কথা মালা - বড় গল্প, বড়দের গল্প - অধ্যায় ১০
পরদিনের ঘটনা:
ভোর থেকেই আকাশ যেন সিঁদুরে রঙে রাঙা—গরমের চাপে বাতাস ভারী, ঘাম হয়ে গায়ে লেপ্টে থাকে। মুনমুন সেন বারান্দায় বসে ঠাণ্ডা দই-চিঁড়ে খাচ্ছেন, হাতে মাটির বাটি—সাদা দইয়ের ধবধবে ভাঁজে চিঁড়ের সোনালি আভা যেন শরতের কাশফুলের সঙ্গে মিশে গেছে। ঠোঁটে দই লাগামাত্রই জিভে জমে ওঠে শীতল মিষ্টি, গলায় নামার আগেই—"ট্রিং ট্রিং!"—মোবাইলের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠল সোহিনী আগারওয়ালের নাম।
মুনমুনের ঠোঁটে খেলে গেল এক চাপা হাসি, মনে মনে ভাবলেন, "এই জ্যৈষ্ঠের দাবদাহে ওই পাগলিটা আবার কী চায়?"
ফোন ধরতেই কানে এল সোহিনীর চঞ্চল, তীক্ষ্ণ গলা—যেন কাঁচের উপর নখের আঁচড়: "ও মুনমুন! কালকে তোমরা যে সোচকার্ট বুটিকে গিয়েছিলে, সেটার লোকেশনটা দাও তো! আজ হঠাৎ আমারও শপিং-পাগলামি চেপে গেছে!"
মুনমুন এক চামচ দই-চিঁড়ে মুখে দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, "ওই তো মেইন রোডে, ঝুপড়িওয়ালা মোল্লা পট্টির গাঁড়ি পার হয়ে ডান দিকে, নতুন মহমেডান বাজার—"
"আরে, গুগল ম্যাপে পাবো তো?" সোহিনীর গলা যেন উৎসুক চড়াই পাখির মতো উঁচু হয়ে উঠল।
মুনমুন হেসে ফেললেন, "পাবি, পাবি! তবে আজ গেলে রুকসানাকে বলে দিস—মাস্টারজি আজ দুপুরে বাড়িতে মাপ নিতে আসবে, কিন্তু আমি থাকব না। পরের সপ্তাহে আসতে বলিস।"
"ওমা!" সোহিনীর খিলখিলানি ফোনের ওপাশ থেকে যেন ঝড় তোলে, "তুমি তো একেবারে রাজরানীর স্ট্যাটাস পেয়ে গেছ! মাস্টারজি নিজে বাড়িতে এসে মাপ নিচ্ছে?"
মুনমুনের গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল, "ছি ছি! এত বড় মুখ!"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ!" সোহিনীর হাসি আরও গড়িয়ে পড়ল, "তবে আজ তো তোমার 'ফিটিং সেশন' মিস! মাস্টারজির সাথে দেখা হলো না!"
মুনমুন ঠোঁট কুঁচকে বললেন, "সোহিনী, তোর মুখে যেন নিমকি-ভাঙা চুনকালি!"
ফোনের ওপাশ থেকে সোহিনীর হাসি যেন ফেটে পড়ল, "আচ্ছা, চলি তাহলে! ট্যাক্সি ডাকতে হবে। রামু কাকাও আজ কিছু শার্ট কিনতে চেয়েছে।"
"ওই রামু কাকা!" মুনমুন চোখ টিপলেন, "তোর জন্য তো সে সবসময় রেডি!"
সোহিনী এবার জোর দিয়ে বললেন, "চুপ কর! পাড়ার লোকে শুনে ফেলবে!"
ফোন কেটে মুনমুন সোফায় হেলান দিলেন। জানালা দিয়ে চৈত্রের রোদ পর্দা ফুঁড়ে এসে পড়েছে মেঝেতে, যেন সোনালি সাপের খোলস—গরমে পাখির ডাক নেই, শুধু দূর থেকে ভেসে আসে রাস্তায় বরফওয়ালার "কোল্ড ড্রিঙ্কস!" ডাক।
ট্যাক্সিতে উঠে সোহিনী আর রামু কাকা
ট্যাক্সি ডাকতে বেরিয়েছে সোহিনী—লাল-সাদা শাড়ির পাড়ে রোদের ঝিলিক, গলায় সোনার হার যেন টগবগ করে ফুটছে দুপুরের তাপে। হাতে রঙিন প্লাস্টিকের ব্যাগ, নখে লাল রঙের পলিশ—ঠিক যেন মারওয়াড়ি বধূর রূপকথা। পাশে দাঁড়িয়ে রামু কাকা—সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে মোড়া, মুখে নির্বিকার ভাব, কিন্তু চোখে চাপা উত্তেজনার আগুন।
ট্যাক্সি এসে দাঁড়াতেই ড্রাইভার পেছন ফিরে তাকায়—সোহিনীর রূপে মুগ্ধ। তার শাড়ির লাল রং রোদে ঝলমলে সিঁদুরের মতো জ্বলছে, গলার হারটার প্রতিটি দানা যেন গলিত সোনার ফোঁটা। রামু কাকা নিঃশব্দে গাড়িতে উঠে বসে, হাতের মুঠোয় এক অদৃশ্য শক্তি—যেন কোনো অদম্য ইচ্ছাকে চেপে রাখছে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই রাস্তার শোরগোল ডুবে যায় এসির হিমশীতল নিশ্বাসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যায় "সোচকার্ট" বুটিকে—দোকানের শীতল কাঁচের দরজায় আটকে যায় সোহিনীর চোখ। ভেতরে দৃশ্যমান রুকসানা—ছিপছিপে গড়ন, সালোয়ারে টানটান পাছা, এক কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলছে, হাতে রঙিন কাপড়ের স্তূপ। দরজার পাশে বড় করে লেখা নতুন কালেকশনের বিজ্ঞাপন—"স্পেশাল ডিসকাউন্ট!"—যেন সোহিনীর শপিংপাগল মনকে আরও উসকে দিচ্ছে।
ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে নামতেই শীতল এসির হাওয়া গায়ে লাগে—গরমের জ্বালা থেকে মুক্তি পেয়ে সে যেন স্বর্গে পা রাখল। দোকানের ভেতর ঢুকতেই রুকসানা তাকে দেখে চমকে ওঠে, উৎসাহে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে—
"আপনি কি মিসেস সেনের রেফারেন্সে এসেছেন?"
সোহিনী হেসে উত্তর দেয়, "হ্যাঁ, ওই কথাতেই তো!"
রুকসানা মাথা নেড়ে বলে, "মিসেস সেন তো আজ বিশেষ অর্ডার দিয়েছেন। মাস্টারজি দুপুরে বাড়িতে যাবে মাপ নিতে।"
সোহিনী চোখ টিপে হেসে বলে, "মিসেস সেন তো আজ বাড়িতেই নেই, তাই আমায় বলে দিয়েছে তোমাকে জানাতে!"
রুকসানা মাথা নাড়ে, "ঠিক আছে, পরের সপ্তাহেই মাস্টারজিকে পাঠাব।"
কিন্তু তারপরই সে একটু ইতস্তত করে, গলার স্বর নামিয়ে বলে, "আজ তো জুম্মাবার... তাই এখনই দোকান বন্ধ করতে যাচ্ছি। কাজের ছেলেটাও আজ নেই, মাস্টারজিও আসছেন না..."
সোহিনীর চোখ তখন জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে, উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে, "তাহলে তো আমি ভাগ্যিস ঠিক সময়েই চলে এসেছি! শুধু একটু চোখ বুলিয়ে নেব, তারপর চলে যাব!"
রুকসানার চোখ বারবার রামু কাকার দিকে যায়—সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবির নিচে লুকিয়ে থাকা পোক্ত দেহের দিকে, তার মাংসপেশীর টানটান ভাবের দিকে। তবুও দোকানদারির হাসি মুখে আঁকড়ে ধরে বলে, "আসুন ম্যাডাম, আপনি সময় নিয়ে দেখুন!"
তারপর একটু চাপা গলায় চিৎকার করে, "আব্বু! দোকানের শাটারটা একটু নামিয়ে দাও তো! খোলা দেখে কেউ এসে গেলে তো আর বন্ধ করা যাবে না!"
দোকানের ভেতর থেকে লুঙ্গি গোটানো পায়ে বেরিয়ে আসে এক পঞ্চান্ন বছরের রোগা-পাতলা মানুষ—মুখে তামাকের দাগে কুঁচকে যাওয়া চামড়া, গালের হাড় যেন চামড়া ফুঁড়ে বেরোতে চায়। তার চোখে অদ্ভুত এক লোভী দৃষ্টি, যেন কোনো ক্ষুধার্ত শিয়াল।
"হা রুকসানা!" বলে সে, কিন্তু তার চোখ আটকে যায় সোহিনীর ফর্সা, ঘী খাওয়া চর্বিওয়ালা শরীরে—গলার হার, হাতের চুড়ি, শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে থাকা নরম মাংসের দিকে।
রুকসানা তড়িঘড়ি বাধা দেয়, "আব্বু! উনি মিসেস সোহিনী আগারওয়াল, আমাদের বিশেষ কাস্টমার!"
আব্বু তার লালচে চোখ কচলিয়ে নিচু গলায় বলে, "সালাম ম্যাডাম..."
তার গলা থেকে বের হওয়া স্বর যেন পুরনো হারমোনিয়ামের ভাঙা সুর—কাঁপা, কর্কশ, তবুও এক অদ্ভুত মাদকতা মেশানো।
রামু কাকা অস্বস্তিতে পায়ের আঙুল দিয়ে ধুতির প্রান্ত ঘষতে থাকে, মনে মনে ভাবে—এই বুড়োটা তো উলঙ্গ চোখে তার মালকিনের দিকে, শিয়ালের মতো চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে!
সোহিনী বুক ফুলিয়ে শাড়ির আঁচল ঝাঁকিয়ে সামলে নেয়—হাতকাটা ব্লাউজ থেকে বেরিয়ে থাকা বাহুগুলো ঘামে ভিজে ঝিলিক দিচ্ছে, বগলের ভেজা চুল উঁকি মারছে। সে "রাম রাম" বলে রুখসানার আব্বুর দিকে তাকায়—ঠিক যেন কোনো রাজমাতা ভৃত্যের দিকে তাকায়!
দোকানের ভেতর থেকে ভেসে আসে ন্যাপথালিন গোলার তীব্র গন্ধ, আর পুরনো সিলিং ফ্যানের আওয়াজ কাঠখড় পোড়ার মতো কর্কশ। রুকসানা তড়িঘড়ি তার আব্বুকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে পাঠায়—"যাও আব্বু, শাটারটা নামাও, এসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না!"
বাইরে থেকে শোনা যায় লোহার শাটার নামার কর্কশ শব্দ—ক্র্যাঙ ক্র্যাঙ! দোকানের আলো কমে আসে, কাঁচের জানালা দিয়ে ঢোকার রোদের রেখাগুলো এখন সাপের মতো কুটকুটে উঠেছে।
রামু কাকা ধুতির ওপর দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে—"দোকান বন্ধ করলে গরম লাগবে বেশি!"—বলে রুকসানার কচি দেহের দিকে তাকায়।
রুকসানা হাসি চেপে বলে—"না না রামু কাকা, এসি চলছে!"—তারপর সোহিনীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি সুরে যোগ করে—"আমরা শুধু নতুন কাস্টমার আসতে দেব না, আপনারা স্বচ্ছন্দে দেখুন!"
কিন্তু তার চোখের কোণে লুকিয়ে আছে এক তড়পানি—যেন সে নিজের আব্বুর আচরণে লজ্জা পাচ্ছে!
দূর থেকে শোনা যায় রুখসানার আব্বুর কাশির শব্দ—খাঁ খাঁ খাঁ! আর তার লুঙ্গির খসখস শব্দ, যেন শুকনো পাতার গুঁড়িগুঁড়ি ভাঙার আওয়াজ!
দোকানের কোণে পড়ে থাকা কাপড়ের স্তূপের আড়াল থেকে মাঝে মাঝেই রুখসানার আব্বুর সেই শিয়াল-চোখ উঁকি মারে! সোহিনী নিজেকে সামলে নেয়—যেন কোনো অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে!
ট্রায়াল রুমে অন্ধকারের খেলা
রুকসানা লক্ষ করে—কীভাবে তার আব্বুর কুনজর চোখ মিসেস সোহিনীর শরীরে আটকে আছে! আবার মিসেস সোহিনীও বুক ফুলিয়ে, বগল সামান্য উঁচু করে নিজেকে প্রদর্শন করছে নানা অছিলায়! মারওয়াড়ি লডলডে মাগীর বগলের ঘামে ভেজা চুল দেখে লাল ঝরছে রুখসানার আব্বুর।
দোকানের আধা-অন্ধকারে এই অদৃশ্য টানাটানি যেন এক অদ্ভুত যুদ্ধের ময়দান!
রুকসানার গলা শুকিয়ে আসছে, বাঙালি রামু কাকার ঘামে ভেজা পাষণ্ড শরীর দেখে তার মন অজানা উত্তেজনায় ভিজে উঠেছে!
কাপড়ের স্তূপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে নিজের শাড়ির আঁচল টেনে ধরে, গলার স্বর কাঁপতে কাঁপতে বলে—
"আব্বু, মিসেস সোহিনী আগারওয়ালকে ওই নতুন কালেকশনগুলো দেখাও না? উনি তো স্লিভলেস পরেন বোধ হয়!"
তার কথার মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক ধরনের চাপা ইঙ্গিত!
আব্বু লুঙ্গি ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসে, তার চোখ এখনও সোহিনীর বাহুর নরম চামড়ায় আটকানো! সে বলে—
"হ্যাঁ ম্যাডাম, এই দিকে আসুন!"—বলে একটা র্যাকের দিকে ইশারা করে, যেখানে ঝুলছে রঙবেরঙের স্লিভলেস ব্লাউজ!
সোহিনী ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে যায়, কিন্তু পিছন থেকে রামু কাকার অস্বস্তি বাড়ছে!
দোকানের সেই এল-আকৃতির কোণায় গুমোট গরম আরও বেশি জমে উঠেছে! সোহিনী এবং আব্বু অদৃশ্য হয়ে গেছে অন্য প্রান্তে, শুধু শোনা যাচ্ছে তাদের গুঞ্জন!
- চলবে