অঘটনঘটন পটিয়সী (নতুন আপডেট ৩৬) - অধ্যায় ১৫০
ছ
রাত আটটা বাজে। আগামীকাল ভোরে আমিন আবার কাজের জন্য বাড়ির বাইরে যাবে কয়েকদিনের জন্য। তাই আজকে সন্ধ্যা হতেই রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছে সবাই। আমিন কে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে। ভোরে ভোরে বের হয়ে পড়বে। খাবার শেষ হতেই নুসাইবা এক ধরনের টেনশনে পড়ে গেছে। আজকে ওকে আর মাহফুজ কে এক রুমে থাকতে হবে। হাজব্যান্ড আর ওয়াইফ এক রুমে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। গতকাল রুম গোছানো ছিল না তাই সেই সুযোগ নিতে পেরেছে। আজকে কোন উপায় নেই। এর মধ্যে জোহরা কথায় কথায় কয়েকবার বলে ফেলেছে যে আমিন প্রতিবার কাজে যাবার আগের রাতে ওকে আদর করতে পছন্দ করে। নুসাইবা তাই কোন উপায় খুজে পায় নি যাতে মাহফুজ আর ওকে একসাথে এক রুমে থাকতে হয়। মাহফুজ ওকে অনেক উপকার করলেও ঠিক এক রুমে রাতে থাকালে কি হবে সেইটার উপর ভরসা করতে পারছে না ও। মাহফুজ কি করবে ঠিক নেই। আর আরেকটা কথা স্বীকার না করলেও ও জানে মাহফুজের আক্রমণের মুখে ও কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে। তাই নিজের উপর নিজেই ভরসা করতে পারছে না। আমিনের বাড়ি আসলে একটা লম্বা টিনের ঘর। একদম এক সাইডের একটা রুম হল আমিন জোহরার মেইন বেডরুম যেখানে নুসাইবা গতকাল জোহরার সাথে ছিল। মাঝে একটা রুম স্টোর রুম টাইপ। তার পাশের রুমটা জোহরা আর আমিনের ছেলেরা আসলে থাকে। তবে ঐ রুমটার জানলা গত কয়দিন আগে ঝড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই হাওড় পাড়ের বাড়ীতে এই রুমে এখন থাকা সম্ভব না। কারণ রাতে বাতাস ঢুকে প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে যায়। আর বাকি থাকে আরেকটা রুম সেইটা একদম আরেক প্রান্ত ঘরের। ফলে মাহফুজ আর নুসাইবা যে রুমে থাকবে সেইটা আমিন জোহরার রুম থেকে একদম আরেক প্রান্তে। সররাসরি এক রুম থেকে অন্য রুমে যাবার উপায় নাই। মাঝখানের দুইটা রুম কানেক্টড থাকলেও। এই দুই সাইডের দুই রুমে একটাই দরজা যেইটা সরাসরি বারান্দায় আসে। নুসাইবার টেনশন বাড়ছে। বেশি টেনশন হলে ওর পা ঘামে। সেইটা হচ্ছে। বেশ ভাল শীত সন্ধ্যার পর থেকে। তার উপর আজকে হালকা বাতাস আছে। সেই বাতাস হাওড় পাড়ে গা কাপুনি ঠান্ডা দিচ্ছে। তাই বারান্দা থেকে ভিতরে ঢুকতে হল। এখনো সোলার লাইটের আলো আছে। জোহরা রান্না ঘরের জিনিস গুলা গুছিয়ে নিচ্ছে। আমিন মেয়েটারে কোলে নিয়ে হাটতেছে। বাচ্চাটা আমিনের ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। মাহফুজ দৃশ্যটা দেখে। বাবার কোলে মেয়ে ঘুমিয়ে আছে, একটু দূরে মা রাতের খাবারের পর মা রান্নাঘরটা গুছিয়ে নিচ্ছে ঘুমের আগে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ফ্যামিলির চিরন্তন দৃশ্য।
মাহফুজ ওদের রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায়। ভিতরে নুসাইবা খাটের এক কোণায় বসে আছে গায়ে শাল জড়িয়ে। রুমের মাঝখানে সোলার লাইটের একটা সাদা বাল্ব। পুরো রুমটার ভিতরে অন্ধকার দূর করতে পারছে না লাইটটা। তাই রুমের কোণায় কোণায় যেন অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। নুসাইবা কে এই তাতের শাড়িতে ঝাপসা আলোর ভিতরে শাল জড়ানো গায়ে যেন অন্য রকম লাগছে। কিছুটা অপিরিচিত। নুসাইবা খাটের কোণায় বসে আছে কনফিউজড। খাটের পাশে একটা টেবিল। টেবিলের উপর একটা প্লাস্টিকের টেবিলক্লথ। জোহরা একটু আগে একটা প্লাস্টিকের জগ আর একটা পানির গ্লাস রেখে গেছে টেবিলে। নুসাইবার কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ওদের কে হাজব্যান্ড ভেবে এই রুম দেওয়া হয়েছে। এখন মাহফুজ কে অন্যখানে থাকতে বলার বা নিজে অন্য খানে যাবার উপায় নেই। এমনকি মাটিতেও শোয়ার উপায় নেই। যথেষ্ট ঠান্ডা চারপাশে। মাটিতে শুলে সকালে উঠে নিউমনিয়া বেধে যাবে। খাটটা এমন কোন বড় নয়। তাই দুইজন খাটের দুইপাশে শুবে আর মাঝখানে বালিশ দিয়ে বা অন্য কিছু দিয়ে একটা বিভাজন করবে সেই উপায় নেই। পাশাপাশি দুইজন মানুষ শুলে এখানে শরীর স্পর্শ করবেই। মাহফুজ রুমের ভিতর ঢুকে। নুসাইবার মুখ কাছে আসতে স্পষ্ট হয়। নুসাইবার মুখে এক ধরনের দ্বিধান্বিত ভাব। মাহফুজের মনে হয় আজকাল নুসাইবা কে আর ভাল করে বুঝতে পারছে ও। নুসাইবার মুখে কনফিউজড লুকের কারণ যেন বুঝতে পারে মাহফুজ। দুই জনকে এক বিছানায় শুতে হবে। মাহফুজের মনের ভিতর একটা উল্লাস তৈরি হয় আবার নুসাইবার জন্য এক ধরনের মায়াও হয়। ওর মনে হয় ওকি নুসাইবার সাথে বেশি বেশি করে ফেলছে নাকি? মাহফুজ একটা জিনিস নিয়ে সব সময় গর্বিত ছিল। মেয়েদের কে জিতে নেবার ক্ষমতা। অনেক মেয়ের সাথে শুয়েছে ও। তবে কাউকে জোর করে নি। কিন্তু নুসাইবার সাথে ওর ব্যাপার গুলো কে কি বলা যায়? নুসাইবার মনে হয় মাহফুজের সাথে ওর ভাগ্য এখন এমন ভেবে আটকে গেছে যে চাইলেও অনেক কিছু বলা যাবে না অনেক কিছু করা যাবে না। ছেলেটা ওকে সাহায্য করার জন্য লাইফ রিস্ক নিয়েছে সেইটা অস্বীকার করা যাবে না। যতই ড্রিংক করা হোক বা ফ্লোরার দোকানে ফ্লোরার কারণে হোক বা গাড়িতে হঠাত ঝড়ের মত উত্তেজনায় হোক সব ক্ষেত্রে ওর বডি একটা রিএকশন দিয়েছে। পজিটিভ রিএকশন। এটাও ওর জন্য কনফিউশনের ব্যাপার। এমন আর কখনো হয় নি। সুন্দর ছেলেরা সারাজীবন ওর পিছনে ঘুরেছে কিন্তু কখনো তেমন পাত্তা পায় নি। ওর কাছে ছেলেদের সবচেয়ে আকর্ষনীয় গুণ ছিল কতটা আস্থার। আরশাদ কে পাত্তা দেবার প্রথম কারণ ছিল সেইটাই। যদিও এখন বুঝতে পারছে বছরের পর বছর ওকে কিভাবে বোকা বানিয়েছে আরশাদ। ভালবাসার মানুষের জন্য রিস্ক নেবার প্রবণতা, বাকি সবার সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আরেকটা বড় গুণ ছেলেদের নুসাইবার চোখে। ওর যখন বাচ্চা হচ্ছে না তখন আরশাদ যে ওর নিজের ফ্যামিলি আর সোসাইটির রক্ষচক্ষুর সাথে লড়াই করেছিল সেইটা আরশাদের প্রতি ওর ভালবাসা আর গভীর করার কারণ। কোন মেয়ে না সাহসী লয়াল ছেলে পছন্দ করে। মাহফুজের মাঝে যেন এইসব গুণ এসে জমা হয়েছে। সিনথিয়া খালি হ্যান্ডসাম ছেলে পছন্দ করে নি সাথে সাথে সাহসী আর লয়াল একটা ছেলে পছন্দ করেছে। লয়াল শব্দটা মাথায় আসতেই হাসি আসে নুসাইবার। সিনথিয়ার প্রতি এত অনুগত থাকলে আবার ওর প্রতি কেন এই অবাধ্য আকর্ষণ মাহফুজের। সব ছেলেরাই কি একরকম? ঘরের খেয়ে বাইরেরটাও খেতে চায়?
মাহফুজ টেবিলের সামনে রাখা নড়বড়ে চেয়ারে বসে। জিজ্ঞেস করে কি ব্যাপার হাসছ কেন? নুসাইবা বলে অন্তত ঘরের ভিতর আমাকে আপনি বলতে পার না? মাহফুজ বলে নো, এখানে আমাদের অনেক বড় জিনিস বাজি লাগাতে হচ্ছে, আমাদের প্রাণ। ভুলের কোন জায়গা নেই। রুমের ভিতর আপনি ডেকে হঠাত করে রুমের বাইরে তুমি বলতে গিয়ে যদি গোলমাল পাকিয়ে ফেলি। নুসাইবার কাছে কোন এন্সার নেই। মাহফুজ বলে ধরে নেন আমরা মেথড এক্টর। অভিনয়টাকেই জীবনের অংশ করে ফেলেছি। নুসাইবা বলে তুমি মেথড এক্টিং চিন তাহলে? গলায় একটা বিস্ময়ের ভাব। মাহফুজ বলে দেখলেন সকালে আপনাকে দেমাগী বলায় রাগ করলেন কিন্তু তোমার ভিতরে সুক্ষ একটা অহংকার সব সময় আছে, যেন বাকি সবার থেকে একটু হলেও ভাল। মেথড এক্টিং চিনব না কেন। কি মনে হয় তোমার সিনথিয়া আমাকে খালি চেহারা দেখে পছন্দ করেছে। নুসাইবা বলে তোমার কথা যখন সিনথিয়া প্রথম বাসায় বলে তখন ও তোমার চেহারার এত প্রশংসা করেছিল আমরা সবাই ভেবেছি একটা সুন্দর কোন চালবাজ ছেলের পাল্লায় পড়েছে সিনথিয়া। মাহফুজ হাসতে থাকে। দম খোলা হাসি। নুসাইবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে এতে হাসার কি হল? মাহফুজ বলে এই প্রথম তুমি কোন সত্য কথা বললে। খাটি সত্য, যেই সত্যের পিছনে কোন এংগেল লুকানো নেই। আমার সম্পর্কে সিনথিয়ার ফ্যামিলি কি ভাবে সিনথিয়ার কাছ থেকে কিছুটা শুনেছি তবে নিজের ফ্যামিলিকে তো সরাসরি কেউ খারাপ বলে না তাই ও সব সময় রেখেঢেকে বলে। আমি আন্দাজ করেছিলাম আমার সম্পর্কে ওর ফ্যামিলির কমেন্ট গুলা এর থেকে ভয়ংকর হবে। আজকে তুমি সেইটাই প্রমাণ করলে কিন্তু সত্য বলার জন্য থ্যাংক্স। নুসাইবা বুঝে ওকে এক প্রকার চালবাজ বলেছে মাহফুজ, যেন ওর সব কথার পিছনে একটা এংগেল থাকে। মন খুলে কিছু বলে না। একটু আহত হয় নুসাইবা, এত খারপ কি ও? মাহফুজ কে জিজ্ঞেস করে তোমার কি মনে হয় আমি আসলেই এমন? মাহফুজ একটু ভাবে। বলে আপনি নিজেও ভাব। আমি যখন প্রথম গেলাম ভার্সিটিতে ক্যারিয়ার ক্লাবে মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়ার জন্য তখন কেন রাজি হয়েছিলেন, নিজেদের প্রসার হবে তাই। আমি সিনথিয়া কে ভালবাসি জানার পর এবং তুমি এই বিষয়ে রাজি না সেটা জেনেও আমাকে ডেকেছ পিকনিক আয়োজনের দ্বায়িত্ব দিতে। এরপর এক মেয়ে কে নিয়ে আসলে যাতে আমি তার প্রেমে পড়ে সিনথিয়া কে ছাড়ি। আরশাদ সাহেবের কূকীর্তি যখন পত্রিকায় আসল তখন আবার আমার শরনাপন্ন হলে। কেন? কারণ তোমার মনে হয়েছে এইসব খবর বের করার আসল লোক আমি। ফটোশূট্যের পর আমাকে বকাঝকা করে চলে গেলে কিন্তু তারপরেও আবার ফেরত আসলে। ঠিক তেমন ভাবে ফ্লোরার দোকানের পর আবার আমার কাছে ফেরত আসলে কেন? মুন্সী আর ম্যানেজার থেকে বাচতে। এইসব যদি তুমি দেখ কেউ করছে তাহলে তুমি তাকে কি ভাববে? নুসাইবা দেখে মাহফুজের কথায় লজিক আছে। এইভাবে ভেবে দেখে নি। আসলেই মনে হচ্ছে বারবার যেন স্বার্থের জন্য মাহফুজ কে ব্যবহার করছে ও। এর মধ্যে বাইরে জোহরা আর আমিনের জোরে জোরে কথার শব্দ আসে। কিছু একটা নিয়ে দুই জনের তর্ক হচ্ছে।