যদি থাকে নসিবে, আপনা আপনি আসিবে..!!(হিল্লা বিবাহ) - অধ্যায় ২
Part 02
এবার আসা যাক বর্তমানে, রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। আমরা তিন ভাইবোন পড়ার টেবিলে বসেছিলাম। দিদা ঘরের কোণে ছোট্ট পূজার আসনে প্রদীপ নিভিয়ে মন্ত্র জপ শেষ করছিলেন, দাদু বসে ছিলেন হাতে জপমালা নিয়ে। নানিমাও দিদার সঙ্গে বসেছিলো।
এই শান্ত পরিবেশটা টিকল না বেশিক্ষণ। ছোট্ট একটা কারণে মা–বাবার মধ্যে তর্ক শুরু হলো। মা বললেন,
—“আজ বাজার থেকে কয়েকটা জিনিস আনতে ভুলে গেছো।”
বাবা তখনই বিরক্ত হয়ে উঠলেন,
“আমি সারাদিন বাইরে খেটে মরলাম, আর তুই এসেই ভুল ধরা শুরু করলি?”(বাবা রেগে গেলে মাকে তুই করে বলে)
মা শান্তভাবে বললেন,
"ভুল ধরা নয়, শুধু মনে করিয়ে দিলাম।”
কথাটা শোনার পর বাবার গলা ভারী হতে লাগল। আমরা বই বন্ধ করে চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম। দিদা ভুরু কুঁচকে সব শুনছিলেন, কিন্তু চুপ ছিলেন।
বাবা রাগে হাত চাপড়ালেন টেবিলে,
“সব সময় আমি দোষী! এই সংসারটা তো আমি একাই চালাই নাকি? তুই এতো অকৃতজ্ঞ কেনো?!”
বাবার কথা শুনে কেউ কিছু বলল না। সত্যি বলতে এই সংসার তো কাকাইও চালায়।
মায়ের চোখ ভিজে গেল। তিনি গলা কাঁপিয়ে বললেন,
“অকৃতজ্ঞ আমি নই। আমি শুধু চাইছিলাম তুমি একটু মনোযোগ দাও আমাদের দিকে। তোমার এই রাগেই ঘরে শান্তি থাকে না।”
বাবা তখন প্রায় চিৎকার করলেন,
“আমি সব সময়ই ভুল করি তাই না? তবে এই সংসারই ভেঙে দিই আমি… তোরে তালাক দিই! তাহলে এসব ঠিকঠাক হয়।”
শব্দটা উচ্চারিত হতেই পুরো ঘর থমকে গেল। মা হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমরা ভাইবোনেরা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরলাম।
দাদু তখন আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন,
“এই কী উল্টোপাল্টা বকছিস? তালাক বলিস? রাগে-গরমে মুখ সামলাতে পারিস না? সংসার ভাঙা কি খেলনা নাকি?”
বাবা তখনো রাগে গজগজ করতে করতে বললো-
- ওকে আমি তালাকই দিবো। এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক। (ওই যে আমাদের এলাকাটা পরিবারের মতো, তাই তালাকটাও বাবা এভাবে দিলো।)
এবার দাদাভাই আর বসে না থাকতে না পেরে উঠে এসে বাবার গালে একটা জোরে থাপ্পড় মারলো।
আর বলল-
-হতচ্ছাড়া, কি করলি কি তুই? তোর ছোট ছোট দুইটা সন্তান আছে। একটা না হয় বড় হয়েছে। ওদের কথা তো চিন্তা করবি নাকি। তুই তালাক দিশ আর যাই করিস। বউমা আমাদের এই বাড়িতেই থাকবে।
দাদুর এই কথা ঠিকই ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধলো তখন। যখন পাশের বাড়ির কাকিমা বলে উঠলেন-
- ছি ছি কাকু, কি বলছেন কি? তালাক হয়ে যাওয়ার পরে আবার কিভাবে বউয়েরা শশুর বাড়ি থাকে? ভাবির তো এখন হিল্লা বিবাহ দিতে হবে। এরপর আবার সেই স্বামী ডিভোর্স দিলে তখন ভাইয়ের বউ হইতে পারবে।
উনার এমন কথা শুনে তো আমরা সবাই অবাক। উনি না জানলে, হয়তো ঘটনাটা ধামা চাপা দেওয়া যেত। কিন্তু এখন??
এবার বাবা থমকে গেলেন। মুখের মধ্যে কথা গুলো যেন হঠাৎ কাঁটা হয়ে আটকে গেল। মা কান্না চাপতে না পেরে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
ঘরটা হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দিদার চোখে জল, দাদু মাথা নাড়ছেন বিরক্তি আর কষ্টে। নানিমাও কান্না করে বুক ভিজিয়ে ফেলেছেন। নানা ভাই নিজের রুমে ঘুমাচ্ছেন। আমরা ভাইবোনেরা ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম।
এবার দিদা বললো-
-কি বলছো কি রফিকের মা? হিল্লা বিবাহ দিতে হবে কেন? আমরা কি তোমাদের মতন নাকি?
পাশের বাড়ির কাকিমা বলল-
- খালাম্মা আপনি আমাদের পর করে দিচ্ছেন কেন? আমরা তো সবাই একই নাকি। আর আপনি তো জানেনই, এই গত দুই বছর আগে ওবাড়ির বজরাঙ্গির বউয়েরও তো হিল্লা বিবাহ হলো। আর সে বিবাহ তো আপনিই পরিচালনা করলেন। এখন নিজের বেলা কি বলছেন এসব?
এবার দিদা আটকে গেল। সত্যিই গত দুই বছর আগে ওবাড়ির নতুন বউটাকে দিদাই হিল্লা বিবাহ দিয়েছিল। এখন সেই একই বিয়ে নিজের ঘরের বউয়ের উপর পড়তাচ্ছে। হায় হায়!!
বাবার এমন উদ্ভট সিদ্ধান্তে আমাদের পুরো পরিবারে গোলমাল লেগে গেলো। এখন কি করে কি করি, সেই নিয়ে সবার চিন্তার শেষ নেই।
দিদা বলল-
-দিভাই(নানী এবং দাদি দুজন দুজনকে দিভাই ডাকে)আপনি কি বলেন আমরা এখন কি করতে পারি?
--আমার মাথায় তো কিছু আসছে না। জামাইবাবু কি থেকে কি করে ফেলল। একদম রগচটা। এমন করলে হয় বলেন। (বলেই নানি কেঁদে উঠলো)
- থাক আর কান্না কইরেন না। একটা ব্যবস্থা তো হবেই ।
-- কিভাবে হবে বলেন তো। কে আমার মেয়েটাকে হিল্লা বিবাহ করবে। আর এই এলাকায় থাকতে হলে ওকে তো হিল্লা বিবাহ দিতেই হবে। নায়তো এই সমাজে আমরা বাঁচতে পারবো, লোকে কি বলবে??
- হ্যাঁ তা ঠিকই। আমরা আমাদের এই সুন্দর বাড়ি রেখে কই যাব? বৌমাকে একটা হিল্লা বিবাহ দিব। তবে তা ঘরের মধ্যে থেকে কাউকে নিয়ে।
দাদির এমন কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল। দাদী মায়ের সঙ্গে কার বিয়ে দিবে? কে করবে আমার মাকে বিয়ে? তাও আবার ঘরের মধ্যে থেকে? মাথায় কিছু আসছিল না। তখন দিদা আবার বলল -
- এখন যে যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর তুই (বাবাকে) ওই খালি রুমে গিয়ে ঘুমাবি। বৌমা এখন আর তোর বউ নেই।
বাবা বলল-
,,, কি বলছো কি মা? আমরা কেন ওদের নিয়ম মানতে যাব?
- একদম কথা বলবি না। যা বলেছি তাই কর। অসভ্যতা তালাক দেওয়ার আগে মনে ছিল না।
এরপর বাবা মন খারাপ করে দোতালায় একটা খালি রুমে চলে গেলো। বাবার মুখ দেখে বাবাকে খুব অসহায় লাগছিলো।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম, সত্যি বলতে বাবার জন্য আমারও খুব খারাপ লাগছিলো। ঠিক তখনই নানী বলল-
-- আজ আমি রেখার সঙ্গে শুই।
- ভাই(নানা) না আজকে একটু অসুস্থ? আপনি আজ ভাইয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়েন। আকাশ আজ ওর মায়ের সঙ্গে শুক।
, আমি মায়ের সঙ্গে শুব? কিন্তু মা তো গেট লাগিয়ে দিয়েছে।
- হতে সমস্যা নেই। দাঁড়া আমি বলছি তোর মাকে।
-- হ্যাঁ তাহলে, সে ই ভালো হয়।
এরপর দিদা এবং নানু দুজনেই মায়ের ঘরের দরজায় বাড়ি দিতে লাগলো। এরপর মা দরজা খুলে জিজ্ঞেস করলো-
,, কি হয়েছে? (মায়ের চোখে ইতিমধ্যেই লাল) এত গেট বাইরাচ্ছো কেন?
-- নারে মা, কিছু হয়নি। বলছিলাম কি আজ তোর সঙ্গে আকাশ শুবে।
নানুর কথা শুনে মা দিদার দিকে তাকালো। এতে দিদা মাথা নাড়িয়ে বলল-
- হ্যাঁ রে মা, তোর সঙ্গে আকাশ শুয়ে থাকুক। আর ওই হতচ্ছাড়াটাকে দোতলায় পাঠিয়েছি। আর বাকি সিদ্ধান্ত কালকে নিবো।
পাশেই দাড়িয়ে ছিল পাশের বাড়ির কাকিমা। তিনি একটু আদিখ্যেতা করে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার ভান করে বললো -
''দেখলে দিদি কি থেকে কি হয়ে গেল? পুরুষ মানুষের এত রাগ ভালো না।"
মা তার কাঁধে মাথা রেখে শুধু হুম বললো।
এরপর কাকিমা চলে গেল।
কাকিমাকে আমার কিছুক্ষণ আগে ভালো লাগলেও এখন দেখলেই গা জ্বলে যাচ্ছে। তার জন্যই মায়ের বিয়ে দিতে হবে। নয়তো পুরো গ্রাম ছড়িয়ে দিবে। এজন্যই প্রতিবেশীদের বিশ্বাস করতে নেই। আজ রাতে এসেছিল আমাদের বাড়ি খেতে, আর এখন আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে দিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে। দুষ্টু মহিলা।
-- যা নানা ভাই। আজ তুই তোর মায়ের সঙ্গে একটু শুয়ে থাক। আমার মেয়েটাকে একটু সান্ত্বনা দিস। তোর বাপটা আস্ত গাধা।
- হ্যাঁ রে দাদা ভাই আজ তোর মাকে একদম জ্বালানি না। তোর মা কান্না করলে সান্তনা দিস।
এরপর দিদা এবং নানী দুজন মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
-/--য মা এখন ঘুমিয়ে থাক। যা হবে, কাল দেখা যাবে। তুই একদম চিন্তা করবি না। তোকে আমরা এবাড়ি থেকে কোথাও যেতে দেবো না।
এরপর মা রুমে ঢুকতে নেওয়ার সময় দিদা বলল-
- ভাই আজ মশারিটা তুই টাঙিয়ে নিস। তোর মায়ের মন ভালো নেই। এমনিতেই রাতে ঘুম আসবে না, তার উপর মশা কামড় দিলে তো আর আসবেই না। .
এরপর রুমে ঢুকে মা আগে লাগিয়ে দিলো। মা রাতে ঘুমানোর সময় গেট লাগিয়েই ঘুমায়, তা এবাড়ির সকলেই জানে। নয়তো মায়ের ঘুম আসে না। মা গেট লাগাতেই আমি মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললাম-
, তুমি এত কান্না কেনো করছো, মা? দিদা নানু তো সব ঠিক করে দিবে।
,, তুই কি করে বুঝবি!! যা ঘুমা। তোর বাপটা খুব খারাপ। আমার জীবনটা নরকে পরিণত করেছে।
, হ্যাঁ মা তা ঠিকই। বাবার আচরণ এবাড়ির কারো সঙ্গেই মিলেনা।
মা আমার হাত ছাড়িয়ে নিলো-
,, মিলবে কি করে, সারাক্ষণ ছাইপাশ খায়।
মায়ের এমন কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম. তাই মাকে জিজ্ঞেস করলাম-
, সত্যি মা, বাবা ওসব উল্টাপাল্টা জিনিস খায়?
,, সত্যি নয়তো মিথ্যা নাকি। যা এখন ঘুমা।
, তুমি ঘুমাবেনা। তুমিও আসো।
বলে মাকে টানতে টানতে বিছানায় নিয়ে গেলাম। এবার মাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললাম-
, মা তুমি নাইটি পড়বে না?
,, না, এই শাড়িটা পাতলাই আছে।
, আচ্ছা তাহলে শুয়ে পড়ো।
এরপর আমি আর মা শুয়ে পড়লাম। প্রথম এক-দেড় ঘণ্টা আমাদের দুজনের কারোই ঘুম হয়নি। এরপরে হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রাত একটা-র দিকে হালকা শীত শীত অনুভব হওয়ায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর আমি যা দেখলাম তা দেখে নিজেকে ঠিক রাখাই দায়..........
কেমন হলো জানাবেন।
লাইক দিতে ভুলবেন না।
এতদিন অপেক্ষা করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
নিয়মিত আপডেট দেওয়ার চেষ্টা করব।