ট্যাবু ১ - নিজেরে হারায়ে খুঁজি - নতুন পর্ব ছয় - পেইজ পনেরো - অধ্যায় ৩
নিজেরে হারায়ে খুঁজি
অধ্যায় ১
পর্ব ১
সময় টা হলো ২৩৫০ সাল। হ্যাঁ ঠিক ই শুনেছেন। ২৩৫০ সাল। আমরা আছি এখন ট্রিভিয়া আইল্যান্ড এর অন্তর্গত ইকারা নগরে। ট্রিভিয়া একটা দারুণ দেশ। খুব বড় না কিন্তু উন্নত দেশ। আমরা বাদামী চামড়ার। বস্তুত ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গম স্থলে এই আইল্যান্ড। এই ইকারা হলো ট্রিভিয়ার রাজধানী। হ্যাঁ ট্রিভিয়া প্রধান শহর হলেও রাজধানী হলো ইকারা। এমন কি ইকারা ট্রিভিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও নয়। ট্রিভিয়ার পরে, আটলানা আছে, সোমারা আছে, পিনারা আছে। এমন আর ও গোটা ছয়েক নগরীর পরে আয়তনের দিক থেকে এই ইকারা নগরী। সামনেই আছে আটলানা নগর এ অঞ্চলের সব থেকে বড় নগর। কিন্তু তা স্বত্বেও ইকারাই হলো এখানের রাজধানী। ইতিহাস অনেক কথাই বলে। বলে এই ইকারা দুবার পরাধীন হয়েছিল। শুধু ইকারা নয় সমগ্র ট্রিভিয়া দু দুবার পরাধীন হয়েছিল। পাঁচশ বছর আগে ইকারা থেকে বিদায় নেয় ইংরেজ রা। আর আজ থেকে সারে তিনশ বছর আগে ইকারা থেকে বিদায় নেয় ম্যানকুশ। শোনা যায় ভয়ঙ্কর এই আক্রমণে সমগ্র ট্রিভিয়া মানব শূন্য হয়ে গেছিল। আর যে গুটি কয় ইকারা বাসী দাঁতে দাঁত চেপে এই লড়াই এ জয় লাভ করেছিলেন, সেই ইকারাবাসী দের সৌজন্যে, আবার ইকারা তথা ট্রিভিয়া আবার স্বাধীন হয়। সেই সম্মানের জন্য ইকারাই এখানে রাজধানী।
এই হেন বিখ্যাত ইকারা শহরে এসেছে, ব্রুনো ফ্যামিলির সব থেকে সুন্দরী আর কনিষ্ঠা সদস্যা কিয়ারা ব্রুনো। থাকে ট্রিভিয়া তে। হলুদ চুল আর নীল চোখের মালকিন কিয়ারা যে অসাধারণ সুন্দরী সেই নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। পড়াশোনা করে ট্রিভিয়া তে। মেডিকেল পড়ছে। গত বেশ কিছু শতাব্দীতে এই পরিবারের জন্য সমস্ত সরকারী সাহায্য বরাদ্দ থাকে। তাতে সেটা পড়াশোনা হোক বা অন্য কিছু। কিয়ারা ব্রুনোর বাবা, স্যাম ব্রুনো। এখানের উচ্চ শিক্ষিত একজন। বিশাল বড় বাড়ি ব্ল্যাক লেকের ধারে স্যাম ব্রুনো দের। তিনতলা প্রাসাদের মতন বাড়িতে কিছু না হলেও তিরিশ টার উপরে ঘর হবেই। বাড়ির পিছন দিকে ব্ল্যাক লেক। সেই লেকের ধারে পুরোন অনেক কিছুই আছে। কিয়ারার ভাল লাগে সেই জায়গা টা। তাই এখানে আসলেই ও চলে আসে ব্ল্যাকের ধারে দুটো বিশাল বিশাল ওয়াগন রাখা আছে সেখানে।
এই জায়গা টা বেশ ফাঁকা। বিশাল বাড়ির পিছনে অনেক টা নুড়ি পাথরে ঢাকা এই জায়গা। বড় বড় গাছ আছে অনেক এদিকে। আছে ব্ল্যাকের ধারে দুটো দোলনা। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই। এখানেই খাবার চাইলে আসতে পাঁচ মিনিট সময় লাগে মাত্র। তাই বলতে গেলে পুরো দিন টাই কিয়ারা থাকে এই জায়গায়। দুটো বিশাল বিশাল ওয়াগন আছে রেলের। দেখেই মনে হয় বিশাল পুরোন। কারণ এখন আর এই রকম ষ্টীলের ওয়াগন তৈরি হয় না। এখন মারাত্মক টেকসই, কার্বন পলিমারের হালকা ওয়াগন তৈরি হয়। কিন্তু কিয়ারার ইন্টারেস্ট যে ওয়াগন দুটো তে সেই দুটো ওয়াগন ই বন্ধ থাকে সারাক্ষণ।
ওদের বাড়ি তে কাজ করে রিলিয়া। রিলিয়া মাঝে মাঝে গল্প বলে ওকে এই ওয়াগনের গল্প, কি করে এই ওয়াগন এলো তার গল্প। এই ওয়াগনের সাথে সম্পর্কিত গল্প রিলিয়া অনেক জানে। আসলে রিলিয়া বলতে গেলে কিয়ারার দাদুর বয়সী হবে। কিয়ারা কে খুব ভালো বাসে। মায়ের থেকে বেশী কিয়ারা রিলিয়ার সাথে থাকে এখানে আসলে। কিয়ারার এই কুড়ি বছরের জীবনে মনে হয় না রিলিয়া ছাড়া এখানে আসলে ওকে কেউ খাইয়েছে বলে। ও রিলিয়া না থাকলে মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ায়। মায়ের থেকেই বেশী রিলিয়া ওর কাছে। সেই কিয়ারা আজকে রিলিয়ার কাছেও না খাবার পন করেছে। কে বলবে কিয়ারা একটা কুড়ি বছরের মেয়ে। রিলিয়া ওকে এমন ভাবে ট্রিট করে যেন কিয়ারা একটা দশ বছরের মেয়ে। বেচারী রিলিয়া, বয়েস হয়েছে, আর কি পারে?
- স্টপ বেবি, খেয়ে নাও প্লিস।
- না খাবো না। ইউ হ্যাভন্ট কেপ্ট ইয়োর ওয়ার্ড।
- উফ আবার কি করলাম বেবি? আচ্ছা আমার কি বয়েস হয় নি? তুমি এমনি করে দৌড়লে আমি কি করি?
- তাহলে, কেন কথা রাখছ না তুমি, মম্মা।
রিলিয়া কে কিয়ায়া মম্মা বললে খুব খুশী হয়। ওদের বাড়িতেও কোন আপত্তি থাকে না এর জন্য। ওদের দুজনের বন্ড টা বাড়ির সবাই খুব এনজয় করে। যদিও রিলিয়া ব্রুনো দের ই একজন। কিন্তু কপালের ফেরে এখন কাজ করছে এই ব্রুনো দের বাড়িতে। যদিও মনে হয় কিয়ারা ওকে যা ভালোবাসে তাতে রিলিয়া কাজ না করলেও কিয়ারার জন্য সব কিছুই করতে পারত। মম্মা শুনে খানিক খুশী হয়ে রিলিয়া বলল,
- বুঝেছি, ওয়াগন দুটোর চাবি চাই তো।
নিজের চোখ দুটো বুজে নিজের খুশী টা বুঝিয়ে দিল কিয়ারা একবার নেচে উঠে। বলল,
- ইয়েস মম্মা।
- বেশ তবে খেয়ে নাও তুমি। আমি চাবি দেব। তবে কথা দাও বেশীক্ষণ থাকবে না।
- কেন মম্মা?
- কারণ হলো অনেক পুরোনো বেবি ওটা। ওটা বন্ধ আছে বেশ অনেক বছর। তুমি শুধু দেখেই আবার চাবি আমাকে ফেরত দেবে কেমন?
- ওকে থ্যাঙ্কস মম্মা।
এই বলে আনন্দের আতিশায্যে বৃদ্ধা রিলিয়া কে একটা চুমু খেয়ে, খাবার খেয়ে নিল কিয়ারা। তারপরে চাবি নিয়ে সোজা ওয়াগনের কাছে।
- ওয়াও!!!!!!
কিয়ারার মনে হলো কোন ঐতিহাসিক ঘরে প্রবেশ করেছে সে। ভিতর টা কেমন একটা বোটকা ঐতিহাসিক গন্ধ। বোঝাই যাচ্ছে এই ওয়াগন এ প্রবেশ হয় নি না জানি কত কাল। তন্ন তন্ন করে পুরো ওয়াগন টা দেখল কিয়ারা। কিছুই পেল না, সব ধুলো তে ভর্তি। হয়ত ছিল কিছু, এখন কালের নিয়মে সব ধুলো হয়ে গেছে। দেখল সেই ওয়াগনের ফ্লোর টা একটা জায়গায় গোল করে কাটার চেষ্টা হয়েছে। আর একদিকে প্রায় কোনে বাথরুমের সেট আপ করা। কিছুই আর তার অবশিষ্ট নেই। কিন্তু কমোডের নীচের অংশ টা বোঝা যাচ্ছে। ওর মনে হলো তখন কার দিনে লোক জনে হয়ত এমন ওয়াগনেই থাকত। পরক্ষণেই ভাবল, না না তা কি করে হয়, তবে তো এমন ওয়াগন অনেক থাকত।
ও দেখল ওয়াগনের ভিতর দিক টা টোল খাওয়া। ঠিক মনে হচ্ছে বাইরে থেকে কোন বুল ডোজার দিয়ে জায়গায় জায়গায় আঘাত করে টোল টা খাওয়ানো হয়েছে। ওয়াগনের দেওয়ালের নীচে একটা লোহার ফুট দুয়েক লম্বা ব্লেড পরে আছে। অবাক হলো ব্লেডে মরচে পরে নি সামান্য।
নাহ আর দেখার কিছু নেই এখানে। ও চাবি নিয়ে পরের ওয়াগন টা খুলল। এখানেও একি রকম গন্ধ। তবে এই ঘরে কিছু আছে। একটা লোহার খাট ছিল তার চারটে পা ই রয়েছে মাত্র অবশিষ্ট। একটা লোহার র্যাক ছিল। সেটাও ভেঙ্গে গেছে। একটা লোহার ট্রাঙ্ক রয়েছে পাশেই। চাবি নেই তাতে। ও খুব কষ্ট করে ঢাকনা খুলে দেখল ভিতরে লোহার বন্দুক আছে কিছু। কিন্তু সেগুলোতে মাটি ধরে গেছে। অনেক গুলো ছোট বড় নানা রকমের বন্দুক ছিল সেখানে। ও বন্দুক গুলো কে তুলে তুলে দেখছিল তলায় কি আছে। কিছু নেই দেখে বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু একেবারে তলায় একটা বাদামী কিছু দেখে আবার খুলে, বন্দুক সরিয়ে সেটা বের করে আনল। বাবাহ কি ভারী। দেখল দেড় ফুট লম্বা আর প্রায় ফুট খানেক চওড়া, একটা ডায়রি। পাতা গুলো না জানি কীসের। শক্ত আর এতো পরেও কোন বিকৃতি হয় নি। হবে কোন পলিমার এর। উপরের মলাট টা চামড়ার। হবে হয়ত কোন পশুর চামড়া বা অন্য কোন রকম পলিমার যা তখন ছিল। কোন সালের দেখতে গিয়ে দেখল প্রথম পাতায় ঝরঝরে হাতের লেখায় লেখা আছে
নিজেরে হারায়ে খুঁজি
১৯৯২ সাল
লিরা ব্রুনো।
একজন মা, একজন স্ত্রী, সর্বোপরি একজন নারী
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল কিয়ারার। লেখা টা পড়ছিল আর ভাবছিল,
তার মানে আমার কাছে তিনশো র ও বেশী পুরোন বছরের একটা লেখা আছে? ওয়াও, ছুটি টা বেশ ভালোই কাটোবে তাহলে।
এখন তো বই পত্র আর পাওয়া যায় না। সব ই গেজেটের কামাল। এখন থ্রী ডি গেজেট। বই চাইলে সামনে বিশাল হয়ে থ্রী ডি তে লেখা ফুটে উঠবে নিজের কাছে। বাস একটা স্পেকস পরতে হবে মাত্র। সেটা যদি নিজের কোন স্পেকস থাকে তার সাথে সিঙ্ক ও করে নেওয়া যায়। কিন্তু এমন ভাবে হাতে লেখা জিনিস পড়ে আনন্দই আলাদা। ও বই টা নিয়ে চাবি দিয়ে সোজা নিজের ঘরে। আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। জানালার ধারের টেবিল এ বসে পরল বই টা খুলে। শুরু করল পড়া।
শুরু
“ আটলান্টিস পাহাড় থেকে আনুমানিক তিরিশ কিমি হবে আমাদের গ্রাম টা। সমতল। গ্রাম বলা ঠিক হবে না আধা শহর। ট্রেন যোগাযোগ বেশ ভাল। পর্বতে ঘুরতে যাওয়া পথিক দের সর্বশেষ সমতল স্টেশন, ইকারা। হ্যাঁ আমাদের শহরের নাম ইকারা। মাঝারী মাপের শহর। ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ স্থলে অবস্থিত ট্রিভিয়া আইল্যান্ড এবং দেশের অন্তর্গত আমাদের রাজধানি ট্রিভিয়া থেকে আনুমানিক দেড়শ কিমি দূরে আমাদের এই শহর। হ্যাঁ আপনারা এই দেশের নাম শোনেন নি হয়ত। কিন্তু বেশ উন্নত এই দেশ। চারদিকে সমুদ্র এবং এই আটলান্টিস পর্বতের দেশ ট্রিভিয়া বিদেশী পর্যটক দের কাছেও বেশ আকর্ষনীয়। কিন্তু আমাদের এখান থেকে পর্বত বেশ কাছে। সমুদ্র খুব কম হলেও পঞ্চাশ কিমি দক্ষিনে। গেছি এক দুবার ক্যারোল আর আমার সন্তান দের নিয়ে। এখানে বেশ কয়েক টি সরকারী কলেজ আর কলেজ রয়েছে। ট্রিভিয়া ইউনিভার্সিটির অন্তর্গত এখান কার কলেজ গুলো। বেশ ফাঁকা আমাদের শহর। মূলত আটলান্টিস হাইওয়ের দুই ধারে গড়ে উঠেছে আমাদের শহর। লম্বায় প্রায় আট কিমি আর হাই ওয়ের উভয় দিকে চার কিমি করে শহরের ব্যাপ্তি। আটলান্টিস পূর্ব দিকে আমাদের। ভোর বেলায় পর্বতের ফাঁকে সুর্য্যোদয় দেখার সৌভাগ্য ইকারা বাসী দের কপালেই ভগবান লিখে রেখেছেন।
শহর হলেও বেশ ফাঁকা শহর। প্রতি বাড়িতে বেশ অনেক টা করে জায়গা। শহর হলেও এখানে লোকেদের জীবিকা মূলত চাষবাস আর মাছ। অফিস আদালত ইকারা তে নেই। কিন্তু আটলান্টিস এ আছে। আটলান্টার পেডীমেন্ট এ বিশাল শহর আটলান্টিস। সেখানেই অফিস আদালত ইউনিভারসিটি আর এমপ্লয়মেন্ট এর মূল আকর্ষণ। তবে ইকারা বাসী রা চাকরী করতে পছন্দ করে না। মূলত চাষবাস, মাছের ব্যবসা না হলে অন্যকিছুর ব্যবসা। মোটেল, অন শপ বার, গ্যারেজ এই নিয়েই ইকারা বাসীরা আছে। তবে কলেজ কলেজের কমতি নেই এখানে। প্রায় দশ টা সরকারী হাই/জুনিয়র কলেজ আর গোটা তিনেক কলেজ আছে। শুধু ইকারা বাসী রাই নয়, অনেক আটলানা রাও এখানে পড়তে আসে কলেজে। তবে টিচার সব বাইরের। কারণ ইকারা বাসী রা প্রয়োজনের বেশী পড়াশোনা করে না। কাজেই ইকারা থেকে কেউ টিচার হবে সরকারী কলেজে, আমার জন্মে তো এমন ঘটনা ঘটে নি।
মারাত্মক বৃস্টি প্রবন এলাকা। ছয় মাস খুব বৃস্টি হয়। তার মধ্যে তিন মাস সুর্য দেখতে পাই না আমরা। জল দাঁড়ায় না শহরে কোন ভাবেই। শহরের ঢাল পশ্চিম দিকে আমাদের। শহরের উত্তর দক্ষিনে ঘন জঙ্গল। উত্তরে জঙ্গল শুরুর আগে , চাষের জমি ভেদ করে আটলান্টিস হাইওয়ের বাইপাস আর আমাদের রেলওয়ে স্টেশন। আরো কিছু টা চাষ যোগ্য জমি ছাড়িয়ে শুরু হয়েছে আটলান্টিস জঙ্গলের উত্তর ভাগ। আর দক্ষিনে শহরের পিছনে আছে বিশাল ব্ল্যাক লেক। লেকের দক্ষিনে শুরু হয়েছে আটালান্টিস জঙ্গল। দেখতে গেলে, জঙ্গলের মাঝে আমাদের এই শহর টা। চারিদিকে জঙ্গল না হলে আটলান্টিসের অংশ আর ঠিক মাঝে আমাদের ছোট্ট শহর টা।
লেক টাও বেশ দর্শনীয় জায়গা আমাদের। পুরো লেকের জল কালো। তবে জল খারাপ না।অতিরিক্ত লোহা এবং কালো পাথর থাকার কারনে জলের রং কালো লাগে উপর থেকে। বাকেটে তুললে ঝকঝকে পরিষ্কার। পুরো শহর কেই মাছের এবং খাবার জলের যোগান দেয় এই লেক। বিশাল লেক। শহরের দু গুন বললেও অত্যুক্তি হয় না। আমার বাড়ি ব্ল্যাকের ধারেই। বিকালে উন্মত্ত হাওয়ায় দাঁড়িয়ে সামনে ব্ল্যাকের দিকে তাকালে মনে কালো জলে ডাক দেয় আমাকে। বলে আয় আয়।
শহরের মানুষ গুলো ভাল। এখনো নগরের ছোঁয়া লাগে নি। সবাই মিলে মিলে মিশে থাকতে ভালবাসে। চুরি ডাকাতি নেই। পুলিশ চৌকি আছে একটা। তবে ওদের মধ্যে কোন রকম ব্যস্ততা নেই। ওরা ওদের মতন আমরা আমাদের মতন। মাঝে মাঝে রাতের বেলায় পুলিশের হুইসেল শুনতে পাই বটে। কিন্তু বিপদের নয়, শান্তির। যেন বলে “ ঘুমাও আমরা আছি”। ছোট এক বছরের ছেলেকে একবার হাত দিয়ে দেখে নিয়ে, পাশে শুয়ে থাকা স্বামীর বুকে ঢুকে শুয়ে পরি আমি। “
এতো দূর পড়ে কিয়ারা ভাবল,
বাহ কি সুন্দর ঝরঝরে ভাষা। অনাবিল আনন্দে লিখেছেন মহিলা। মনে মনে কল্পনা করে নিল আজ থেকে তিনশো বছর আগের ইকারা কে। রোমাঞ্চিত হলো কিয়ারা। ব্রুনো পরিবারের ইতিহাস হয়ত সে পড়তে পারবে। সামনেঅ্যাঁর দিকে তাকিয়ে দেখল ব্ল্যাকের কালো জল এখনো রয়েছে। হয়তো ওই ব্ল্যাকের কালো জলের ধারে কোন একটা ওয়াগনে বসেই মহিলা লিখেছিলেন এই ডায়রি। না তবে ডায়রি নয় এটা। ডায়রি হলে ডেট দিয়ে প্রতিদিনের কথা লেখা থাকত। আবার নাম দিয়েছেন এই লেখার। নিজেরে হারায়ে খুঁজি।
ও আর সময় নষ্ট করল না। নিজেকে ডুবিয়ে দিলো সামনের লেখার ভিতরে।
“আমি লিরা ব্রুনো। এই কাহিনী লেখার কারণ যেটা, সেই কারণে পৌঁছতে পৌঁছতে আমি ততদিনে ৩৫ বছরের একজন মহিলা। মাঝারী গড়নের আর ইকারা মেয়েদের তুলনায় একটু বেঁটে। সাকুল্যে পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি আমি। বেশ ফরসা আমি। হলুদ ঈষৎ কোঁকড়া চুল কোমর অব্দি। নীল চোখ। কাজ করি একটা ডে বার এ। আমার স্বামী ক্যারল ব্রুনো আর তার চার সন্তানের মা আমি। শরীর আকর্ষনীয়। কোমর বেশ সরু। বুক শরীরের তুলনায় বেশ বড়। পাছা সেই অনুযায়ী তেমন কিছু বড় নয় আমার। বলতে গেলে বেশ ফিট আমি। সংসারের কাজের সাথে পয়সা রোজগার করেও আমি ক্লান্ত হই না তেমন। ঈশ্বর যেন আমাকে এমনি রেখে দেন যত দিন না আমার সন্তনেরা বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে“
আবার থামল কিয়ারা।কাহিনীতে বর্ণিত রূপের সাথে নিজেকে তূলনা করে দেখল, কিয়ারা এই মহিলার তূলনায় রূপে কিছুই নয়। মনে মনে ভাবল ইশ এই মহিলার মতন তার রূপ যদি এমন হতো কি ভালই না হতো। হলুদ ঢেউ খেলানো চুল আর নীল চোখ ছাড়া কিছুই মিলল না এই মহিলার সাথে। ও আবার পড়তে শুরু করল।
“ সেই কোন ছোট বেলায় হাইকলেজে পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে যায় ক্যারোল এর সাথে। আমি তখন ষোল বছরের। প্রেম তো ছিলই। ক্যারোল তখন ২২ মাত্র। সবে একটা ফুড শপ এ ৫ পারসেন্ট শেয়ার নিয়েছিল, নিজের কাছে যা ছিল সব দিয়েই। আর সেখানে জব ও করত ও। তাতেই ওনার প্রেম একেবারে মারাত্মক আকার ধারন করেছিল। সেই বছর নিউ ইয়ারের সময়ে একটা দিন ওর সাথে কাটানোর ফসল হিসাবে আমার বড় ছেলে ইভান পেটে এসেছিল আমার। আর সেই জন্যেই সেই বছরেই তিন মাসের মধ্যে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। তার পরে এক এক করে, মালিয়া, কিট আর সব থেকে ছোট পিন্টো জন্ম নেয়। ইভান সতের এখন ,মালিয়া এখন তেরো , কিট সাত আর পিন্টো এখন এক বছরের। বলতে গেলে চার সন্তান ,আমার প্রিয় মানুষ টা আর একটা পোষ্য় নিয়ে আমার ভরা সংসার এখন।
তারপরে অনেক সময় বয়ে গেছে। উন্নত হয়েছি আমরা। কম্পুটার এসেছে। মোবাইল এসেছে। যদিও এদিকে এখনো তেমন ভাবে মোবাইল এর ব্যবহার শুরু হয়ে নি। টিভি এসেছে সব দারুণ দারুণ। আমাদের বাড়িতে আছে এমন একটা টিভি। ক্যারোল কেনার পক্ষপাতী ছিল না। কিন্তু আমি মালিয়া আর ইভান বলে বলে টিভি টা কিনিয়েছি। এ ছাড়াও পুরোন রেডিও আছে আমাদের বাড়িতে কিন্তু বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের মতন তাকে যত্ন করে তোলা আছে।
আটলান্টিসে আরো কত হাজার সুর্যোদয় হয়েছে। ধীরে ধীরে, শহরের ভিতরে গাড়ির চাপ কমানোর জন্য বাইরে দিয়ে বাইপাস করতে হয়েছে সরকার কে। আর তাতেই আমার স্বামীর কপাল পুড়েছে। বাইপাস হয়ে যাওয়ার জন্য এখন অনেক গাড়ী ওই রাস্তা দিয়ে সফর করার জন্য আমাদের দোকানের বিক্রী অনেক কমে যায়। আর আমাদের আরও সন্তান হয়ে যাবার কারনে খরচ বেশী হয়ে গেছিল। তাই আমাকেও আমার স্বামীর সাথে কাজে লেগে যেতে হলো। আমিও এই ইকারার ই মেয়ে, আমার বাপের বাড়িও এখানে। মজার ব্যাপার হলো আমরা থাকি দক্ষিনে আর আমার বাপের বাড়ি উত্তরে। আমার বাড়িতে আমার মা বাবা, আমার এক ভাই থাকে। আর আমার বোনের বিয়ে হয়েছে এখান থেকে পূর্ব দিকে মানে আটলান্টিসের কাছে একটা ছোট গ্রাম আটলানা তে।
আটলান্টিসের পেডিমেন্ট বলে ওই জায়গা কে আটলানা বলে। আটলানা আসলে ওখানের সব গ্রাম এর ই নাম। আনলান্টার কাছে বলে অমন নাম। এখান কার সরকার গ্রাম গুলোর নাম আটলানা ১ থেকে শুরু করে আটলানা ২৩২ অব্দি দিয়ে রেখেছে। আমার বোনের বিয়ে হয়েছে আটলানা ১০৩ এ। মোটামুটি ওদের গ্রাম থেকে পর্বতের শুরু পাঁচ কিমি মতন হবে। এদিকে সব জায়গার ই আসল আয়ের উৎস চাষবাস। যদিও আমাদের কোন চাষাবাদের যোগ্য জমি নেই। আমার বাবার আছে। কারন দক্ষিনের থেকে উত্তর অনেক বেশী সমতল। ইভান মাঝে মাঝেই চলে যায় ওর দাদুর কাছে। আমার বাবা ওকে কিছু টা জমি দিয়েছে। সেখানেই ও নিজের মতন কিছু ফসল ফলায়। নিয়ে আসে দাদু আর দিদা কে দিয়ে কিছু মায়ের জন্য। দেখেও হাসি পায়।
যখন ইভান জন্মেছিল তখন আমি বেশ ছোট। ওকে ভালো করে মানুষ ই করতে পারিনি আমি। আমিও তখন সতের মাত্র। ছেলেকে কোলেই নিতে পারতাম না আমি ঠিক করে। সব ই শিখেছিলাম ধীরে ধীরে, আমার শাশুড়ি মানে ক্যারোলের মা মাঝে মাঝেই এসে আমাকে এটা সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতেন। এখন ওনারা কেউ নেই এখানে। অনেক কাল সংসার করার পরে ভারতের ইস্কনের কোন মন্দিরে এখন ওনারা নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছেন। কথা হয় মাঝে মাঝেই।
আসলে তখন জুনিয়র ব্রুনো নিজের কাজে মারাত্মক ব্যস্ত। নতুন বিয়ে, ছোট সন্তান। অনেক অর্থের প্রয়োজন। আমি তখন বলতে গেলে সারাদিন বাড়িতে একলাই থাকতাম। মাঝে মাঝে কেঁদে ফেলতাম আমি কিছুই সামলাতে না পেরে। একদিনে রান্না বান্না অন্য দিকে সন্তানের কান্না। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব? যদিও এমন না যে ইকারা মেয়েদের তুলনায় আমার অনেক আগে বিয়ে হয়েছে। হয়ত আমার এক বছর আগেই বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মূলত আমার ইকারা মেয়েরা ওই বয়সেই বিয়ে করে নিতাম। কারোর বাড়ি থেকে দেখা শোনা করে দিত কেউ বা আমার মতন নিজেরাই পছন্দের পুরুষ টা কে নিয়ে সংসার সমুদ্রে ভেসে পরতাম।
সেই তখন আমার শাশুড়ি এসে শেখাতেন কখন ইভান খাবারের জন্য কাঁদে আর কখন ঘুমোবে বলে কাঁদে। ভাবলেও এখন গায়ে কাঁটা দেয় আমার। আহা বেচারী কিছুই পায় নি আমার থেকে যত টা না ওর বোন আর ভাই রা পেয়েছে। তাও সব থেকে ও কাছের আমার। হয়ত আমার মনের অনুতাপ এটা। আর সত্যি তো কতদিন কেঁদে কেঁদে ছেলে আমার ঘুমিয়ে গেছে। ক্যারোল কাজে থাকত আর আমি একলা ইভান কে নিয়ে। এতো ছোট ছিলাম আমি ওর কান্না বুঝতেও পারতাম না। তাই এখন সব সন্তান দের থেকে ওই বেশী আদর পায় আমার।
এখন তো বড় হয়েছে। বাপের মতন লম্বা হয়ে গেছে। পড়াশোনা করছে ইকারা গভর্নমেন্ট ৪ নম্বর হাইকলেজে। জুনিয়র কলেজ শেষ করে ভোকেশনাল কোর্স নিয়ে পড়ছে ওর আগের কলেজেই ও। ইলেক্ট্রিক্যাল এক্সেসারিজের উপরে কোর্স। আমরা নিম্নবিত্ত পরিবার। ক্যারোল যেমন ব্যবসা করে। লেখা পড়া বিশেষ করে নি। কিন্তু আমি জোর করেই জমানো টাকা ঢেলেছি ইভানের জন্য। ও একটা কাজ শিখলে পরে বদলাতে পারবে ওর উপার্জনের পদ্ধতি। খুব পড়াশোনায় মতি আছে ওর এমন না, তবে অবহেলা করে না। কত রাতে হিসু করতে উঠে দেখেছি ওর ওয়াগনের আলো জ্বলছে। আমার ছেলে মেয়েদের মধ্যে বরং মালিয়ার পড়াশোনার ইচ্ছে অনেক বেশী। যাই হোক প্রায় প্রতিদিনেই ইভান কলেজের পরে কোনদিন ফুটবল খেলে বা কখনো সাইকেল নিয়ে বন্ধুদের সাথে শহর ঘুরতে বেরোয়। আমি ঠায় চেয়ে থাকি ওয়াগনের দিকে, লাইট জ্বলছে কিনা। ফিরল কি না ও।
ওহ বলতেই ভুলে গেছি, এখন সে নিজের ঘর পেয়েছে একটা, আমাদের বাড়ির পিছন থেকে একেবারে লেকের ধারে দুটো রেল এর বগি পরেছিল।একটা একেবারে লেকের ধারে আর একটা আমাদের মেইন বাড়ীর একেবারে সামনে। লেকের ধারের ওয়াগন টা ছিল সেখানে নিজের সংসার পেতেছে ও।