কথা মালা - বড় গল্প, বড়দের গল্প - অধ্যায় ২
"ভাড়া কত নেবেন?" ভদ্রমহিলার প্রশ্নে শামসুলের ক্লান্ত চোখে বিদ্যুতের ঝলক। তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল—"চল্লিশ টাকা, আপা," বলেই তিনি রিকশার ধুলোমাখা সিটটা হাত দিয়ে ঝেড়ে দিলেন। তার আঙুলগুলো কাঁপছিল—হয়তো ক্লান্তিতে, নয়তো এই দেবী প্রতিম বাঙালি রমণীর সামনে নিজের নোংরা, খাটো, পঁচান্ন বছরের জীর্ণ শরীর নিয়ে লজ্জায়।
ভদ্র মহিলা রিকশায় উঠে বসলেন, শাড়ির আঁচল গুছিয়ে নেওয়ার ভঙ্গিতে যেন সমস্ত রিকশাটাই সুগন্ধি হয়ে উঠল। তার দেহের গরম উষ্ণতা শামসুলের পিঠ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। "আপনি একটু ধীরে চালাবেন, কোন তারা নেই, আপনি তো খুব ঘামছেন।" বললেন তিনি, কণ্ঠে মায়া, "এই গরমে রিকশা চালানো খুব কষ্ট... আর তার ওপর আজ যা গরম পড়েছে।"
শামসুলের চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুটি রোদের তাপে শুকিয়ে গেলেও, তার হৃদয়ের ভার কমল না। এই নির্মম শহরে কতকাল পর কেউ তাকে শুধু 'রিকশাওয়ালা' নয়, একজন মানুষ হিসেবে দেখল! তিনি গামছার মলিন প্রান্ত দিয়ে বগলের ঘাম মুছলেন, যেখানে লবণাক্ত স্যাঁতসেঁতে ভাব আর দুর্গন্ধ মিশে আছে। রিকশার প্যাডেলে তার জুতোমাখা পা আর জোর দিল না, বরং ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন, যেন এই মুহূর্তের প্রতিটি সেকেন্ডকে চিবিয়ে উপভোগ করতে চান। ভদ্র মহিলার দেহ থেকে ভেসে আসা দামি পারফিউমের মৃদু সুবাস, তার নিশ্বাসের গরম স্পর্শ, আর শাড়ির খসখস শব্দ - সব মিলিয়ে শামসুলের দরিদ্র জীবন যেন এক অলৌকিক স্বপ্নে হারিয়ে গেল।
"আপনার তো বয়স হয়েছে," ভদ্রমহিলা মৃদু কণ্ঠে মিশে থাকা সহানুভূতি যেন মসজিদের সন্ধ্যা-আজানের মতো শামসুলের কানে বাজল, "এত কষ্ট করে রিকশা চালাতে হয়?"
শামসুলের শুষ্ক গলায় যেন কেউ হাত চেপে ধরল। "আপা... পেটের তাগিদে..." কথাটা অর্ধেক রয়ে গেল ঠোঁটের ডগায়। তারপর গভীর এক নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, যেন প্রতিটি শব্দ তার বুকের গহীন থেকে উঠে আসছে:
"ছেলে-মেয়ে মানুষ করলাম... বিয়ে সাদি করলাম...এখন শুধু একাকিত্ব..." তার কর্কশ কণ্ঠে ভেসে এল সেই সব রাতের স্মৃতি - যখন রিকশার হ্যান্ডেল ধরে ধরে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতেন, শীতের রাতে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, গরমের দিনে ঘামে ভিজে। রিকশার সিটে বসা ভদ্রমহিলার চোখ আটকে গেল শামসুলের কাঁধের সেই জীর্ণ গামছায়, যেখানে বছরের পর বছরের ঘাম, কষ্ট আর হতাশার দাগ মিশে আছে। রোদ যেন আরও প্রখর হয়ে উঠল, শামসুলের শরীর থেকে ভেসে আসা দেহগন্ধ মিশে গেল গরম বাতাসে, তৈরি করল এক করুণ সিম্ফনি।
"একাকিত্ব?" ভদ্র মহিলার এই সরল প্রশ্নে শামসুলের হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এল রিকশার হ্যান্ডেলে। তার আঙুলের গাঁটে সাদা হয়ে উঠল রক্তশূন্যতা। সেই মুহূর্তে তিনি অনুভব করলেন জীবনের সমস্ত একাকীত্ব - স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেই খালি টিনের ঘর, যেখানে শুধু নিস্তব্ধতা ঝুলে থাকে দেয়ালে দেয়ালে। প্রতিটি শ্বাস যেন এখন ভারি হয়ে উঠেছে স্মৃতির বোঝায়। রাস্তার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া একটি শিশুর হাসি তাকে মনে করিয়ে দিল তার নিজের সন্তানের শৈশবের দিনগুলো, যে এখন দূরে, অনেক দূরে চলে গেছে...
"মেয়ে শ্বশুরবাড়ি..., ছেলের নিজের সংসার...দুই দুইটা দশাসই গতরের বেগম নিয়ে মজা করতেছে.." - শামসুলের কণ্ঠে ভেসে এল সেই তিক্ত স্বর, যেন জীবনের সমস্ত হতাশা একসাথে উগড়ে দিচ্ছেন, "ফোন পর্যন্ত করে না মাসের পর মাস...যেন বাপ বলে কেউ নেই তার জীবনে..."
তার শুষ্ক ঠোঁটের কাঁপুনি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কীভাবে বারো বছরের বৈধব্য তাকে গ্রাস করেছে। "আর আমার বেগম... বারো বছর হলো চলে গেছেন... বেটা বেটির কারণে আরেকটা বিয়া পর্যন্ত করলাম না..." - কথাটা অসমাপ্ত রেখেই তিনি যেন স্ত্রীর স্মৃতির সামনে মাথা নোয়ালেন, সেই স্মৃতি যা এখনো তার বিছানার পাশের দেয়ালে ঝোলানো ফটোফ্রেমে বন্দী।
রিকশাটি হঠাৎ একটা গর্তে পড়ে টলে উঠল। শামসুলের চোখের জলে ভেজা দৃষ্টি রাস্তার ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল। গামছার মলিন কোণ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তিনি কাঁপা গলায় বললেন, "মাফ করবেন আপা... বয়স্ক মানুষ... আবেগ সামলাতে পারে না..." - এই ক্ষমাপ্রার্থনায় লুকিয়ে ছিল সমাজের প্রান্তিক মানুষের সেই চিরন্তন লজ্জা, যে লজ্জা তাদের আবেগ প্রকাশেও বাঁধা দেয়।
ভদ্রমহিলার চোখ সংকুচিত হলো। তিনি শামসুলের একাকিত্ব, নারীসঙ্গের অভাব এবং দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়া যৌন ক্ষুধার বেদনা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন। তার ছেলের দুই বউয়ের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, এ যেন লবণের ছিটে তার ক্ষতের উপর।
"ওই যে তরুণ-তরুণী জুটি... ওরা কি..." - ভদ্রমহিলার প্রশ্নের সুরে ছিল সতর্কতার আভাস, যেন কোনো অপ্রীতিকর স্মৃতি জাগ্রত করতে চাইছেন না।
শামসুলের কপালে গভীর ভাজ পড়ল, তার চোখের কোণে জমা হওয়া রোদে পোড়া চামড়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠল জীবনের কষ্ট। "না আপা... গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই নেমে গেল," তার গলার স্বর ভারী হয়ে এল, "বলল, 'কোনো কাজই তো করলেন না, ভাড়া আবার কিসের?'" - কথাগুলো বলতে গিয়ে তার আঙুলগুলো আবারো রিকশার হ্যান্ডেলকে শক্ত করে চেপে ধরল, যেন সেই অপমানের তীব্রতা এখনও তার স্নায়ুতে জ্বলজ্বল করছে।
একটু থেমে, মুখভঙ্গিতে আরও বেশি তিক্ততা নিয়ে যোগ করলেন: "ছোকরাটা যদিও ভাড়া দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু... ওই ঢেমনি নচ্ছার মাগীটাই যত নষ্টের গোড়া.." - তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো সেই রাগ যা বারবার দমিয়ে রাখা হয়েছে, সমাজের নিচু স্তরের মানুষের সেই অসহায় ক্ষোভ।
ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোণ শক্ত হয়ে উঠল, তার সুগঠিত চোয়ালের রেখায় ফুটে উঠল নিষেধের ভঙ্গি। "আচ্ছা..." - এই একটি শব্দেই যেন সমস্ত নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ পেল। তার ধবধবে ফর্সা গালে একটু লালচে ভাব এসে গেল, সম্ভ্রম রক্ষার্থে যা বলা যায় না তা যেন এই একটি শব্দেই বলে দিলেন।
রিকশাটি হঠাৎই গতি পেয়ে উঠল, যেন শামসুল তার আবেগকে পেছনে ফেলে দ্রুত পালাতে চাইছেন। মুখার্জী পাড়ার মোড়ে পৌঁছতেই ভদ্রমহিলার সুগঠিত হাতটি সামনের গলির দিকে ইশারা করল, "ওই গলিতে ঢুকবেন - শেষপ্রান্তের সাদা বাংলোটা।"
শামসুল মাথা তুলতেই চোখে পড়ল এক অকল্পনীয় দৃশ্য - বিশাল এক নব্য-ঔপনিবেশিক বাংলো, যার সাদা দীর্ঘ দেয়ালগুলো যেন সমাজের শ্রেণী বিভক্তিকে চিড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের বাগানে রঙ-বেরঙের ফুল সাজানো, যেন কারুকার্যময় গালিচা বিছানো। পার্কিং স্পেসে কালো বিএমডব্লিউ গাড়িটা যেন সম্পদের ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছে। গেটের মার্বেল পিলারে ঝুলছে "সেন নিবাস" নামের ব্রোঞ্জ প্লেট - প্রতিটি অক্ষরে যেন সমাজের উচ্চবর্গীয় অবস্থান খোদাই করা।
"এতো... এতো বড় বাড়ি?" শামসুলের কণ্ঠে মিশে গেল বিস্ময় আর হতাশার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তার চোখের পুত্তলিগুলো ছোট হয়ে এল, যেন এই বিলাসিতা দেখে চোখ জ্বালা করছে।
ভদ্রমহিলার ঠোঁটে ভেসে উঠল এক রহস্যময় হাসি, "হ্যাঁ, অনেক বছর থেকেই পরিবার এখানে থাকে।" তার এই সরল উত্তর যেন শামসুলের জীবন-জিজ্ঞাসাকে আরও গভীর করল।
রিকশা থামতেই ভদ্রমহিলা তার পার্স থেকে দুইশো টাকার নোট বের করে শামসুলের রুক্ষ, শিরায় শিরায় পরিশ্রমের ছাপ পড়া হাতে গুঁজে দিলেন। "এই নিন। ওদের ভাড়াটাও এর মধ্যে আছে।"
"না আপা, এতো বেশি আমি..." শামসুলের হাতটি পিছিয়ে গেল যেন আগুনে পুড়ছে। তার চোখে দেখা দিল সেই চিরন্তন সংঘাত - পেটের ক্ষুধা আর আত্মসম্মানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
ভদ্রমহিলার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক বুদ্ধিদীপ্ত হাসি, যেন এই দরিদ্র মানুষের মনস্তত্ত্ব পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন। "এই নিন," বলেই তিনি নোটটা রিকশার সিটে রেখে দিলেন। তারপর হঠাৎই এক অভিনব প্রস্তাব দিয়ে বললেন, "আমার এই ব্যাগগুলো একটু বাড়ি পর্যন্ত তুলে দেবেন?"
শামসুলের চোখে জ্বলজ্বল করে উঠল নতুন আশা। এই সামান্য কাজের বিনিময়ে সেই টাকা নেওয়া তার জন্য সম্মানজনক হবে। "জি আপা, অবশ্যই," বলেই তিনি দ্রুত রিকশা থেকে নেমে পড়লেন, তার জীর্ণ জুতোয় লাগা ধুলো বাংলোর মার্বেল ফ্লোরে ছাপ ফেলে দিল।
ভদ্রমহিলার ভারী শপিং ব্যাগগুলো হাতে নিতে গিয়ে শামসুলের শিরায় শিরায় বয়ে গেল এক অদ্ভুত অনুভূতি। প্রথম ব্যাগটির ওজন তার হাড়ে লাগল - বইয়ের ভারী বোঝা, মূল্যবান গ্রন্থ, যার ওজন শুধু শারীরিক নয়, বুদ্ধিবৃত্তিকও। দ্বিতীয় ব্যাগে ছিল নরম কাপড়ের মিহি স্পর্শ, যার প্রতিটি ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসছিল দামি পারফিউমের সুগন্ধ, ভদ্রমহিলার দেহের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে এক মাদকতা তৈরি করেছিল। তৃতীয় ব্যাগে কাঁচের বস্তুর ঠুনকো শব্দ শুনে শামসুলের কপালে ঘাম দেখা দিল - এই ভঙ্গুর বিলাসিতা তার রুক্ষ, শিরায় শিরায় পরিশ্রমের ছাপ পড়া হাতের যোগ্য কি না!
গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শামসুল সাহস করে প্রশ্ন করলেন, তার কণ্ঠে বিস্ময় আর শ্রদ্ধার মিশেল:
"আপা, আপনি...একাই থাকেন এত বড় বাড়িতে?"
ভদ্রমহিলা চাবির রিং বের করতে করতে বললেন, তার আঙুলের নখগুলো পরিপাটি করে কাটা, প্রতিটিতে মৃদু লাক্ষা রং:
"স্বামী মেডিকেল কলেজে ডাক্তার। ছেলে আইআইটিতে পড়ে।" তালা খুলে তিনি পিছন ফিরে বললেন, তার শাড়ির আঁচল বাতাসে দুলে উঠল:
"আমি নিজে কলেজের অধ্যাপিকা।"
শামসুলের চোখ গোল হয়ে উঠল, তার মুখে ফুটে উঠল সেই বিস্ময় যা কেবলমাত্র অশিক্ষিত মানুষের মধ্যেই দেখা যায়:
"কলেজ? ওমা..."
ভদ্রমহিলা তার এই অকপট বিস্ময় দেখে মৃদু হেসে বললেন, হাসিতে ফুটে উঠল তার শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব:
"দশ বছর হয়ে গেল..."
শামসুল মাথা নেড়ে বললেন, তার কণ্ঠে গ্রাম্য সরলতা:
"আমাদের গ্রামের কলেজমাস্টারবাবুকেও সবাই পাগলের মতো সম্মান দিত। আপনিতো..."
"শিক্ষকতা পেশা নয়, ব্রত," ভদ্রমহিলা বললেন, দরজা খুলে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর রেখায় তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সেই আলোয় তার ফর্সা গালের রং আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল:
"একটু ঠাণ্ডা জল খেয়ে যান না? এই ভ্যাপসা গরমে..."
শামসুলের চোখে জল এসে গেল। আজ এই শিক্ষিতা নারী তাকে শুধু টাকাই দেননি, দিয়েছেন অমূল্য সম্মান! তার মনে পড়ে গেল সেই সব দিনের কথা যখন উচ্চবর্ণের লোকেরা তাকে ঘরের ছায়া পর্যন্ত দিত না। আর আজ এই অপরূপ সুন্দরী, বাঙালি, উচ্চশিক্ষিত মহিলা তাকে নিজের বাড়িতে জল খেতে ডাকছেন! তার কণ্ঠে আবেগ আটকে গেল:
"আপা...না মা, আমি... মু..সলমান... আর এই রিকশাওয়ালা..."
তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো সেই শতাব্দীপ্রাচীন সামাজিক বিভাজনের ভার, যেখানে ধর্ম আর পেশা মানুষকে আলাদা করে দেয়। তার শব্দগুলো যেন বাতাসে ঝুলে থাকা সেই অদৃশ্য প্রাচীরকে স্পর্শ করল যা সমাজ গড়ে তুলেছে।
ভদ্রমহিলার হাত দরজার হ্যান্ডেল থেকে সরে এল। তিনি অবাক হয়ে তাকালেন, তার বড় বড় চোখে ফুটে উঠল এক ধরনের বেদনামাখা রাগ:
"আপনি রিকশা চালান বলে কী হয়েছে? সৎভাবে রোজগার করছেন তো! আর মু...সলমান বলে কী হবে? মানুষ তো মানুষ!" - তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো সেই শিক্ষা যা তাকে প্রকৃত মানুষ করে তুলেছে।
শামসুলের পা কাঁপতে লাগল। এই অভিজাত বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু অর্থই পাননি, পেয়েছেন তার চেয়েও বড় কিছু - আত্মসম্মান। সতর্কভাবে পায়ের পুরনো চটি খুলে রেখে, তিনি ব্যাগগুলো তুলে নিলেন। তার ময়লা লুঙ্গির প্রান্ত, ঘামে ভেজা গেঞ্জি - সবই যেন এই পরিষ্কার পরিছন্ন পরিবেশে বিদ্রোহ করছিল, কিন্তু ভদ্রমহিলার দৃষ্টিতে ছিল না কোনো ঘৃণা।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, তার কণ্ঠে আন্তরিক আগ্রহ:
"আপনার নামটা তো জানাই হলো না?"
শামসুল সিঁড়ির মাঝামাঝি থমকে দাঁড়ালেন। তার আঙুলগুলো লুঙ্গির প্রান্ত শক্ত করে চেপে ধরল, যেন নিজের অস্তিত্বকে নিশ্চিত করছেন। "শামসুল হক, আপা। নাম আমার শামসুল হক।" - এই প্রথম কেউ তার নাম জানতে চাইল।
কণ্ঠস্বরের সেই কম্পনে ছিল এক অদ্ভুত গর্ব - যেন আজীবন লুকিয়ে রাখা পরিচয়টি কেউ প্রথমবারের মতো জানতে চাইল।
ভদ্রমহিলা হাসলেন, তার ঠোঁটের কোণে খেলল এক মৃদু মায়া:
"শামসুল হক... কী সুন্দর নাম!" বলেই তিনি উপরের দিকে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু হঠাৎই থেমে পিছন ফিরে বললেন, "আর আমি... মুনমুন সেন।"
সেই মুহূর্তে, সিঁড়ির আলো-আঁধারিতে দাঁড়িয়ে, দুই মানুষ যেন শুধু নামই বিনিময় করলেন না, ভেঙে দিলেন অদৃশ্য সব দেয়াল। বাইরে থেকে ভেসে আসা শহরের শব্দ যেন থেমে গেল এই নিস্তব্ধতায়। শামসুল অনুভব করলেন, আজ তার জীবনের প্রথম সত্যিকারের মানবিক মুহূর্ত।
"মুনমুন সেন..." - শামসুল হক নামটি আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন, যেন কোনো পবিত্র কোরানের আয়াত তেলাওয়াত করছেন। তারপর লজ্জিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনি কি... সিনেমার নাকি?", তার চোখে বিস্ময় আর শ্রদ্ধার এমন মিশেল যে তা ভাষায় প্রকাশের অতীত।
মিসেস সেনের গালে লাল আভা ফুটে উঠল, যেন সন্ধ্যার রক্তিম সূর্য তার ফর্সা গালে রঙ ছড়িয়ে দিল। "ওমা! না না, আমি তো কলেজের অধ্যাপিকা," বললেন তিনি, তবে চোখের কোণে একটু আনন্দ লুকিয়ে রেখে, যেন এই ভুল পরিচয় তাকে খুশিই করল। তার এই হাসিতে ছিল নারীসুলভ লজ্জা আর আত্মতুষ্টির মিশেল।
শামসুলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। "আপনারে দেখতে তো ঠিক সেই... সেই..." তিনি হাত নেড়ে বিদেশি অভিনেত্রীর নাম মনে করতে চেষ্টা করলেন, তার কপালে ভাঁজ পড়ে গেল চিন্তায়। তার এই অকপট প্রশংসায় ছিল গ্রাম্য সরলতার সৌন্দর্য।
"কি যে বলেন!" মিসেস সেনের হাসিতে যেন ফুটে উঠল লাল গোলাপের পাপড়িতে শিশিরের ঝিলিক। তিনি বসার ঘরের দরজা খুলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটু শীতল হাওয়া, যেন অদৃশ্য কেউ তাদের ক্লান্ত মুখে স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দিল। শামসুলের জীর্ণ গেঞ্জির ভেজা অংশগুলো শিউরে উঠল এই শীতল স্পর্শে।
"আজও মেকানিক এসে ঠিক করতে পারেনি," মিসেস সেন বললেন, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে, তার সিঁথির সিঁদুর রেখাটি একটু ঘেমে ঘোলাটে হয়ে এসেছে। "আসুন, ভেতরে আসুন।" তার এই আমন্ত্রণে ছিল অকৃত্রিম আতিথেয়তা।
শামসুল দরজার মর্মর স্পর্শে শিউরে উঠলেন, তার পায়ের ধুলোর দাগ মার্বেল ফ্লোরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মিসেস সেন তাকে সোফায় বসতে ইশারা করলেন, নিজে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন, তার শাড়ির আঁচল বাতাসে মৃদু দুলছে, লদলদে ভারী পাছা থলথল করছে প্রতিটি পদক্ষেপে। ফ্রিজ থেকে বের করলেন দুটি কাঁচের গ্লাস, যার গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ঠিক যেন শিশির ভেজা পাতার মতো।
"নিন, একটু ঠাণ্ডা জল," বললেন তিনি, গ্লাসটি শামসুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, তার নখের উপর দিয়ে গ্লাসের ঠাণ্ডা বিন্দু গড়িয়ে পড়ল। নিজে বসলেন পাশের চেয়ারে, পায়ের নিচে হালকা কার্পেটের নরম স্পর্শ, তার পায়ের আঙুলের লাল নখরঙ কার্পেটের সাদা রেশমে ছাপ ফেলল
- চলবে