গ্রামের অসহ্য বুড়া মেহমান রতন - অধ্যায় ১
পর্ব ১
ঢাকায় নরম বিকেলটা যেন ফ্ল্যাটের জানালা বেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। অল্প হাওয়া, কোথাও কোথাও মেঘের ছায়া। শহরের কোলাহল দূরে থাকলেও ফ্ল্যাটের ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে ছিল।
আয়েশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। তার বয়স বাইশ—যৌবনের উজ্জ্বলতায় ভরা মুখখানি। আজ স্বামী সিয়ামের সাথে সিনেমা দেখতে যাবে সিনেপ্লেক্সে। মনে মনে খানিকটা উচ্ছ্বাস, খানিকটা লাজুকতা। লালচে শাড়ি তার সাজ যেন নতুনত্বের গন্ধ ছড়াচ্ছিল।
তার স্বামী সিয়ামের সাথে বিয়ে হয়েছে ৬ মাস হলো। এরেঞ্জ ম্যারেজ হলেও দুজনের মধ্যে মিল দেখা পরার মত।
ঠিক সেই সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রেহানা—তার শাশুড়ি। বয়স পঞ্চান্ন হলেও মুখে এখনো প্রাণবন্ত দুষ্টুমি। চোখে মায়া আর ঠোঁটে চিরাচরিত খোঁচা। নিজের মেয়ের মতই আদর করে একমাত্র ছেলের বউ আয়েশাকে।
রেহানা হেসে উঠলেন,
—“আরে বাহ, আয়েশা মা, তুমি নাকি ছবি দেখতে যাবে? ছবি দেখাই যথেষ্ট না, ছবি করতে না?”
আয়েশা লজ্জায় গালে হাত দিল, তারপর আবার হেসে জবাব দিল,
—“আম্মা, ওসব আপনার বয়সের গল্প। আমি শুধু ছবি দেখলেই খুশি।”
রেহানা চোখ টিপে বললেন,
—“হুম, বয়স মানে কী? তবে হ্যাঁ, তুমি তো দেখছি আজ একেবারে হিরোইন হয়ে বের হবে।”
কথোপকথনের ভেতর দিয়ে ফ্ল্যাটে এক ধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। আয়েশা নিজের গয়নার বাক্স খুলে কানে দুল পরছিল। এদিকে রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছিল মসলা ভাজার গন্ধ। শহরের এক অদ্ভুত বাস্তবতা—ভেতরে উষ্ণ সংসার, বাইরে গমগম করা ট্রাফিক।
কিছুক্ষণ পর দরজায় টোকার শব্দ। এরপরেই ভেতরে প্রবেশ করল সিয়াম। চাকরি থেকে ফিরে তার মুখে ক্লান্তি ঝরে পড়ছে। হাতে ফাইল আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ।
—“কি হলো, রেডি?” সিয়ামের কণ্ঠে যেন একফোঁটা অধীরতা।
আয়েশা ছুটে এসে বলল,
—“চল, আমি একেবারেই প্রস্তুত। আজকের ছবিটা মিস করলে আর চলে না।”
রেহানা পাশে বসে তখন গম্ভীর সুরে বললেন,
—“এই যে, ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও না। সারাদিন অফিস করেছে। এখনি আবার নিয়ে যাবে সিনেমা হলে?”
সিয়াম হেসে মায়ের দিকে তাকাল,
—“মা, আজকেই শুধু সময় পেলাম। আগামীকাল আবার কাজের চাপ থাকবে। সিনেমাটা আজই দেখতে হবে।”
রেহানা নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
—“ঠিক আছে, তবে মনে রেখো, কাজের সাথে পরিবারের খেয়ালো রাখতে হবে। আর দ্রুত আমাকে একটা নাতির মুখ দেখাও।”
এতে আয়েশা ও সিয়াম দুজনেই লজ্জা পেল।
তাদের কথায় ফ্ল্যাট ভরে উঠল হাসিতে। আয়েশা আর লজ্জায় গম্ভীর হয়ে গেল। তার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি।
ঠিক তখনই হঠাৎ কলিং বেলের টুংটাং শব্দে সবাই থমকে গেল।
ড্রইংরুমের নীরবতা কেটে গেল সেই শব্দে।
রেহানা চমকে বললেন,
—“এই সময় আবার কে এলো?”
সিয়াম ব্যাগটা রেখে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
জানালার বাইরে তাকাল। বিকেলের আলো নিভে আসছিল ধীরে ধীরে। কোথা থেকে যেন অচেনা প্রত্যাশা ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে।
ফ্ল্যাটের ভেতরের গাঢ় পরিবেশে তখন এক অদৃশ্য কৌতূহল জমে উঠেছে।
কে দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপারে?
বিকেল কি শুধু সিনেমার গল্প নিয়ে আসবে—নাকি তার থেকেও ভিন্ন কিছু?
পর্ব ২
দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সিয়ামের চোখ বিস্ময়ে ভরে উঠল।
—“আরে রতন কাকা…আপনি?”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক বলিষ্ঠ পুরুষ। শরীরটা যেন মাটির গন্ধে ভেজা—কালো, শক্তপোক্ত, মাঠে-ঘাটে কাজের জোরেই গড়ে ওঠা এই দেহ। চোখে ধূসর ক্লান্তি, তবু চেহারায় এক ধরনের দৃঢ়তা। সে-ই রতন—সিয়ামের শৈশবের রক্ষক, সঙ্গী, আশ্রয়।
রতন ই সিয়ামের বাবার গ্রামের সম্পত্তি দেখা শোনা করে। তার কিছুই নেই। তাকে সিয়ামের বাবা ভাইয়ের মত দেখেছে। রতনের মা সিয়ামের দাদার বাসায় কাজ করত।
রতন হেসে উঠল, গলার টান ভাঙা গ্রাম্য উচ্চারণে বলল—
—“হ রে বাবা, ভেতরে আসতে বলবি না? দাঁড়ায় থাকমু?”
সিয়াম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দরজাটা পুরোটা খুলে দিল,
—“আরে আসেন কাকা, আসেন। ভেতরে আসেন।”
রতন ভেতরে পা রাখতেই ফ্ল্যাট যেন এক অন্য রকম আবেশে ভরে গেল। বহুদিনের চেনা মানুষ, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শৈশবের অসংখ্য স্মৃতি। সিয়ামের ছোটবেলায় যখন বাবার বকুনি গায়ে সহ্য হতো না, তখন রতন-ই বুক চিতিয়ে তাকে আগলে রাখত, পিঠে চাপাত, গল্প শোনাত।
ড্রইংরুমে বসে থাকা রেহানা বেগম রতনকে দেখে মুখভরা হাসি দিলেন।
—“আরে রতন! কত বছর পরে দেখা হলো। তুমি ঢাকায় এলে কবে?”
রতন হাত জোড় করে বলল,
—“ভাবি, কী করব, গ্রামে আর থাকা যাইতেছে না। তোমাদের ক্ষেতের জমিতে পানি উঠে গেছে। ভাবলাম এক মাস ঢাকায় থেকে যাই। আপনাদের তো অনেকদিন দেখি নাই।”
রেহানা খুশি হয়ে বললেন,
—“খুব ভালো করেছো রতন। এসেছো, এটাই তো বড় পাওয়া। থাকো আমাদের সঙ্গেই।”
এই মুহূর্তে সিয়াম হাসিমুখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশাকে পরিচয় করিয়ে দিল।
—“কাকা, এই আমার স্ত্রী আয়েশা।”
রতন মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল,
—“আহা! আল্লাহ বরকত দিক। অনেক সুন্দর বউ তোর।”
আয়েশা শুধু সামান্য মাথা নেড়ে অভিবাদন জানাল। তার মুখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই—গোমড়া হয়ে আছে। আসলে অনেকক্ষণ ধরে সিনেমার জন্য প্রস্তুত ছিল, অথচ সব পরিকল্পনা হঠাৎ ভেস্তে গেল। সে চোখ মেলে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল,
—“চল না, আমরা মুভি দেখতে যাই।”
কিন্তু সিয়াম একটু অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল,
—“আজকে আর হবে না আয়েশা। কাকা এতদিন পরে এসেছেন, উনিই এখন সবার আগে।”
আয়েশার মুখের রাগ থামল না। সে কোনো কথা না বলে দ্রুত রুমে চলে গেল, আর দরজাটা জোরে বন্ধ করে দিল। শব্দে ঘরটা মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রতন অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,
—“আরে, আমার কারণে কিছু হইল নাকি?”
সিয়াম কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল,
—“না কাকা, আপনি আসছেন এটাই আমাদের জন্য খুশির বিষয়।”
রেহানা মৃদু হেসে কথাটা সামলালেন,
—“তুমি তো জানোই, মেয়েদের একটু মন খারাপ হলে এমন করে। কিছু হয়নি।”
রতন ধীরে ধীরে চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বলল,
—“যাই হোক, তোদের কাছে থাকলে শান্তি লাগবে। গ্রামে তো এখনকার মতো অবস্থা না। ফসলের জমি ডুবে গেছে, থাকা প্রায়ই দায়। তাই ভাবছি এক মাসের মতো ঢাকায় থাকি। আপনাদের সঙ্গে সময় কাটাই।”
রেহানা এবার আন্তরিকভাবে বললেন,
—“খুব ভালো করেছো রে রতন। তুমি এসেছো খুব ভালো লাগল।”
ফ্ল্যাটের ভেতরের পরিবেশে এক নতুন ধারা বইতে শুরু করল। একদিকে পুরোনো সম্পর্কের আবেগ, অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের অস্থিরতা। আয়েশার বন্ধ দরজার ওপারে জমে থাকা অভিমান, আর রতনের দীর্ঘশ্বাস মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত বিকেলের আবহ তৈরি করল।