অনঙ্গর অণু পানু (a collection of micro-stories) _ অনঙ্গদেব রসতীর্থ - অধ্যায় ৯১
তরাই
১.
চারদিক কুশায়ার চাদরে মোড়া। তার ভীতর দিয়ে উঁকি মারছে ঢেউ খেলানো ঘন সবুজ।
এমনই সুন্দর সকালে চা বাগানের অপরিসর অলিগলি ভেদ করে, আমি যাচ্ছিলাম উৎরাইয়ের দিকে, কাঁধে বন্দুকটাকে ফেলে।
ইচ্ছে ছিল, দূরের ওই পাইন বনে পৌঁছে, কয়েকটা বুনো তিতির শিকার করব।
২.
হঠাৎ পরিত্রাহি চিৎকারটা শুনতে পেয়ে, চমকে, দাঁড়িয়ে পড়লাম।
একটা মেয়ের গলায় তীব্র আর্তনাদ।
আপনা থেকেই বন্দুকটা আমার হাতে হাত উঠে এল।
কিন্তু আমি বন্দুকের এইম স্থির করবার আগেই, হলুদ শরীরটা তীরের বেগে পালিয়ে গেল আওতার অনেক বাইরে।
আমি তখন দৌড়ে গেলাম পিছনে। দেখলাম, চা গাছের ঝোপের মাঝে, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, পাহাড়ি বস্তির মেয়ে, পঞ্ছি।
৩.
নাক চ্যাপ্টা মেয়েটির মুখটা ভারি সরল। ওর চোখের মণি বাদামি, আর সারা গালে মেচেতার কালো-কালো অসংখ্য স্পট।
ও রোজ বাগান থেকে চায়ের পাতা তুলতে-তুলতে, আমাকে দেখে হাসত। ভারি সরল আর মিষ্টি হাসি ওর। এমন পড়ে পাওয়া খাঁটি সৌজন্য, রোজ-রোজ পাওয়া, সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি এখন আমার ছোট্ট কাঠের ঘরে, একটামাত্র সিঙ্গল খাটটায় এনে শুইয়ে দিয়েছি পঞ্ছিকে।
লেপার্ডটা ঘন চায়ের ঝোপে ঘাপটি মেরে, লুকিয়ে ছিল। বুড়ো লেপার্ড; দাঁতে বিশেষ জোর ছিল না বলে, পঞ্ছির পায়ের মাংস একেবারে ছিঁড়ে নিতে পারেনি। ওর চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে, পালিয়েছিল।
৪.
আমি পঞ্ছির রক্ত মাখা ঘাগড়ার মতো কাপড়টাকে বেশ অনেকখানি তুলে দিয়ে, ওর ফর্সা পা-টাকে সযত্নে আমার কোলের উপর তুলে নিলাম। তারপর তুলোয় ডেটল ঢেলে, আস্তে-আস্তে লাগিয়ে দিতে লাগলাম ওর ক্ষতস্থানে।
ও প্রথমটায় একটু সিঁটিয়ে গেল। তারপর ওষুধের জ্বলনে, মুখটাকে কুঁচকে নিল।
শেষকালে কান্না ভুলে, আবারও ওর সকাল আলো করা হাসিটাকে সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে, আমার দিকে ফিরে তাকাল।
আমি হেসে বললাম: "একটা টেডভ্যাক নিতে হবে কিন্তু। দরকার হলে একটা রেবিসের ইঞ্জেকশনও। পয়সা আছে তোর কাছে? না আমি কিছু দিয়ে দেব?"
৫.
পঞ্ছি আমার কথা শুনে, নীরবে শুধু হাসল।
তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করল: "তু ইখানে রোজ-রোজ কী করতে আসিস রে, বাবুজি?"
আমি হঠাতে কী উত্তর করব, ভেবে পেলাম না। তারপর হেসে বললাম: "তোদের এই কুয়াশা মাখা তরাইয়ের ঘন জঙ্গলের বড়ো প্রেমে পড়ে গেছি রে। তাই তো বার-বার তোদের এই নির্জন উপত্যকায় ছুটে-ছুটে আসি।"
পঞ্ছি আবারও হাসল। সেই শব্দহীন, অথচ ঊজ্জ্বল আলো ছড়ানো হাসিটা।
তারপর নিজের পরণের কাপড়টাকে, আচমকা আরও বেশ খানিকটা উপরে টেনে তুলে দিয়ে, আমার অবাক চোখের সামনে, নিজের অন্তর্বাসহীন, গোপণতম ঢালু ও অরণ্যাকীর্ণ উপত্যকাটাকে, হঠাৎ প্রকটিত করে তুলে, বলে উঠল: "তু যদি হামাদের জঙ্গলকে ইতনা ভালোবাসিস, তো ইসকা স্বোয়াদ ভি আজ জ়ারা চাখকে দেখ লে রে, বাবুজি!"
এরপর আমি ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাথা ডুবিয়ে, নিজের অজান্তেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম!
৬.
আমি ইদানিং চা খাওয়া পুরোপুরি ছেড়ে দিয়েছি।
আমার আরণ্যক জীবনে এখন বন্য মধু ছাড়া, আর অন্য কিছুতেই তৃষ্ণা মেটে না!
২১.০৭.২০২১