গ্রামের অসহ্য বুড়া মেহমান রতন - অধ্যায় ১৫
পর্ব ২৭
রতনের ঘরটা গ্রামের পুরনো ঘর গুলোর মত মাখা—দুইটা টিনের ঘর, এবং একটা মাটির ঘর যেখানে বাঁশের খুঁটির পাশে বাঁধা পাঁচটা ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিনের এক ঘরে আছে একটা পুরনো চৌকি—সেখানে সবাই বসে খায়। অন্য ঘরেই আয়েশা আর রতন একটু আগে যা করল। ওইটাই ওদের মেহমান আসলে শুতে দেয়। সবচেয়ে ভালো রুম।
রানীকে সব বলেছে রতন। আয়েশা কে যে চাপ পরে বিয়ে করেছে। সে আসলে তার মৃত মালিকের ছেলের বৌ। রানী খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা। সে জানে কোন সময় কি করতে হবে।
বাইরে রাত কিন্তু পূর্নিমার আলো মিশে রুপালি রঙ গেছে চারদিক।
সবাই মাটিতে বিছানো মাদুরে বসে খেতে শুরু করে।চৌকির উপরে রানীর ছেলে মহণ ঘুমিয়ে থাকে। সে আজ সারা বিকেল খেলেছে। সকালে মন চাইলে কলেজে যায়, না মন চাইলে যায় না। কম বয়সেই তার নানা রতনের সাথে ক্ষেতে কাজ করে। কাজে একদম পটু। বয়স মাত্র ৭ কিন্তু রতনের অন্য কামলার চেয়ে মহণ ভালো কাজ করে।
রতন আর আয়েশা মুখোমুখি বসেছে। মাঝে থালা, ধোঁয়া ওঠা ভাত। আয়েশার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি—যেন রতনকে চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে। রতন যা করেছে তাকে ভয় দেখিয়ে এর জন্য আয়েশা রাগে ফুঁসছে।
আয়েশা শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
আয়েশা: মা, কোথায় ছিলেন আপনি?
রেহানা : এই ত পানি আনতে গিয়েছিলাম, রানীর সাথে। রতনই বলল—‘যান না, একটু ঘুরে আসেন।’
আয়েশা রতনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
আয়েশা: ও আচ্ছা… তাই নাকি!
রেহানা: কেন রে? কিছু হয়েছে নাকি?
আয়েশা (চুপচাপ হেসে): না মা, কি আর হবে?
একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করে,
আয়েশা: আচ্ছা মা, সিয়াম কখন আসবে?
রেহানা (গম্ভীরভাবে): সিয়াম এক সপ্তাহের আগে আসতে পারবে না।
আয়েশা (চমকে): কেন মা?
রেহানা: রাস্তা নাকি ভেঙে গেছে নদীর স্রোতে।
আয়েশার মুখ ম্লান হয়ে যায়। থালায় হাত থেমে থাকে কিছুক্ষণ।
কিছু সময় পর রেহানা কথা ঘুরিয়ে বলে,
রেহানা: আচ্ছা আয়েশা, তুই রানীকে চিনিস তো? রতনের মেয়ে—খুব ভালো মেয়ে রে!
রানী (লাজুকভাবে): ত্যাংকু।
আয়েশা (হাসি দিয়ে): ত্যাংকু না, থ্যাংক ইউ বল।
রানী: ওই একই তো হলো।
তিনজনেই হেসে ফেলে।
রতন তখন আয়েশার দিকে একচোখে তাকিয়ে আছে—চুপচাপ, কিন্তু চোখে যেন অনেক কথা। হাসলে আয়েশাকে যে কত সুন্দর লাগে। আয়েশা সঙ্গে সঙ্গে হাসা থামিয়ে ইশারা করে বোঝায়—“মাইর দিমু, চেয়ে থাকিস না।”
ঘরে হাসির মৃদু আওয়াজ, বাইরে ঝি ঝি পোকার ডাকে রাত আরও গভীর হয়।
খাওয়া শেষে……
রানী রেহানাকে উদ্দেশ্য করে- কাকি আপনি আর আয়েশা ওই রুমটা ঘুমাবেন।( আয়েশা আর রতন যে রুমে ****)
রতন কে উদ্দেশ্য করে- বাবা তুমি যাও, ওই মাটির ঘরে।
রেহানা- মাটির ঘরে ছাগল আছে, ওখানে কিভাবে ঘুমাবে?
আয়েশা (মনে মনে)- ঠিক ই আছে, বাস্টার্ড টা আর কোথায় ঘুমাবে?
রতন( মনে মনে)- আপনি যান না ভাবি, আমি আয়েশার সাথে ঘুমাই।?
রানী- বাবার অভ্যাস আছে কাকি। ও নিয়ে চিন্তা করবেন না।
এরপর সবাই সবার রুমে গিয়ে শুয়ে পরে।
পর্ব ২৮
রেহানা ও আয়েশা পাশে রুমে শুয়ে ছিল।
আয়েশা- মা?
রেহানা- হ্যাঁ মা, বল।
- আমি সরি। আজকে যে মন্দিরে সুতা বেঁধেছিলাম, খুব বড় ভুল হয়েছে আমার।
- বাদ দে মা। এগুলো আসলেই সব বিধাতার লিখন। দেখ না ওপর ওয়ালা বিপদ দেয় আবার তিনি ই রতনকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
আয়েশা( মনে মনে)- রতনকে পাঠিয়ে দেই নি, ও সুযোগের স্বদ্ব্যবহার করেছে মা।
আয়েশা- মা একটা কথা বলব?
রেহানা- হ্যাঁ বল।
- তোমার কি মনে হয় রতন ভালো মানুষ?
- হটাৎ এ প্রশ্ন?
- কেন কিছু হয়েছে?
- না মা এমনিই, এই যে তোমরা তাকে খুব বিশ্বাস কত যেম
- আসলে ও অনেক করেছে আমাদের জন্য।তোর শ্বশুর মারা যাবার পর ও গ্রামে ফসল লাগিয়ে যা পেত সব আমাদের দিত। এর জন্য ও তেমন টাকা কড়িও নেয় নি। দেখ না ওর ঘর এখনো পাকা করে নি।
- ও আচ্ছা।
- হ্যাঁ রে মা, তাই আমরা চাই লোকটা সুখে থাকুক। তুই ও যদি পারিস ওর জন্য কিছু করিস।
কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায় রেহানা। আয়েশা কোনো জবাব দেয় না। অবশেষে চোখ বুঝে এসে পরে তারও।
মোরগের তীক্ষ্ণ ডাক ভোরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দেয়।
ধোঁয়াটে কুয়াশা তখনও ঘিরে আছে গাছের ডালপালা, দূরে বাঁশঝাড়ের মাথায় রোদ উঠতে শুরু করেছে।
রতনের টিনের ঘরের জানালা ফুঁড়ে আসে সকালের আলো—নরম, উষ্ণ, ধূসর।
ঘরের ভেতরে রানী ধীরে ধীরে চোখ মেলে।
চোখে এখনো ঘুমের রেখা, কিন্তু সময়ের ডাক তাকে আর বিছানায় থাকতে দেয় না।
চৌকির নিচ থেকে ছাইয়ের পাত্রটা তুলে নিয়ে সে বের হয় উঠোনে।
হালকা ঠান্ডা বাতাস মুখে লাগে, চুলের গোছা এলোমেলো করে দেয়।
রানী ছাই মেখে দাঁত মাজতে মাজতে আকাশের দিকে তাকায়—
আকাশ যেন এখনো ঘুমোচ্ছে, সেখানে হালকা কুয়াশার আস্তরণ।
দাঁত মাজতে মাজতেই সে মুরগিগুলোর খোপ খুলে দেয়—
দশ বারোটা মুরগি লাফিয়ে বেড়িয়ে যায় উঠোনে,
“চুক চুক” বলে ডাকে রানী, সবচেয়ে বড় মোরগটা কালো তাই তাকে সে নাম ধরে ডাকে—“কালু, আয় রে!”
তারপর বসে পড়ে রাতের আধোয়া থালা-বাটি মাজতে।
পানির ছিটে গিয়ে রোদে ঝলমল করে তার গাল।
মাঝে মাঝে হালকা ভগবানের নাম নেয়—
“হে ভগবান, দিনটা ভালো কাটুক।”
তার কণ্ঠে সেই প্রার্থনা যেন ভোরের হালকা শিশিরের মতো মিষ্টি।
পাশের ঘরে তার ছোট ছেলে, মহণ, তখনও আধো ঘুমে।
রানী ঘরে ঢুকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
রানী: ওঠ বাবা, ভোর হয়ে গেছে, পড়তে বসো।
মহণ (চোখ কচলাতে কচলাতে): মা, একটু পর…
রানী: না রে, সূর্য ওঠে গেছে, এখন না উঠলে কলেজে দেরি হবে।
মহণ অনিচ্ছায় খাতা-কলম নিয়ে বসে, আর রানী হাঁড়িতে পানি চড়ায়।
চুলার আগুনে ধোঁয়া ওঠে, কুয়াশা আর ধোঁয়ার মিশ্রণে উঠোনটা যেন স্বপ্নের মতো লাগে।
রতনও উঠে যায়। বাইরে নামে সে।
তার কাঁধে হাল, পাশে পাঁচটা ছাগল—
তাদের দড়ি খুলে দিয়ে বলে,
রতন: আয় চল, ক্ষেতে যাই আজ। ঘাস লাগানো ক্ষেতে ছেড়ে দিবে এই ছাগল গুলোকেম
ছাগলগুলো একে একে বেড়িয়ে যায়,
তাদের পায়ের নিচে মাটির নরম শব্দ—“চপ, চপ”—
সূর্য ওঠার সাথে সাথে রতনের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ে পথে।
এদিকে রান্নাঘরে(শুধু চুলা উপরে গোলপাতা), মায়ের পাশে বসে পড়ছে মহণ।
বইয়ে লিখছে—“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান”
কিন্তু বানান আটকে যায় তার ছোট্ট মুখে।
মহণ: মা, এইটা কি?
রানী একটু দেখে, সে পড়া জানে না ঠিক মর, সহজ বানান ধরতে পারলে কঠিন বানানে আটকে যায়। চোখ কুঁচকে বলে,
রানী: উঁহু... এটা ব… ব…‘বগোবধু’।
মহণও মাথা নাড়িয়ে ঠিক সেইভাবেই পড়তে থাকে—
মহণ: বগোবধু শেখ মুজিবুর রহমান!
রানী হেসে ফেলে, এ হলো তৃপ্তির হাসি। সে ভাবে, 'ক জন মা ই বা পারে এরকম ছেলেকে পড়াতে।' তার অহংকার হয় নিজের উপর। সেই হাসি চুলার আগুনে প্রতিফলিত হয়,
মুখটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ভেতর থেকে চুলার হাঁড়িতে ভাতের গন্ধ ভেসে আসে,
ছোট্ট উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে ভোরের জীবনের নিঃশব্দ গান।
পাখিরা ডাকে, বাতাসে ধানের গন্ধ,
একটা নতুন দিনের সূচনা হয়—