কাজলদীঘি শ্মশান/পীরবাবার থান--মামনজাফরান (জ্যোতি বন্দোপাধ্যায়) - অধ্যায় ১৪২

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-42380-post-4704909.html#pid4704909

🕰️ Posted on March 2, 2022 by ✍️ MNHabib (Profile)

🏷️ Tags: None
📖 1133 words / 5 min read

Parent
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পদ্মপুকুরের ধারে চলে এলাম। মিত্রা দেখে অবাক, চারিদিকে জল আর জল, মাঝখানে কিছু বক, সরাল, পানকৌড়ি বসে আছে। মাঝে মাঝে দীঘির বুকে মুখ লুকিয়ে মাছ ধরে খাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, পাখির ডাক, কোথাও গাছের ফাঁকে বসে ফিঙে পাখি লেজ নাড়ছে, কোথার তিতির তি তি করে ডাকছে, চারিদিকে এক অদ্ভূত মায়ার খেলা। মিত্রা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। ওর চোখের পলক পরে না। -বুবুনরে এ তুই কি জায়গায় নিয়ে এলি, সত্যি কি দারুন জায়গাটা, তোর দীঘাআড়ি একরকম সুন্দর, এ আর এক রকম। এ-টা নদীর সঙ্গে মিশে আছে। বলতে পারিস এটা আমাদের গ্রামের রিজার্ভার, গ্রীষ্মকালে এর জল চাষের কাজে লাগে। গ্রামের লোকেরাই এর সংস্কার করে। ওই পাশে একটা লক গেট আছে। বর্ষাকালে জল ভর্তি হয়ে গেলে লক গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। -কয়কটা পদ্ম তুলে দেনা। -চল। আমরা পায়ে পায়ে নিচে নামলাম -এখানে দাঁড়া আমি একটা গাছের ডাল ভেঙে আনি। -কেনো? -এতোটা জলে নামা যাবে না, ডালটা দিয়ে ফুলগুলো কাছে টেনে আনতে হবে। -তাহলে নিম ডাল ভাঙ দাঁতনও হবে। -কাছা কাছি তো দেখতে পাচ্ছি না, চল দেখি ওদিকে পাই কিনা। আমরা আবার ওপরে উঠে এলাম, পুকুরের পার দিয়ে হাঁটছি, জনমানব শূন্য, সর সর করে একটা আওয়াজ হলো, মনে হলো কেউ যেন চলে গেলো, মিত্রা আমার হাতটা চেপে ধরলো। আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, একজন পটি করতে বসেছে, ঝোপের আড়ালে, সে উঠে দাঁড়িয়ে আর একটু গভীরে চলে গেলো। মিত্রা আমার দিকে ভয়াতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে। -কিরে! -তোর মতো পটি করতে বসেছিলো, নিশ্চিন্তে। আমরা যে এসে পরবো বুঝতে পারে নি। -বুঝলি কি করে। -এতো মহা মুস্কিল, তোকে বোঝাতে গেলে গ্রামে দশ বছর থাকতে হবে তোকে। -দেবোনা একটা গাঁট্টা। -চল। আবার একটু এগিয়ে এলাম, একটা নিমগাছ পাওয়া গেলো, আমি ডাল ভাঙলাম। -আর ওদিকে নয়, চল এগিয়ে যাই ও পাশের ঘাট থেকে তুলে দেবো, তারপর বাঁধ থেকে নেমে পরবো। -কেনো এরি মধ্যে চলে যাবি। -না। -তাহলে। -এই পথে যখন এসেছি একবার পাঠশালায় যাবো। -তোর? -হ্যাঁ। দেখে নে তোর বুবুনের প্রাথমিক স্কুলটা। আমরা নিম দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে এগিয়ে গেলাম, এখন আর ততটা শীত করছে না। আমি চাদরটা কোমরে বেঁধে নিলাম, আমার দেখা দেখি মিত্রাও কোমরে বেঁধে নিলো। আমরা পদ্মপুকুরের পূর্ব ঘাটে চলে এলাম মিত্রা বললো -একটু দাঁড়াই দাঁড়া। -কেনো। -মনে হচ্ছে আর একবার হবে। -কিরে দুদিনের রি-এ্যাকসন নাকি। -কি জানি। -কি জানি মানে, তোকে নিয়ে তো আমার ভীষণ ভয়, এখানে শরীর খারাপ করলে, সিধে কলকাতায় নিয়ে চলে যাবো। -সকালে কতটা রস গেলালি। -আমি গেলালাম, তুই তো লোভের মারে খেয়ে নিলি। আবার বলে কিনা দাঁড়া আর একটু টেনে নিই। মিত্রা হাসছে। -কি হলো। -না একটু হিসু করলে মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে। -দেখ এরকম বন-বাদার আর পাবি না, জলও পাবি না, পেলে করে নে, এরপর ফাঁকা মাঠ, গাছের পাতা দিয়ে পাছু মুছতে হবে। -তুই ভয় দেখাসনা তো। কতটা রস খাওয়ালি কতটা হাঁটালি বলতো। আমি হাসছি ওর মুখের চেহারা দেখে, অতি কষ্টে চাপার চেষ্টা করছে। -ঠিক আছে একটু করে নিই। -যা খুলে ওখানে চলে যা, বেশি দূরে যাস না। -কোথায় যাবো বল। -ঘাটের দিকে নেমে ডানদিকের ঝোপের মধ্যে বসে পর, কেউ দেখতে পাবে না। -ধোবো কোথায়। -কেনো, ওই তো এতো জল। -তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি। -না চোখ বন্ধ করে থাকবো। ও আবার দৌড় লাগালো। আমি দাঁতন চিবিয়েই চলেছি। কিছুক্ষণ পর দেখলাম মিত্রা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। -কিরে পাতলা না শক্ত? -শক্ত। -বাঁচালি। কলকাতায় খেলি এখানে এসে খাজনা দিলি। -দাঁড়া তোর ঘাড় মটকাচ্ছি গিয়ে। ওদিকে ফের। আমি পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় খেললো, হঠাত সামনের দিক হতেই মিত্রা উঠে দাঁড়ালো। -শয়তান। আমি জানতাম। -যাবো নাকি। -এলে চোবাবো। -তুই কি রেহাই পাবি। -ঘোর না। -এখনো হয় নি। -আর একটু বাকি আছে। আমি আবার ঘুরে দাঁড়ালাম। চারিদিক নিস্তব্ধ, ঝির ঝিরে হাওয়া গাছের পাতায় দোলা দিচ্ছে, একটা সুন্দর শব্দ চারদিকে কুয়াশার মতো ঝড়ে ঝড়ে পরছে। দুম করে পিঠে একটা ঘুসি পরলো, আমি একটু অভিনয় করে মাটিতে পরে গিয়ে কাতরাতে আরম্ভ করলাম, মিত্রার মুখটা শুকিয়ে আমসি হয়ে গেলো, আমি কাতরাতে কাতরাতে খালি লক্ষ্য করছিলাম ও প্যান্টিটা পরেছে কিনা, দেখলাম ও প্যান্টিটা পরে নি। আমি ঝপ করে ওর মুন্তিতে হাত দিয়ে দিলাম, ও লাফিয়ে উঠল, জায়গাটা ভিজে একেবারে সপ সপে হাত দিতেই ও আমার পেটের ওপর উঠে বসলো -শয়তান, অভিনয়। এখুনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, আমার তলপেটের ওপর বসে দিলো দুবার মুন্তিটা ঘসে। আমি হাসছি -মোছা হয়ে গেছে এবার নাম। -না। -চারিদিকে কেউ নেই দেবো এখানে ফেলে……. -দেনা, আমি কি না বলেছি। -ওঠ ওঠ বেলা হয়েছে। অনেকটা পথ ফিরতে হবে। দেরি হয়ে গেলে আবার স্কুলে যাওয়া যাবে না। মিত্রা প্যান্টিটা পরে কামিজটা পরলো, আমরা দীঘির জলে নেমে মুখ ধুলাম পাজামাটা গুটিয়ে গোটা দশেক পদ্মতুলে মিত্রার হাতে দিলাম। তারপর ধানখেতের মাঝখান দিয়ে মেঠো পথে আমার স্কুলে এসে পৌঁছলাম। -কইরে তোর স্কুল। -ওই তো খরের ঘরটা। -যাঃ! -হ্যাঁরে ওটাই স্কুল। -কেউ তো নেই কোথাও? -থাকবে কেনো। -তার মানে! -গ্রীষ্মকালে সকালে স্কুল হয়, আর শীতকালে দুপুরে। -এ কিরকম স্কুল রে! -হ্যাঁ। আমরা মাথা নীচু করে স্কুল বাড়িতে ঢুকলাম। একটা লম্বা ঘর, মিত্রা চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখছে। -এটা তোদের স্কুল। -হ্যাঁ। -বেঞ্চ কোথায়? এখানকার স্কুলে বেঞ্চ থাকে না। -বেঞ্চ! ওসব ভুলে যা, এই ঘরটা দেখছিস এটা থ্রি আর ফোরের ক্লাস হয়, এই পাশটা থ্রি, ওই পাশটা ফোর, বারান্দার ডানদিকে ক্লাস টু আর আমরা সামনে ওই গাছতলায় বসতাম, ওটা ক্লাস ওয়ান। বৃষ্টি পরলে, সব এই ঘরে একসঙ্গে পোল্ট্রি মুরগিরর মতো, কঁকড় কঁকড় করতাম। -অফিস ঘর! -স্যারের বাড়িতে। -তুই কোথায় বসতিস। -আয়। আমি মিত্রাকে বাইরে নিয়ে এলাম, সেই শিরিষ গাছটা এখনো রয়েছে, ওই গাছের তলায় ওকে নিয়ে গেলাম, -আমি এখানে বসতাম, গাছের গোড়ার নির্দিষ্ট স্থানটা দেখালাম, আমার এই পাশে বাসু বসতো আর এইখানে অনাদি, সামনে চিকনা বসতো, প্রচুর মার খেতো আমার হাতে। -কেনো রে। -মাথায় উকুন ছিলো, আমার মাথাতে ঢুকতো, মনাকাকা বেধড়ক মারতো কেন আমার মাথায় উকুন ঢুকেছে, কি জবাব দেবো। আমি এসে চিকনাকে পিটতাম, তারপর অনেক বেশি বয়স পযর্ন্ত আমার মাথায় চুলই ছিলো না। নেড়া মাথা। মিত্রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। -ভাবছিস বুবুন তোকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছে। নারে একটুও মিথ্যে নয়। সেই অনি তোর সঙ্গে কলকাতার নামজাদা কলেজে পরেছে। স্টার পেয়েছে। র‌্যাঙ্ক করেছে। এই সিরিষ গাছের তলা থেকে তার শুরু। মিত্রার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। -জানিস মিত্রা এইখানে আমার জীবনের প্রথম অঘটন ঘটে। সেদিন খেয়ে দেয়ে স্কুলে এসেছিলাম, মার শরীর খারাপ বাবার শরীর খারাপ, বন্যা হয়ে গেছে। জল একটু নেমে গেছে, স্কুল খুলেছে আমরা সবাই স্কুলে এসেছি, মনাকাকা লোক পাঠালো নিতে, পোকা মাস্টার স্কুল ছুটি দিয়ে দিলো, কে যেন আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলো, বাড়িতে গিয়ে খালি মনে আছে কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদলো তারপর আমাকে কোলে করে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো। মিত্রার চোখদুটো ছল ছল করে উঠলো। -একমাসের ওপর স্কুলে আসিনি। একমাস পর যেদিন প্রথম স্কুলে এলাম কি রিসেপসন পেয়েছিলাম জানিস না, তারপর সব আবার থিতিয়ে গেলো, সেই গতানুগতিক জীবন ধারা, মানুষ খুব তাড়াতাড়ি সব ভুলে যায় জানিস, আর যারা ভুলতে পারে না, তাদের ভীষণ কষ্ট, আমিও ভুলে গেছি বাবা-মার মুখটা। কাল বড়মাকে জড়িয়ে ধরে যখন কেঁদে ফেলছিলাম, মায়ের মুখটা বার বার মনে করার চেষ্টা করেছিলাম, পারি নি। বুকের ভেতরটা ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তারপর সামলে নিলাম। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। -আমি জানি তোরও এরকম অনেক কষ্ট আছে, তাই তোকে আর কষ্ট দিতে চাই না। তোর মতো বড়মার আছে ছোটোমার আছে, দাদার আছে মল্লিকদার আছে। কিছুক্ষণ দুজনে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
Parent