে... সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে এই ধরাধাম থেকে... ‘এখানে... এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।’ কি অদ্ভুত নাটকীয় ভাবে যেন আজ সমস্ত কিছু ঘটছে, ভাবলেন মিসেস হুইটনি। যেন হিচককের সিনেমার দৃশ্য।
- ‘ওটা কিসের শব্দ মা?’
বজ্রপাতের। রেডিওতে বলছিল নিউ অর্লিন্সে আজ প্রচন্দ বজ্রবিদ্যুত সহ বৃষ্টির সম্ভবনা আছে। বাড়ির বাইরে বেরুলে ছাতা ব্যবহার করতে না ভোলে... ছাতা... ছাতা আর কোনদিনই প্রয়োজন হবে না মিসেস হুইটনির...
- ‘ওটা বাজ পড়ার শব্দ সোনা।’ গলায় জোর করে প্রফুল্লতা এনে বললেন মিসেস হুইটনি, ‘তা তোদের ওখানকার কি খবর বল।’
- ‘ওহ মা, আর বোলো না। নিজেকে একেবারে প্রিন্সেস মনে হচ্ছে গো। একেবারে প্রিন্সেস!’ খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল ট্রেসির গলার স্বর। ‘আমার মত এত খুশি কেউ হতে পারেনি কখনও। তুমি জানো, কাল সন্ধ্যেবেলায় চার্লসএর বাবা মার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। উফফফফ। কি যে মনের মধ্যেটা করছে কি বলবো তোমায়। তুমি শুধু ভাবো, দ্য স্ট্যানহোপ্স অফ চেস্টনাট হিলস, উফফফফ। ভাবা যায়? একটা সাম্রাজ্য, বুঝলে। ওরা নিজেরাই একটা প্রতিষ্ঠান... আমার তো কি বোলবো মা, ভাবলেই মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে যেন হাজারটা ডায়নোসরসের সাইজের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। কি যে হবে কালকে, কে জানে!’
‘ভাবিস না সোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস, তোকে খুব পছন্দ হবে ওনাদের।’
‘হ্যা। চার্লসও তো তাই বলেছে। ও বলেছে যে ওই সব বিরাট ব্যাপার স্যাপার নিয়ে না ভাবতে। ও আমাকে ভালোবাসে, সেটাই সবথেকে বড় ব্যাপার। এই সব বিরাট ব্যাপার স্যাপার সব তুচ্ছ। আমাকে খুব সাহস দিচ্ছে ও। আমিও ওকে ভিষন ভিষন ভালোবাসি মা। আমি যে কবে তোমার সাথে ওর আলাপ করিয়ে দেব, সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। দেখবে তোমারও চার্লসকে খুব ভালো লাগবে। ওর মধ্যে এতটুকুও বড়লোকি কোন ব্যাপার নেই। একদম আমাদের মতই সাধারন চালচরন। চার্লস না, ও দারুন, বুঝলে মা!’
‘বুঝতে পারছি সোনা।’ স্মিত হেসে উত্তর দিলেন মিসেস হুইটনি। ‘আমি জানি ও খুব ভালো। তোর মতই ভালো।’ মিসেস হুইটনি জানেন, আর কোনদিনই তিনি চার্লসএর সাথে দেখা করতে পারবেন না। নাঃ। এখন এইসব ভাবা ঠিক নয়। তাড়াতাড়ি করে বলে উঠলেন, ‘সেকি জানে সে কত ভাগ্যবান তোর মত একজনকে তার জীবনে পেয়ে?’
‘যাঃ। কি যে বলো না মা। শুধু নিজের মেয়ের সুখ্যাতি...’ লজ্জায় রাঙা হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল ট্রেসি। ‘আমার কথা অনেক হয়েছে, তোমার কথা বলো। তোমার শরীর কেমন আছে, মা? পায়ের ব্যাথাটা কমেছে?’
ডঃ রুশের কথাটা মনে পড়ল মিসেস হুইটনির, ‘নিশ্চিন্তে থাকুন মিসেস হুইটনি, আমি লিখে দিচ্ছি, পাক্কা ১০০ বছর আরো বাঁচবেন... একদম পার্ফেক্ট হেলথ আপনার... সুগার, ব্লাড প্রেশার... কোনটারই কোন খারাপ অবস্থা নেই। একদম সঠিক সব কিছু...’ হাঃ, ১০০ বছর...। ‘ভালো। আমার শরীর একদম ঠিক আছে রে সোনা। চিন্তা করিস না।’
‘হুম, বুঝলাম। কোন বয়ফ্রেন্ড জুটেছে নাকি?’ হাসতে হাসতে পেছনে লাগল মেয়ে।
ট্রেসির বাবা মারা গেছে প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত কারুর সাথে একটু বেরুবারও ইচ্ছা হয়নি মিসেস হুইটনির কখনো, ট্রেসির হাজার ইচ্ছা সত্তেও।
‘ছাড় তো বয়ফ্রেন্ডএর কথা। তুইও যেমন। সেই আবার পেছনে লাগা। তা তোর কাজ কর্ম কেমন চলছে? ভালো লাগছে তো?’
‘দা-রু-ন। আর জানো মা, চার্লস বলেছে যে বিয়ের পর আমি কাজ করলে ওর কোন আপত্তি নেই।’
‘বাঃ। সে তো খুব ভালো খবর। সত্যিই, ছেলেটা খুব বুঝদার মনে হচ্ছে। তোর সাথে খুব ভালো মানাবে, দেখিস।’
‘হ্যা গো, সত্যিই খুব ভালো ছেলে। তুমি নিজেই দেখো না যখন আলাপ করিয়ে দেব।’
আবার একটা প্রচন্ড জোরে বাজ পড়ল। সময় হয়ে গেছে। এবার চিরবিদায় নেবার পালা। গলাটাকে খুব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেন মিসেস হুইটনি। বললেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। গুড বাই সোনা। শুয়ে পড় গিয়ে, যা। আর রাত করিস না। সাবধানে থাকিস।’
‘তুমিও সাবধানে থেকো। আর কালকে চার্লসদের ওখান থেকে ফিরে আবার ফোন করবো, কেমন?’
‘আচ্ছা’, তারপর একটু থেমে মিসেস হুইটনি বললেন, ‘আই লাভ ইয়ু ট্রেসি... আই লাভ ইয়ু ভেরি মাচ...’
‘লাভ ইয়ু টু, মা...’
মিসেস হুইটনি আস্তে করে টেলিফোনের রিসিভারটাকে নামিয়ে রেখে দিলেন ক্র্যাডেলের ওপর।
*********
টেবিলের ওপর থেকে পিস্তলটা তুলে নিলেন হাতে। এই মুহুর্তে আর একটা মাত্র কাজ বাকি রয়েছে। সেটা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি... সময় দিলে হবে না। পিস্তলটা তুলে নিজের কপালে ঠেকিয়ে ট্রিগারটা টেনে দিলেন...