কাজলদীঘি শ্মশান/পীরবাবার থান--মামনজাফরান (জ্যোতি বন্দোপাধ্যায়) - অধ্যায় ১৪৩

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-42380-post-4704968.html#pid4704968

🕰️ Posted on March 3, 2022 by ✍️ MNHabib (Profile)

🏷️ Tags: None
📖 1292 words / 6 min read

Parent
-চল, যখন থ্রিতে পরি তখন কোথায় বসতাম দেখে নে। -হ্যাঁ রে বুবুন এই এবরো খেবরো মেঝেতে তোরা বসতিস কি করে।! হেসে ফেললাম। -আমার সবেতেই একটা গল্প আছে, বুঝলি। আমার বললে ভুল হবে আমার মতো যারা এসব পাঠশালা থেকে মানুষ হয়েছে তাদের প্রত্যেকের, কেউ বলতে পারে কেউ বলতে পারে না। কাকা দুটো সেন্ডো গেঞ্জি আর দুটে ইজের প্যান্ট কিনে দিয়েছিলো, এটা আমার গ্রীষ্মকালীন পোষাক। আর শীতকালে ফানেলের একটা ফুল হাতা জামা। আর শান্তিপুরের গামছা দেখেছিস, ওই রকম একটা পাতলা চাদর। বেশ শীত গ্রীষ্ম কেটে যেতো। মিত্রা আমার দিকে তাকিয়ে আছে হাঁ করে। -পরনে ইজের পেন্ট গেঞ্জি, বগলে একটা একহাতি মাদুর আর বাজারের ব্যাগের মধ্যে একটা স্লেট, বর্ণ পরিচয় আর সহজপাঠ। ক্লাস ওয়ান পাস। ক্লাস টু সহজপাঠ দ্বিতীয় ভাগ, হাসিখুশি আর এ বি সি ডি শেখার বই। ক্লাস থ্রিতে এসে ইংরাজি বানান শেখার একটা বই, কিশলয় অঙ্কের বই, স্বাস্থ্য ও সামাজিক আর ছাত্রবন্ধু। ক্লাস ফোর পযর্ন্ত এরকম ছিলো। তারপর ফাইভ থেকে সেই পীরবাবার থানের ওখানে যে স্কুল সেই স্কুল। এক নতুন জগত, একটু একটু করে নিজেকে পাল্টাতে আরম্ভ করলাম। -তাহলে যেখানে প্রোগ্রাম হলো ওখানে যে স্কুলটা আছে ওটা কি। -ওটাতো এই হালে হয়েছে, ওটা নাকি জুনিয়র হাই স্কুল। ক্লাস এইট পযর্ন্ত। ক্লাস থ্রি মানে আমরা এই স্কুলের সিনিয়র হলাম, মানে তোদের ওখানে নাইন টেন বলতে পারিস। মিত্রা হাসছে। -আমি এই জানলাটার ধারে বসতাম, তুই বোস, বোসনা একটা জিনিষ দেখাবো। মিত্রা আমার কথা মতো জানলার ধাপিতে উঠে বসলো। ওর জায়গা হচ্ছে না। -একটা ছোটোখাটো মানুষ এই জানলাটায় বেশ ভালোভাবে বাবু হয়ে বসতে পারতো, বেশ আরাম করে ঠেসান দিয়ে। মিত্রা মাথা নাড়ছে -এবার তুই চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে নে, তুই সেই ছোট্ট বুবুন তোকে মাস্টার লিখতে দিয়েছে তুই জানলা দিয়ে পাশের ওই ঝোপে টুনি পাখি, চড়ুই পাখি, শালিক পাখির লড়াই দেখছিস, বাইরের দিকে চোখ দে বুঝতে পারবি। আমি মিত্রার পাশে গিয়ে থেবড়ে বসে পরলাম। -কি দেখছিস? মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরলো, সত্যি বুবুন তোর চোখ আছে, এই জায়গায় বসলে আমি বুবুন হয়ে যেতাম। -খালি একটু তোর ইমোশনটাকে ঠিক ঠিক কাজে লাগাতে হবে। প্রকৃতি মানুষের ওপর ভীষণ প্রভাব বিস্তার করে বুঝেছিস। -ওই জামগাছটা দেখছিস। -হ্যাঁ। -ওই বকুল গাছটা দেখছিস। -হ্যাঁ। -এদের বয়সের কোনো গাছ, পাথর নেই। -জামের সময়, জাম গাছের তলাটা ভরে যায় খেয়ে শেষ করা যায় না। আমরা বকুল গাছটায় উঠে বকুল ফল পেড়ে আগে খেতাম, তারপর বিচিটা দিয়ে বাঁশি তৈরি করে বাজাতাম। -আমাকে একটা বানিয়ে দিবি। -দেবো। -আর এই জানলাটা ছিলো ক্লাস ফোর। উল্টোদিকে ঘুরে দেখালাম। এখান থেকেও দেখ তুই সেই এক ছবি দেখতে পাবি। -স্কুলটার নাম কিরে। -আশাপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়। -তোদের মাস্টারের নাম কি ছিলো। -প্রকাশ মাইতি। তা সবাই তাকে পোকা মাইতি বলে ডাকতো, আমরাও বলতাম পোকা মাস্টার। আয় বাইরে আয় বকুল গাছটার তলায় যাই। মিত্রা আমার হাত ধরে বেরিয়ে এলো। -কি নিস্তব্ধ চারিদকটা। -হ্যাঁ। বিশ্বভারতী গেছিস। -একবার। -ঠিক আছে তোকে নিয়ে যাবো, আমি বিশ্বভারতীর যেখানে গিয়ে একলা বসে থাকি সেই জায়গাটা। -কবে যাবি। -একটু সময় করে নিই। আমরা পেছনের বকুল গাছটার তলায় এলাম। -এই দেখ বকুল ফল পরে আছে। খাবি। -দে। মিত্রা দাঁতে কেটেই থু থু করে ফেলে দিলো। -কিরে। -কি কষ্টে। তোর মুখ নেই তাই কোষ্টে লাগছে, আমি দুতিনটে কুড়িয়ে খেয়ে নিলাম। মিত্রা আমাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে। -দাঁড়া দেখি পাথরটা আছে কিনা, আমি স্কুলের দেয়ালের ধারে গেলাম, দেখলাম হ্যাঁ এখনো আছে মিত্রাকে ডাকলাম। ও কাছে এলো ওকে দেখালাম, এই পাথরটা দেখছিস, ও আমার দিকে তাকালো, আমি যখন ক্লাস ওয়ানে তখন থেকে ওখানেই দেখছি। -তার মানে। -এখানে কোথাও একটা ধানকোটা আর গম ভাঙানোর কল ছিল। তারপর সেটে উঠে যায়, তার একটা পাথর এইটা। -কি কাজে লাগে। -বলতে পারবো না, তবে বকুল বিচি এতে ঘষে ঘষে বাঁশি তৈরি করতাম, আমাদের খুব কাজে লাগতো। -কি করে তৈরি করবি। -দাঁড়া দেখাচ্ছি। আমি বকুল বিচিটা একপাশ ঘসে ঘসে একটু চেপ্টা করলাম, দেখলাম বিচির ভেতর শাসটা দেখা যাচ্ছে, মিত্রার দিকে তাকালাম, ও আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে -তোর কাছে সেফটিপিন আছে। ও ঘাড় নাড়লো, নেই। -কিরে তুই, একটা মেয়ে তোর কাছে সেফটিপিন চাইলাম নেই। -আমি ব্যবহার করি না। উঠে দাঁড়ালাম। -কোথায় যাচ্ছিস? -দাঁড়া একটা বাবলা কাঁটা তুলে আনি। -সেটা আবার কি রে! -দেখ না। আমি বাবলা গাছ থেকে একটা বড় বাবলা কাঁটা ভাঙলাম। কাঁটা দিয়ে বিচির ভেতরের শাঁসটা বার করে আনলাম, ফুঁ দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করলাম, তারপর দু’আঙুলের ফাঁকে রেখে জোড়ে ফুঁ দিলাম। শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ হলো, মিত্রা হেসে ফেললো। -আর একবার বাজা। আমি বাজালাম। -দে আমি একটু বাজাই। আমি ওর হাতে দিলাম। প্রথমবারটা বাজাতে পারলো না, আমি ওর দুআঙুলের ফাঁকে ঠিক মতো রেখে বললাম ঠোঁটটা নিয়ে আয় এবার ফুঁ দে। হাতে ধরে দেখিয়ে দিলাম। ও তাই করলো বেজে উঠলো। মিত্রার চোখে বিষ্ময়, খিল খিল করে হেসে উঠলো। -আমি পেরেছি বুবুন, আমি পেরেছি। -নে তুই বাঁশি বাজা। আমি আর কয়েকটা বানাই। আমি বাঁশি বানাতে বসলাম, মিত্রা ঘুড়ে ঘুড়ে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। ওর বাঁশ বাজানোর শব্দে পাখিগুলোও ডেকে উঠছে, ও যেন আরো মজা পেয়ে গেলো, ওই ভাবে বাঁশি বাজায় শিস দেয়। আমি ওকে লক্ষ্য করছি, যেন এক নতুন জগতের সন্ধান পেলো, প্রকৃতির সঙ্গে মিলনের প্রথম স্বাদ। বকুল বিচি ঘষতে ঘষতে কান পেতে শুনলাম একটা মটর বাইকের আওয়াজ এদিকেই এগিয়ে আসছে, মিত্রাকে ডাকলাম -কি। -শোন। ও কাছে এলো। -একটা গাড়ির আওয়াজ হচ্ছে না। -হ্যাঁ। -শোন ভাল করে আওয়াজটা এদিকেই এগিয়ে আসছে না। -হ্যাঁ, মনে হচ্ছে খুব কাছে, আমাদের এই রাস্তাতেই এগিয়ে আসছে। -কাজ সেরেছে। -কেনো রে। -মনে হচ্ছে লোক বেরিয়ে পরেছে খুঁজতে। মিত্রা খিল খিল করে হেসে ফেললো। -দারুন মজা লাগছে। -কেনো? -আমাদের খুঁজতে বেরিয়েছে। -এইরকম ভাবে হারিয়ে যেতে ভালো লাগে না।! -দারুন। -তাহলে আমি পাগল নয় বল। -কে বলে তুই পাগল, তোকে যারা চেনে না তারা পাগল। -তুই চিনলি। -আজ না, সেই কলেজ লাইফ থেকে, তাই তোর জন্য আমিও পাগল। হেসে ফেললাম। আওয়াজটা একেবারে সামনে এসে গেলো। দুটো বাইক এসে থামলে বকুল গাছটার তলায়, বাইক থেকে নামলো অনাদি আর বাসু। অনাদি গম্ভীর, বাসু হাসছে। আমি হাসছি। মিত্রা আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। -তোরা দুটো কি মানুষকে পাগল করে দিবি। -কেনো। -কখন বেরিয়েছিস বাড়ি থেকে। -মিত্রার ঘড়িতে তখন পৌনে পাঁচটা বাজে, তাও মিত্রা রাস্তায় এসে বললো, ঘড়িটা বন্ধ হয়ে পরে আছে কাল থেকে। -তারমানে কখন বেরিয়েছিস জানিস না। -না। -তুই পাগল, ম্যাডামকে পাগল করছিস কেনো। মিত্রা ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে উঠলো। অনাদি আর গম্ভীর থাকতে পারলো না, হো হো করে হেসে উঠলো। বাসুও হাসছে। -এইগুলো করছিস। -হ্যাঁ। -তুই কি ক্লাস ফোরে পরছিস। -দেখাচ্ছিলাম মিত্রাকে। -দেখলেন ম্যাডাম আপনার বুবুনের আঁতুর ঘর। -হ্যাঁ। সঙ্গে তোমাদেরটা ফাউ। -আমাদেরটাও দেখিয়েছে। -হ্যাঁ, সবারটা। -বাঃ বাঃ তাহলে এখানে অনেকক্ষণ। -তা জানি না। ঘড়ি নেই। -মোবাইল? -বাড়িতে রেখে এসেছি। -মানে কেউ যেনো আপনাদের নিষিদ্ধ কাজে বিরক্ত না করে। -বাবাঃ তুমি হেড মাস্টারের মতো কথা বলছো। বাসু অনাদিকে বারণ করো না। অনাদি হাসছে। -সত্যি অনি তোকে নিয়ে আর পারা যাবে না। -পদ্মপুকুর থেকে কখন এলি। -ওখানে যাইনি তো। -আবার মিছে কথা বলছিস। শশধর কাকা তোদের দেখেছে। -তাহলে তো সব জানিষ। -না বললে জানতেই পারতাম না কোথায় গিয়েছিলি। প্রথমে ওখানেই যাই, চারিদিক শুনশান দুজনের কেউ কোথাও নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম, এরপর তোদের গতিবিধি কোথায় হতে পারে। ভাবলাম ফিরে গেছিস, ছোটোমাকে ফোন করলাম, বললো না ফিরিস নি। তখন বাসুই বললো, দেখ এখান থেকে কাছে, দুটো জায়গা আছে, বাজার নয়তো স্কুল। প্রথমে বাজারে গেলাম, তারপর এখানে এলাম। সকাল থেকে কত কিলোমিটার গাড়ি চালালাম বলতো। -কতো হবে মাইল দেড়েক। বাসু হেসে ফেললো। -তুই থাম তো অনাদি আর হেজাস না। চল দুজনে দুটোকে তুলে গ্যারেজ করি। -বুবুন আমার পদ্ম। -আমি কি করে জানবো। বাসু অবাক হয়ে তাকালো - পদ্ম আবার কি? -আমার পদ্মফুল। -তুই যে বললি পদ্মপুকুরে যাস নি। আমি মাথা নীচু করে হাসছি। মিত্রার দিকে তাকিয়ে বললাম -যা স্কুলবাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখ। বাসু ওর পেছন পেছন গেলো, অনাদি আমার দিকে কটকট করে তাকিয়ে আছে, আমি মুচকি মুচকি হাসছি। মিত্রা ওর ফুলের গোছা নিয়ে বেরোলো। -তুই এতো ফুল তুললি কি করে। -কেনো গাছের ডাল ভেঙে নিলাম। -নাঃ তোকে নিয়ে কিছু বলা যাবে না। তুই যে কি করে এতবড় বড় স্কিম করিস আমার মাথায় ঢোকে না। -আমি বাসুর বাইকে বসি তুই অনাদিরটায় বস, না হলে আমাকে বকতে বকতে নিয়ে যাবে, তুই অনাদির কাছে বকুনি খা। মিত্রা বললো। অনাদি কিছুতেই গম্ভীর থাকতে পারছে না, খালি হেসে ফেলছে। -বাসু আসতে চালিও, না হলে দেখবে তুমি বাড়ি পৌঁছে গেছো, আমি রাস্তায় উল্টে পরে আছি। বাসু হাসছে। আমি অনাদির বাইকে উঠলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।
Parent