ট্যাবু ১ - নিজেরে হারায়ে খুঁজি - নতুন পর্ব ছয় - পেইজ পনেরো - অধ্যায় ১১
কিন্তু আকাশে চাঁদের আলোয়, কোন সুদুর থেকে ভেসে আসা রক্তের গন্ধ মাখা হাওয়ার ঘ্রাণ আমাকে কেমন চঞ্চল করে দিল। মনে হলো এই শান্তির আড়ালে লুকিয়ে আছে মৃত্যুর করাল ছায়া। আমি দেখছিলাম চারিদিকে। ততক্ষণে পিন্টো বাঁ দিকের মাই টা ছেড়ে ডান দিকের টা ধরেছে। ইভান ধরে আছে ভাই কে। আর সেই লোক টা বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে আছে আমার মাই দুটোর দিকে। মুখে একটা বেকুব নোংরা হাসি। হয়ত এই পরিস্থিতি তে না থাকলে বেকুব হাসি টা দিত না। নোংরামো টাই থাকত। কিন্তু এই রকম মৃত্যুর দোর গোঁড়ায় দাঁড়িয়েও একজন মায়ের দুধ খাওয়ানো দেখছে তার ছেলেকে বাধ্য হয়ে, হয়ত এটাই ওকে বেকুব বানিয়ে দিয়েছে। আর কোন আওয়াজ নেই চারিপাশে, শুধু আমাদের গায়ে জলের ধাক্কা লাগার ছিপছিপে শব্দ, মাঝে মাঝে হাওয়ার গাছের পাতায় লেগে শনশন শব্দ আর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পিন্টোর দুধ খাবার শব্দ।
- চক চক চক চক চক চক।
পর্ব পাঁচ
দুধ খাওয়া শেষ হতেই পিন্টো ঘুমিয়ে গেলো ইভানের কোলে। আমি জানি ইভান ওকে সারা রাত নিয়ে থাকতে পারবে না। আমি আমার কোলে নিয়ে কাঁধে পিন্টো কে শুইয়ে দিলাম। সারা রাত এই ভাবেই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমি ইভান কে আর মা কে বললাম,
- তোমরা পারবে না এই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সারা রাত। দুজনায় দুই দিক থেকে আমার গায়ে মাথা দিয়ে একটু চোখ টা বোজ। ভাল লাগবে হয়ত।
মা ঘুমালো না। কিন্তু ইভান এক দিকে এসে আমার কাঁধে মাথা রাখল। বাবাহ কতদিন পরে ছেলেটা কে আমি দেখলাম। যাক আর কোন চিন্তা নেই। যে মরণের ভয় আমি পেয়ে থাকতাম সেটা আমার আর নেই। এবারে ইভান কে কোথাও একলা আমি ছাড়ব না।
এদিকে নরক যন্ত্রণার মতন, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়া শুরু হলো। এতোক্ষণ ইভান কে পাবার আনন্দে এতোই মশগুল ছিলাম আমরা যে ঠাণ্ডার প্রকোপ ভাবিনি। এবারে মনে হচ্ছিল ভেজা পোশাকে আমরা জমে যাব। পিন্টো কে জড়িয়ে ধরলাম আমি। ইভান ও আমাকে জড়িয়ে ধরল একটু উষ্ণতা পেতে। জকি টা একেবারে আমার গা ঘেঁষে আছে। আর আমি থর থর করে কাঁপতে লাগলাম এক বুক জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে তাড়াতাড়ি ভোর হয়।
নরক যন্ত্রণার মতন কেটে গেল সারা রাত। বুক জলে দাঁড়িয়ে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। ভোর হতেই ইভান জল থেকে উঠে ষ্টেশন এ গিয়ে কিছু লোহার ফাঁপা রড নিয়ে এলো। তারপরে আমি আর মা মাঝে আর ইভান সামনে আর সেই বিশাল দেহী লোকটা পিছনে বন্দুক কাঁধে নিয়ে আর হাতে লোহার ফাঁপা রড নিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা আমাদের বাড়ির দিকে। যা বুঝতে পারলা হয়ত খুব বেশী হলে এই পুরো ইকারা শহরে আর বেশী লোক বেঁচে নেই। যারা ছিল অনেকেই কালকে চলে গেছে বা মারা পরেছে। জানিনা কীট আর ক্যারোল একে অপরের সাথে দেখা করতে পারল কিনা। নিশ্চই পেরেছে। মনের ভরসা আছে আমার। যাই হোক এবারে কোন ঝামেলা হলো না।
ওই লোক টাও আমাদের সাথেই থাকবে ঠিক হলো। দিনের আলো ফুটতেই লোকটা কে ভালো করে দেখলাম। বছর ষাঠ হয়েস হবে। ইভানের মতন লম্বা হলেও বহরে ইভানের তিন গুন। মোটামুটী আমার ও তিন গুন। লোকটা মন্দ নয়। কালকে আমার ছেলেকে দুধ খাওয়ানো ছাড়া আর কিছু বদ গুন আমি দেখিনি লোকটার মধ্যে। আর তাছাড়া এই সময়ে একত্র হয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই লোকটা থাকলে ইভান ও সুরক্ষিত থাকবে। ওকে বার বার বের হতে হবে না শেল্টার ছেড়ে। জকি বাড়িতে পৌঁছে আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিল। সত্যি বেশ কিছুদিন পরে আমি আমার ছেলেকে আর জকি কে দেখলাম আমার বাড়িতে। কিন্তু বিপদ তো আনাচে কানাচেই ঘোরা ফেরা করছে। বেশীক্ষণ বাইরে থাকা তো ঠিক না। আমরা সবাই শেল্টার এ ঢুকে পরলাম।
ভিজে কাপড় এর বদলে ইভান কে আর সেই লোক টা কে ক্যারোলের রাখা কিছু জামা প্যান্ট দিলাম। দুজনার ই ফিট হলো না জামা কাপড়। ইভানের বড় হলো ক্যারোলের জামা আর ওই লোকটার ছোট হলো ক্যারোলের জামা। জানতে পারলাম ওই বিশাল দেহী লোকটার নাম লিও টাইন্যান্স। উত্তর ইকারা তে বাড়ি। আমার বাবাকে আর ভাই কে চেনে। আমার মা কেও আগে দেখেছে অনেক বার। ওদের জামা কাপড় দেবার পরে আমি আমার আর মায়ের পোশাক খুঁজলাম অনেক। পুরোন কিছু পোশাক পরেছিল আমার সেটা পরলাম আমি। কিছু না একটা লং স্কার্ট আর একটা ঘরে পরার ইনার। তাও শতছিন্ন সেটা। সেটাই পরে নিলাম। জানি লিও তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে কিন্তু কিছু করার ও নেই। মায়ের জন্য ছিল শুকনো কিছু পোশাক সেটাই দিলাম। সবার সামনেই কাপড় বদলাতে হলো আমাদের কিছু তো করার ছিল না।
তারপরে আমি খাবার খুঁজতে লাগলাম। এখন সবার আগে দরকার খাবার সবার জন্য। অনেকটা শুকনো খাবার আমরা এখানে ফেলে দিয়ে গেছিলাম গত কাল। শেল্টারের মধ্যেই ছিল সেগুলো। প্রাথমিক খাবার হিসাবে আমরা সেই গুলো কে আগে খেলাম তারপরে পিন্টো কে ঘুম পাড়িয়ে ওই শেল্টার এর মধ্যেই বসলাম গোল হয়ে আলোচনায়। ততক্ষণে দেখলাম ইভান আর লিও মিলে সব কটা বন্দুক ষ্টীলের ভারী কিছু ব্লেড বা তলোয়ার আর মোটা মোটা ষ্টীলের ফাঁপা রড এসে শেল্টার এর ভিতরে জড়ো করে ফেলেছে। একটা ব্যাপার তো সবাই বুঝতে পারছি এই অবস্থায় এক সপ্তাহ কাটানো মুখের কথা নয়। সমস্যা অনেক। লিও কথা বলল প্রথম। বলল,
- সবার আগে জোগাড় করতে হবে খাবার।
ইভান বলল,
- ব্ল্যাকের ধারে আছি আমরা। মাছের কোন কমতি হবে না। সেটা আমার দায়িত্ব। ভোর বেলায় খাবার নিয়ে আসা। আমি এই মাছ আর বুনো খরগোশ খেয়েই কাটিয়েছি দুই মাস।
হিসাব করলাম, এক সপ্তাহ আশা করি চলে যাবে। আর যদি ত্রাণ আসে তবে তো কথাই নেই, শুকনো রুটি ও আমরা পেয়ে যাব। ত্রাণ না আসলে ঝামেলা। বললাম,
- না রে কাঁচা মাছ তো খাবি না কেউ। এট লিস্ট পোড়াতে হবে। আমাদের মাছ ছাড়াও ভাবতে হবে আর ও কিছু। আচ্ছা, আর ত্রাণ এদিকে আসবে না তাই না?
লিও বলল,
- আসবে না এ কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ কালকে ট্রেনের উপরে হামলা সবাই জানে। আশা আছে যদি এই ভেবে কেউ ত্রাণ নিয়ে আসে।
লিও কথা বলছিল আমার দিকে তাকিয়েই বলতে গেলে। আরো ভালভাবে বলতে গেলে আমার শতছিন্ন ইনারের দিকে তাকিয়ে। ইনার টা বুকের জায়গা তেই তিন চার জায়গা ছেঁড়া। যতক্ষণ না আমার ভিজে স্কার্ট আর টপ টা শোকাচ্ছে উপায় নেই কোন। এই নজর সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এমন না যে সেটা ইভান বা মা লক্ষ্য করে নি। কিন্তু পরিস্থিতি এমন ই যে কিছু করার নেই। কিন্তু ওর নজরে কেমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। গত দুমাস আমরা স্বামী স্ত্রী তে এই সবে দিকে কোন নজর ই দিই নি। বলা যেতে পারে যেখানে প্রাণের ভয় সর্বদা সেখানে এই সবের দিকে মানুষ নজর দেবেই বা কি করে? কিন্তু লোকটার নজরে কেমন একটা গরল ছিল। বারংবার আমার দিকে তাকিয়ে সেই গরল ঢালছিল আমার শরীরে আর মনে। কালকে ছেলেকে দুধ খাওয়াবার সময়েই আমি বুঝেছিলাম, বোঁটায় যে চিনচিনানি ভাব টা পাচ্ছিলাম সেটা সেই গরলের জন্য। এখনো আমি আবার আমার শতছিন্ন ইনারের ভিতর দিয়ে ঢুকে হালকা ঠাণ্ডা হাওয়ার পেলব স্পর্শ পেলাম মনে হলো। বোঁটার মধ্যে যেন একটা ছোট্ট ছুঁচ কেউ ফুটিয়ে দিল। ইশ কি ভাবছি আমি?
আমি চিরকাল ক্যারোলের হয়ে থেকেছি আর পণ করেছি আমি ক্যারোলের হয়েই থাকব।
ইভানের গলা পেলাম আমি ,
- মা ও মা! কি হলো?
- অ্যাঁ? ক্কি ক্কি হবে?
- উফ তুমি কি শুনছিলে না আমাদের কথা? বললাম আমি আর লিও যাব বাইরে একবার। অনেক দোকান ফাঁকা পরে আছে। খাবার নিয়ে আসব কিছু।
আমি একেবারে হাউমাউ করে তেড়ে গেলাম ইভান কে। বললাম,
- না, তুই গেলে আমিও যাব। তোকে আমি আর একলা ছাড়ব না।
আমার কথা শুনে লিও হেসে উঠল বেশ জোরেই। বলল,
- ওকে ইভান, তুমি মাম্মাস বয়। থাক তোমাকে যেতে হবে না। আমি ই যাই।
লিও র কথা টা ইভান গায়ে নিয়ে নিলো। আর আমি জানতাম সেটা। আমি চিনি ইভান কে। আমার থেকে ভালো ওকে আর কেউ চেনে না। ইভান রেগে গেল আমার উপরে। বলল,
- দেখলে লিও আমাকে ইন্সাল্ট করল কেমন? কেন করো মা এই গুলো? তুমি তো দেখলে তোমার চোখের সামনেই আমি কালকে দুটো ম্যানকুশ কে মারলাম। আর গেলেও তো আমরা একেবারে ভর দুপুরে যাব। তখন ওদের অ্যাটাকের চান্স কম থাকে।
আমি দেখলাম বিপদ। এ ছেলে কিছু ম্যানকুশ কে মেরে একেবারে নিজেকে হী ম্যান ভাবছে। ওকে বললাম,
- না সোনা আমি মোটেই তোকে ইন্সাল্ট করতে কথা টা বলিনি। আমি বললাম আমিও যাব তোর সাথে।
গলা ধরে এলো আমার। কিন্তু থামলাম না আমি,
- তুই জানিস না ইভান , আমি রাতে চোখের দুটো পাতা এক করতে পারিনি কোনদিন। শুধুই মনে হতো তুই কোথায় আছিস। আমি মা তোর। এখানে যতজন আছে কেউ আমার ভালোবাসা টা বুঝবে না। আর সেটা তুই ও বুঝলি না। আমি তোকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারছি না ইভান। তোকে হারাতে আর আমি পারব না।
সবাই চুপ করে গেছে শেল্টার এর ভিতরে। আমিও খানিক চুপ থেকে বললাম,
- বেশ যা। আমি আর তোকে আটকাবো না।
মনে হলো ওকে না ছাড়লে ইকারা ছেলেদের মতই ওর ইগো হার্ট হবে। কিন্তু ইভান কোন কথা বলল না। আমার মা ইভানের মাথায় হাত বোলাচ্ছিল তখন ওকে শান্ত করতে। আর আমার চোখে জল। লিও র কাছে এই সব ইমোশনের আর কোন দাম নেই। ও সবাই কে হারিয়েছে। সবাই কে হারালে মনের মধ্যে যে কর্কশতার জন্ম নেয় সেইটা তে ও এখন বিচরণ করছে। তাছিল্যের একটা হাসি হাসল আর বসে পরল শেল্টার এর সেই জায়গায় যেখানে ক্যারোল বসত।
আমি বসে ছিলাম চুপ করে পিন্টো কে কোলে নিয়ে। পিন্টো ঘুমোচ্ছিলো তখন। ইভান বেশ কিছুক্ষণ রাগে ফোঁস ফোঁস করল। তারপরে উঠে এসে বসল আমার কাছে। আমার পাশে। জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমার চোখে তখনো জল ছিল। ইভান মুছিয়ে দিয়ে বলল,
- বেশ আর কষ্ট পেও না। আমি যাব না।
কথা টা শেষ ও হলো না, শেল্টারের দরজা থেকে বেশ জোরে হেসে উঠলো লিও। এমন হাসি যেন ও জানত শেষ মেষ এটাই হবে যে ইভান কে আমি ছাড়ব না। নাহ লোকটা ঠিক লোক না। ইচ্ছে তো করছে বলে দি,
- তুমি যাও দেখি বাপু এখান থেকে। অন্য জায়গায় নিজের শেল্টার দেখে নাও। মা ছেলের মধ্যে ঝামেলা বাড়িও না।
কিন্তু বলতে পারলাম না আমি। আমার মানবিকতা সেটা বলতে দিল না আমাকে। রাগ তো হচ্ছে আমার খুব লিওর উপরে। কিন্তু আমি মা। এই সব রাগের পাত্তা দিলে ছেলে কে সেই চৌদ্দ বছরে গাড়ী নিয়ে ছেড়ে দিতে হত। আমি ইভান কে বললাম,
- বেশ তুই যাবি। কিন্তু আমাকে কথা দে তুই অক্ষত ভাবে ফিরে আসবি। দশ টা পিশাচ মেরেছিস বলে সামান্য ও অসতর্ক হবি না। আমার গা ছুঁয়ে কথা দিলে তবেই আমি ছাড়ব না হলে নয়। এই বারে তোর কিছু হলে কিন্তু আমি আর বাঁচব না ইভান , এই আমি বলে দিলাম।
কথা টা বলেই আমি চোখের জল আটকাতে উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ইভান হয়ত প্রথমে অবাক হলেও ওর হাসি ফিরে এল। সেটা আমি বুঝলাম যখন আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে ঘেঁটে দিল তখনি। আমি বললাম,
- উফ কি করছিস? যেই ছেড়ে দিলাম অমনি মা ভালো হয়ে গেল খুব তাই না? কথা দে কিন্তু আগে। পরের সপ্তাহে আটলান্টা তে ফিরে গিয়ে তোকে তোর বাবার হাতে দিয়ে তবে আমার শান্তি।
ইভানের আমাকে বেশ করে জড়িয়ে ধরা শেষ হলে খানিক আমাকে দেখে আমাকে আবার জাপটে ধরল। আর বলল,
- আচ্ছা বাবা এই নাও কথা দিলাম। আমি অক্ষত ফিরে আসব। এবারে চোখের জল মোছ দেখি।
তারপরে লিও র দিকে তাকালো ইভান। আর বলল,
- লিও চল কিছু প্রিপারেশন নিতে হবে। জকি তুই আগে যাবি।
আমিও বললাম,
- ইভান কথা দিয়েছিস আমাকে তুই। মনে রাখবি কিন্তু।
জকিও ইভানের ইশারা পেয়ে শেল্টারের ভিতরেই খানিক ডেকে উঠল তারস্বরে।
ওরা গেলো দুপুরে। ওই এগারো টা নাগাদ। আমার ভিতরে কি চলছিল আমি সেটা জানি। যতক্ষণ না ওরা এল আমি বসতে পারছিলাম না, না দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম। আসলে ভরসা না থাকলে তাই হয়। ছোট্ট ছেলেটা যখন হাঁটতে শেখে তখন মা তার পিছন পিছন ই যায়। পরে তাকে ছেড়ে দেয় বাইরে। মা পাখী ও সেই থিয়োরী ফলো করে। কিন্তু এই রকম দুই তিন বার যখন দেখলাম ইভান গেল আর ফিরে এলো তখন আমার মধ্যে সেই আগের চিন্তা টা হতো না। কিন্তু কোন ভাবে সামান্য দেরী করে ফিরলেও তখন মনে হতো বুকের মধ্যে কেউ হাতুরী পেটাচ্ছে।
ধীরে ধীরে সব কিছুই অভ্যেস হয়ে যায়। আমরা যেমন জেনে গেছি যে সকালের কিছু সময় ওরা একদম বের হয় না। সেটা আমাদের ইভান ই বলল। আমরা রোজকার কাজ কর্ম করার জন্য রাত আর সকালের মাঝের তিরিশ চল্লিশ মিনিট ব্যবহার করতে শুরু করলাম। বলতে গেলে শুয়ে পরতাম সন্ধ্যে বেলা তেই আর খুব ভোর বেলায় উঠে স্নান করা, কাচাকুচি করা এই গুলো কে করে ফেলতাম। ওই ভোরেই লিও আর ইভান বের হয়ে যেত জিনিস পত্র আনতে। ইকারার সব দোকান ই খোলা।খোলা মানে দোকানের মালিক আর বেঁচে নেই। শুধু মালিক কেন? ইকারা তে আমরা পাঁচ জন আর জকি ছাড়া কোন জীবন্ত মানুষ আর নেই। আমাদের সময়পঞ্জী ই বদলে গেলো। ভোর থাকতে ঘুম থেকে উঠে পরা আর সন্ধ্যে বেলায় খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরতাম। আর সন্ধ্যে বেলা হবার সাথে সাথেই শয়তান গুলোর আমাদের শেল্টার এর আশে পাশে ঘুরে বেরানোর আওয়াজ। শেল্টার টা চিরে ফেলে আমাদের শেষ করে দেবার আকিঞ্চন। থম হয়ে বসে থাকতাম আমরা সবাই।
ভোর বেলায় বেরিয়ে প্রয়োজন মতন জামা কাপড়, এমুনেশন, ব্যাটারী নিয়ে আসত ওরা। আমরা দুটো শেল্টার কেই বাগিয়ে ফেললাম। ইভানের শেল্টারে একটা খাট ছিল। ওখানে লিও আর ইভান শুতো। আর আমি মা আর পিন্টো শুতাম আমাদের সাইক্লোন শেল্টার এ যেটা এতোদিন আমরা ব্যবহার করে আসছিলাম। আর জকি থাকত কোনদিন আমাদের কাছে বা কোনদিন ইভানের সাথে।
দিন তিনেক পরে মানে মঙ্গল বার নাগাদ একবার রেডিও চালালাম আমি। কারণ শুক্রবারের ট্রেন দিচ্ছে কিনা বা দিলেও কখন দিচ্ছে সেই সব তথ্য জানার ছিল আমাদের। রেডিও খুলেই রাখি আটলানার ওয়েভ্লেন্থ এ। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। ইভান বা লিও বলে,
- হয়ত রেডিয়ো চালানোর মতন কেউ নেই আর।
ভয় লাগে আমার সেই সব শুনে। কারণ এই কিছুদিন আমি ক্যারোল মালিয়া আর কীটের কোন খবর ই পাই নি। মনের মধ্যে ভয় দানা বাঁধল মারাত্মক। বুঝতে পারিনি আমার ভয় টা এমন ভাবে সত্যি তে পরিনত হবে। আমি সারা দিনে রেডিয়োর কোন সাড়া পেতাম না বলে ভোরে রেডিয়ো খোলা চালু করলাম। আমি আর মা বাইরে কাজ করতাম আর রেডিয়ো চলত। লিও আর ইভান বাইরে বের হত কোনদিন দরকারে আর না হলে বাড়িতেই থাকত। আমরা সবাই কান খাড়া করে থাকতাম যদি রেডিয়ো তে কেউ কিছু বলে। আমি শুনতে চাইতাম ট্রেনের খবর। মনে হতো কবে আমরা যাব আটলানা তে।
ইতিমধ্যে ইভান একটা কাজ করল। ও আমাদের ভেঙ্গে যাওয়া বাড়ির লোহার পাইপ দিয়ে যে পিলার বানানো ছিল সেই গুলো পুঁতে ফেলল বাড়ির চারিদিকে। প্রায় গোটা দশেক। নানান জায়গায়। তারপরে এক ভোর বেলায় বেড়িয়ে দেখলাম কোথা থেকে একটা গাড়ী জোগাড় করে অনেক গুলো এখানের গীর্জার ঘন্টা নিয়ে এসেছে। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ওর কান্ড। আমি সবার জামাকাপড় কাচছিলাম। লিওর ও কেচে দি। সেও ও ইভানের সাথে ছায়ার মতন লেগে থাকে। ধীরে ধীরে লিওর নজর আর লিওর সাথে আমাদের একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্যারোলের অনুপস্থিতি তে, ইভানের পরে আমি লিও র উপরে ভরসা করতে শুরু করেছিলাম তার কারণ ও ছিল একটা। বলছি সেটা পরে।
আমরা সবাই দেখলাম ইভান আর লিও মিলে সেই বড় বড় গীর্জার ঘন্টা গুলো কে শক্ত করে, পুঁতে ফেলা লোহার পিলার গুলোর মাথায় বেঁধে ফেলল। আর সরু কিছু দড়ি ওই ঘন্টার মুখে বেঁধে ছড়িয়ে রেখে দিল চারিদিকে। আমি জিজ্ঞাসা করতেই লিও বলল,
- লিরা তোমার ছেলে মনে হয় এই শয়তান গুলো কে মারতেই জন্মেছে।
আমি বললাম ,
- কেন কি হলো?
- না গত দুদিন বাইরে বেড়িয়ে দুটো কে তো আমার সামনেই মেরেছে আমি দেখেছি। আজকে এই ঘন্টা লাগালো, নিশ্চই ওদের মারার কোন প্ল্যান হবে।
তখন ইভান হেসে আমার কাছে এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
- দেখ এই ঘন্টা গুলো কে বাঁধলাম, তার কারণ হলো, ওরা এই আওয়াজ নিতে পারে না। এতে আমরা একটু সময় পেয়ে যাব শেল্টারে ঢুকে পড়ার।
আমি বললাম অবাক হয়ে,
- কি করে?
ও এগিয়ে গিয়ে ঘন্টা গুলো কে নড়িয়ে হালকা হালকা আওয়াজ বের করল। তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
- আমি দেখেছি, আমি যখন একলা থাকতাম, দেখতাম, আশে পাশে ম্যানকুশ থাকলেই জকি আমাকে সাবধান করে দিত। আর আমি দুটো রড কে বাজাতাম অনবরত। এতে ওদের মনে হয় স্নায়ু অবশ হয়ে যায়। আর কোন আওয়াজে হয় না, শধু এই রকম গম্ভীর আওয়াজ যেটা লোহাতে লোহাতে আঘাতে উতপন্ন হয়। ওরা বসে পরে তখন। আর আমার গুলি চালাতে কত সময় লাগত
- তারপরে?লিও বলল,
- কিন্তু আমি গুলি চালিয়েছি। ওরা খুব ফাস্ট, গুলি চালানোর আগেই সরে পরে। আর মাথায় গুলি করলেও ওরা মরে না।
- হ্যাঁ ওদের মাথায় হেলমেট থাকে। সব সময়ে মাথায় আঘাত করলে ওরা মরে না। কিন্তু ওদের হাত আর পা মারাত্মক শক্তিশালী। তোমাদের বলে রাখি ওদের বুক আর পেটের জায়গা একেবারে থলথলে কিছু জিনিস দিয়ে তৈরি। আর হাত পা লম্বা বলে ওরা ঐ দুটো জায়গা গার্ড করে রাখে। বা আঘাতের উৎসস্থলে তীব্র গতি তে আক্রমণ করে সেই উৎস কে নষ্ট করে। এই আওয়াজে যেই ওরা অবশ হয়ে যায় তখন ই আঘাত হানতে হবে। না হলে মারা পরতে হবে। জল আর এই আওয়াজ, এই দুটো তে কিছু সময় পাওয়া যাবে।
লিও বলল আবার,
- কিন্তু ঘন্টা গুলো বাজাবে কে?
ইভান হাসল, বলল,
- দেখ লিও, তুমি ওদের চলা ফেরা দেখনি ঠিক করে, ওরা যখন চলে দুটো হাত পা কে অনেক টা ছড়িয়ে চলে মনে হবে কোন বাচ্চা পাখী সবে চলতে শিখেছে। ওরা যত বেশী জোরে দৌড়োয় ওরা তত সরু করে নেয় নিজেদের। আর সেই কারণে আমি পিলার গুলো কে ইট গাথার মতন পুঁতেছি। ওরা হেঁটে আসলেও পিলারে আঘাত করবে আর দৌড়ে আসলে পাশাপাশি থাকা দুটো পিলার কে এড়িয়ে গেলেও সামনের মাঝের পিলার টা এড়িয়ে যেতে পারবে না।
লিও ইম্প্রেসড হলো। বলল,
- দারুণ ইভান!
ইভান হেসে বলল,
- এটাই শেষ নয় লিও, এই দেখ আমি বেশ কিছু স্লিং শট নিয়ে এসেছি। যাকে বলে গুলতি। উঠোনে অনেক ছোট বড় নুড়ি পরে আছে। একটা কুড়িয়ে নিয়ে ঘন্টায় আঘাত করলেই হলো। এই দেখ লিও।
এই বলে একটা নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে দুরের একটা ঘন্টার দিকে ছুঁড়ল ইভান। ঘন্টার সাথে আঘাত পেয়ে আওয়াজ উঠলো
ঢং
আমি দেখছিলাম ইভান কে। সেই ছেলেটা আমার। ওকে আমি বাচ্চাদের মতন ট্রিট করি বলে মুখ ভার করে থাকত। আর এখন? সত্যি কেমন বড় হয়ে গেল ছেলেটা। এই দুমাসে মৃত্যুর সাথে যুঝতে যুঝতে যেন কঠিন হয়ে গেছে ছেলেটা। হলুদ চুল লম্বা হয়ে ঝাঁকড়া হয়ে আছে মাথায়। গালে হলুদ দাড়ি বেরিয়েছে অল্প অল্প। লম্বা হয়েছে বেশ। আর এই দুইমাসে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে গায়ে হাতে পায়ের সেই নমনীয়তা আর নেই। চলবে............