অঘটনঘটন পটিয়সী (নতুন আপডেট ৩৬) - অধ্যায় ১৪৩
খ
গাড়ি এখন সুনামগঞ্জের ভিতর সদরপুর বলে একটা জায়গায় এসে থেমেছে। বেলা দুইটা বাজে। গতকাল দুপুরের পর থেকে মাহফুজ বা নুসাইবা কেউ কিছু খায় নি। নুসাইবার প্ল্যান ছিল রাতে প্লেনে উঠে একেবারে খাবার খাবে আর মাহফুজের প্ল্যান ছিল নুসাইবা কে প্লেনে তুলে দিয়ে খাবার খাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। ইংল্যান্ডগামী প্লেনের বদলে নুসাইবা এখন এক মাইক্রোর ভিতর বসে আছে। মাইক্রোটা একটা রাস্তার পাশে দোকানের পিছনে পার্ক করা। রাস্তা থেকে ঠিক দেখা যায় না। মাহফুজ গাড়ি থেকে নেমে একটু হাটছে তবে বেশিদূর যাচ্ছে না। সোলায়মান শেখের কঠিন নির্দেশ যত কম সম্ভব মানুষের চোখে পড়তে হবে। এই দোকানটা আমিনের পরিচিত এক ছেলের। আমিন এইখানে এনে গাড়ি রেখেছে। দোকান থেকে তিনটা নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেট আর দুই বোতল মামের পানি নিয়ে এসেছে। দুইজন ক্ষুধার্ত ছিল তাই কোন কথা না বলে প্যাকেট খুলে বিস্কুট খেতে থাকে। ঢাকা শহরে আজকাল নাবিস্কোর বিস্কুট গুলো দেখা যায় না। তবে মফস্বল আর গ্রামের দিকে এখনো দোকানে নাবিস্কোর বিস্কুট পাওয়া যায়। নুসাইবা এই বিস্কুটের প্যাকেট দেখে অবাক হয়। ওর ছোটকালে পাড়ার দোকানে পাওয়া যেত। ছোট ছোট এই প্যাকেটু গুলা এখনো বিক্রি হয় এইটাই অবাক করল নুসাইবা কে। নুসাইবা আড় চোখে মাহফুজ কে দেখে। গতকাল রাতে মাইক্রো চলা শুরু করার পর অল্প কিছু কথা হয়েছিল। এরপর থেকে দুইজনের কথা বন্ধ। নুসাইবা টের পায় বাস্টার্ড বলাটা একটু বেশি বেশি হয়ে গেছে। তবে নুসাইবা জানে ওর মেজাজ ওর উইক পয়েন্ট। এর আগেও মেজাজের জন্য অনেকের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। তবে নুসাইবা এখনো শিওর না আসলেই কি মাহফুজ কিছু জানত না এই সোলায়মান শেখের প্ল্যান বি নিয়ে নাকি সব কিছু মাহফুজের পরিকল্পনা। আবার নুসাইবা ভাবে এয়ারপোর্টে তো আসলেই মুন্সীর লোক ছিল। সেটা তো আর মাহফুজ প্ল্যান করে দিতে পারে না। নুসাইবার মনে হয় আবার আরেকটা ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ওর মনে হয় এখন আসলেই মাথা ঠান্ডা রাখার সময়। এই সময় ওর আসল মিত্র আসলে মাহফুজ। এমন অচেনা অপরিচিত একটা জায়গায় থাকতে হবে। যেখানে একমাত্র পরিচিত মাহফুজ। আবার এই আমিন লোকটার সাথে যাচ্ছে। লোকটা কেমন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত কোন আইডিয়া নাই। আমিন লোকটার বেশ কিছুক্ষণ ধরে খোজ নাই। নামায পড়তে গেছে বলল। ফযরের সময়ও এক জায়গায় গাড়ি থামায়ে নামায পড়ে আসছে। এমনিতে লোক ভাল মনে হচ্ছে। বেশ নামাযী লোক। ওরে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করছে ভাবী কোন দরকার থাকলে বলবেন। ভাবী ডাক শুনে বেশ কিছুক্ষণ বুঝতে পারে নি ওকে ডাকছে। নরমালি এমন লোকরা ওকে ম্যাডাম বলে। তবে এই লোকটা কেন ভাবী ডাকছে সেইটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগলেও ব্যাপারটা নুসাইবা কে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। বিয়ের পর থেকে ভাবী ডাকটা খুব কমন। আরশাদের বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়, কলিগ এমন হাজার জন ডাকছে। কিন্তু এইবার ভাবী ডাকটা আরশাদের জন্য ডাকা হচ্ছে না ডাকা হচ্ছে মাহফুজের জন্য। এই বিষয়টা মাথায় আসতেই অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। সোলায়মান শেখ বারবার বলে দিয়েছে যেন কার কোন ভাবেই সন্দেহ না হয় যে ওরা হাজব্যান্ড ওয়াইফ না। আমিন ওর কাছের লোক হলেও আমিন যেন টের না পায়। কারণ সোলায়মান শেখ বলে দিয়েছে এখন লোকজন একজন বছর চল্লিশের একজন শহুরে মহিলা কে খুজবে। কিন্তু নুসাইবা আর মাহফুজ যদি একসাথে হাজব্যান্ড ওয়াইফের অভিনয় করে তাহলে ওদের খুজে বের করতে একটু কষ্ট হবে। আর আমিন এমনিতে যথেষ্ট ধার্মিক লোক। তাই তার কাছে না বলাই ভাল যে নুসাইবা মাহফুজ আসল হাজব্যান্ড ওয়াইফ না।
আমিন নামায পড়ে ফেরত এসেছে। মাহফুজ কে বলে ভাইজান এখন তেমন কিছু খাবার ব্যবস্থা করতে পারি নাই। সামনে একটা বাজার আছে। ঐখানে কোন ভাতের হোটেলে থামানো যাইত কিন্তু সোলায়মান স্যার মানা করে দিয়েছে যেন বাজার বা হোটেল যেখানে অনেক লোক আছে তেমন কোথাও না থামাই। তাই আপাতত এই বিস্কুট দিয়ে পেট ভরান। নুসাইবার দিকে তাকিয়ে বলে ভাবীজান আপনার কিছু লাগবে? মাহফুজ হাসতে গিয়েও হাসি আটকালো। গতকাল রাতে নুসাইবা একটা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। নুসাইবার জন্য এতবড় একটা রিস্ক নিচ্ছে ও। সেখানে ওকে সন্দেহ করে বাস্টার্ড বলে গালি দিচ্ছে। এইটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঠিক সেই মূহুর্তে মাহফুজ ভয়ংকর রেগে গেলেও আর কিছু বলে নি। আমিনের সামনে কোন কথা বাড়িয়ে সন্দেহ তৈরি করতে চায় না। কারণ এখন নুসাইবার সেফটির সাথে ওর নিজের সেফটিও জড়িত। মুন্সী বা ম্যানেজার সম্পর্কে যা যা খবর যোগাড় করেছে মাহফুজ তাতে মনে হয় না ওরা সহজে ওকে ছাড়বে নুসাইবা কে হেল্প করার জন্য। ফলে এই মুহুর্তে সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে নুসাইবা কে সেফ রাখা। এতে ওর নিজের সেফটিও সুরক্ষিত থাকবে। তবে নুসাইবার উপর রাগটা ভিতরে আছে ওর। তাই বারবার যখন আমিন ভাবী ভাবী বলে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে এতে মাহফুজ বেশ মজা পাচ্ছে। কারণ ও জানে নুসাইবা এই ভাবী ডাকে চরম অস্বস্তিবোধ করছে কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। আমিনের প্রতিটা ভাবী ডাক তাই মাহফুজের জন্য মনে হচ্ছে এক একটা প্রতিশোধ। আমিন বলতেছে ভাবীসাব আমার বাড়ী হাওড়ের মাঝে। আর আধা ঘন্টা সামনে গেলে একটা ঘাট আছে। সেখান থেকে আমরা একটা ট্রলারে উঠব। এমনিতে আমার বাড়ি যাবার পথে লঞ্চ যায়। তবে সোলায়মান স্যারের কথা অনুযায়ী আপনাদের ঐখানেও তোলা যাবে না। লোকজনের নজর এড়ানোর জন্য। আমিও যাব সাথে করে। এমনিতে লঞ্চে গেলে বাড়ি থেকে আধা ঘন্টা দূরে একটা গঞ্জের বাজার আছে। সেখানে থামে। ট্রলারে একদম বাড়ির মুখে নামা যাবে। আপনারা চিন্তা কইরেন না। তিন চার ঘন্টা লাগবে। তবে মাগরিবের আযানের মধ্যে বাড়ী পৌছায়ে যাব।
আমিনের কপালে চিন্তার রেখা। অনেকদিন ধরে সে এইসব কাজের সাথে জড়িত না। ওদের এলাকায় কেউ বেশি পড়াশুনা করে না। তাও আমিন মেট্রিক পর্যন্ত পড়ছিল। এরপর আর পড়াশুনা করা হয় নায়। সিলেট শহরে গেছিল এক আত্মীয়ের কাছে কাজের জন্য। সেখানে প্রথমে কিছুদিন এক চালের আড়তে হিসাব লিখত। এইটা কাজটা ভাল লাগে নাই আমিনের। সারাদিন দোকানে বসে থাকার লোক না আমিন। আর সেইটা আর কম বয়স সারাদিন মন উড়ুউড়ু করে। সেখান থেকে বের হয়ে আসলে নানা রকম লোকের সংগে পড়ে গেল। এখান থেকেই প্রথম গাজা খাবার শুরু। এরপর আস্তে আস্তে হিরোইন। এক সময় আমিন পুরো নেশাখোর হয়ে গেল। পরিবারের সাথে যোগাযোগ নাই, হাতে টাকা নাই। মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধবের সাথে মিলে ছিচকা ছিনতাই করে সেই ছিনতাইয়ের টাকাটাও নেশাতে যায়। এই রকম অবস্থায় প্রথম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আমিন। যে মারটা সেইবার খাইছিল সেইটা ভুলার না। এখনো আমবস্যা পূর্ণিমার রাতে গিড়ায় গিড়ায় ব্যাথা করে। তবে ওদের দলের একজনের মামা সরকারী দলের নেতা ছিল। তাই সাত দিন জেলে থেকে শেষ পর্যন্ত ছাড়া পাইছিল। সেইবার প্রথম বড় একটা ধাক্কা খায় আমিন। সেই ধাক্কা কিছুটা সোজা করলেও পুরো নেশা থেকে বের হতে পারে নি। এই সময় আর টাকার জন্য ছিনতাই করা বন্ধ করে দেয়। পুলিশের এত মার আর সহ্য করার ক্ষমতা নাই ওর। সেই সময় এক বন্ধুর বুদ্ধিতে ড্রাইভিং শিখে। সারাদিন এইখানে সেইখানে ক্ষ্যাপ আর রাতে নেশা। এভাবে গেল আর এক বছর।
এরপর আসল আরেক সময় আমিনের জীবনে। সেই সময় টাকায় নেশায় পাইল আমিন কে। গাড়িতে যে ক্ষ্যাপ মারে তখন গাড়ির ভিতর লুকায়ে ফেন্সিডিল, হিরোইন পৌছাইতে হবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা। টাকা পাওয়া যায় প্রচুর। সেই টাকায় ফূর্তি হয়। আর এই সময় অপরাধ জগতের ভিতরে অনেকের সাথেই কমবেশি পরিচয় হয় আমিনের। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে। তবে আস্তে আস্তে খ্যাপের কাজ বেশি নেওয়া শুরু করল ঢাকার দিকে। কারণ তাইলে ঢাকা সিলেট বা মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এইসব জায়গায় ড্রাগ পরিবহন করে টাকা পাওয়া যায় উপুড়ি। সেই সময় দ্বিতীয়বার পুলিশ ধরল ওরে। তবে নিজের গাড়িতে করে ড্রাগ নেবার সময় না। ভাগ্য খারাপ ছিল। আরেক ড্রাইভার বন্ধু ড্রাগ সাপ্লাই দিতেছিল, ও এমনি গাড়িতে ছিল গল্প করার জন্য। সেই সময় পুলিশের মারের ভয়ে আমিনের অবস্থা খারাপ। ঠিক তখন প্রথম দেখা হইল সোলায়মান শেখের সাথে। নতুন নতুন ডিবিতে আসছে সোলায়মান শেখ। ডিবির একটা দল কে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ঢাকায় যে রুট গুলা দিয়ে ড্রাগ ঢুকে সব গুলা আইন্ডেটিফাই করে এদের হোতাদের চিহ্নিত করা। সোলায়মান শেখ তখনো বেশ নতুন পুলিশে। মনে তাই দয়ামায়া বেশি ছিল। আমিনরে মাইর দিয়ে কথা বের করার দ্বায়িত্ব ছিল সোলায়মান শেখের উপর। তবে দুই একটা বাড়ি দেওয়ার পর আমিনের আকুতি মিনতি ভার চোখে ভয় দেখে সোলায়মানের দয়া হয়। সেখান থেকে আস্তে আস্তে সোলায়মান শেখের সোর্স হয়ে যায় আমিন। প্রায় সাত আট বছর এই লাইনে ছিল। ভাল সোর্স ছিল। প্রচুর খবর দিছে সোলায়মান শেখকে। সোলায়মান শেখের জীবনের প্রথম সোর্সও আসলে এই আমিন। তবে আমিনের জীবনের সব চেঞ্জ হয়ে গেল জোহরার সাথে দেখা হবার পর। সেটাও আজ থেকে পনের বছর আগের কাহিনী। তবে গোপন জগতটা চাইলেই সহজে ছাড়া যায় না। তাই সেটা থেকে বের হইতে হইতে আর চার পাচ বছর লাগছে। এই সময়টা সোলায়মান স্যার তারে ছায়া দিয়ে রাখছে যাতে বড় কোন ঝামেলায় না পড়ে। এইসব কারণে সোলায়মান শেখের উপর কৃতজ্ঞ আমিন। সোলায়মান যখন তাই বলছে তার দুইজন কাছের লোকের উপকার করা লাগবে তখন চোখ বন্ধ করে রাজি হয়েছে। তবে আমিনের প্রথম চিন্তা ইনাদের সব এড়ায়ে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া। অপরাধ জগতে কাজ করার জন্য আমিন জানে এরা কত জায়গায় টাকা দিয়ে খবর বের করে ফেলতে পারে। সোলায়মান স্যার ঢাকা শহরের রাঘব বোয়াল অপরাধীদের ভয়ের কারণ। কিন্তু গতকাল সোলায়মান স্যার যেভাবে বার বার সাবধান করছে তাতে বুঝা যাচ্ছে এই মাহফুজ ভাইয়ের পিছনে যারা লাগছে তারা বড় ক্ষমতাশালী। সোলায়মান স্যার অবশ্য বলে দিছে মাহফুজ ভাই নিজেও বড় নেতা। এখন নির্বাচনের সময় কিছু লোক পিছে লাগছে, তাই কয়েক সাপ্তাহ একটু আড়ালে থাকা লাগবে এমন খানে যেখানে তাদের কেউ খুজবে না। আমিন তাই না করে নায়। তবে মাহফুজ ভাইয়ের বউ, ভাবীরে নিয়ে ওর চিন্তা। ভাবীর আচার আচরণে কোনভাবে উনারে গ্রামের মানুষ প্রমাণ করার উপায় নাই। যে কেউ দেখলেই বুঝবে উনি শহরের লোক। উনারে তাই কিভাবে আড়ালে রাখা যায় এইটা একটা ব্যাপার। অবশ্য ওর বাড়ি এইজন্য ভাল একটা জায়গা। তবে আর সচেতন হতে হবে। আর দুই নাম্বার ব্যাপার হল জোহরা কে খবর দেওয়া হয় নায়। নরমালি ওর বাড়ির সব জায়গায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক নাই। বাড়ির দক্ষিণ কোণায় অল্প কিছু জায়গায় নেটওয়ার্ক আছে। জোহরা মাঝে মাঝে ঐ জায়গায় গিয়ে নেটওয়ার্ক পাইলে ফোন দেয় ওরে, যখন কাজের জন্য বাইরে থাকে। আজকে জোহরা একবারও ফোন দেয় নায়। শহর থেকে দুইজন দামী মেহমান নিয়ে যাচ্ছে, খাওয়া দাওয়ার কি অবস্থা হবে, থাকার কি ব্যবস্থা হবে কিছুই জোহরা কে বলা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার সময় মাগরিবের ওয়াক্তে এইভাবে মেহমান নিয়ে হাজির হলে জোহরা রাগ করবে। জোহরা বাড়িতে বাচ্চা নিয়ে একা থাকে। তাই মেহমান আসলে খুশি হয়। তবে জোহরা সব সময় আয়োজন করতে পারলে আর খুশি হয়। এখন খবর না দিয়ে গেলে আয়োজন হবে না। আপাতত কিছু করার নাই এইভাবেই যেতে হবে। আর উনাদের সবার নজর বাচায়ে ঠিক মত নিয়ে যাওয়া আসল কাজ। আমিন একবার যে কাজে কথা দেয় সে কাজ জীবন দিয়ে হলেও করে।