বাংলা গল্প- লালপট্টি - অধ্যায় ২

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-70110-post-6018615.html#pid6018615

🕰️ Posted on August 27, 2025 by ✍️ rajusen25 (Profile)

🏷️ Tags: None
📖 2238 words / 10 min read

Parent
ভোরের কোমল আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছে, যেন সোনালি রেশমের আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে বারান্দার টেবিলে। চায়ের কাপে পড়া রোদের ঝিলিক দেখে মনে হচ্ছিল কেউ গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে তরল স্বর্ণ। টুকুন বসে আছে মায়ের পাশে - মুনমুন সেনের হাতের চায়ের কাপ থেকে উঠছে মিষ্টি গন্ধের ভাপ, ঠোঁটে লেগেছে স্নেহের হাসি। "একি! আমার ছেলের চোখে আজ এমন আলাদা আভা?" মা মিষ্টি সুরে বললেন, আঙুল দিয়ে টুকুনের কপাল ছুঁয়ে দিলেন, "কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছিস নাকি?" টুকুনের গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ল, চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে হাসি চেপে রাখতে পারল না। "ওমা, তুমি তো! সেদিন সিঙ্গুরে যা হয়েছিল, সবটা বলিনি তোমায়..." মুনমুনের কপালে ভাঁজ পড়ল, ঠোঁটের কোণে জমে থাকা চায়ের ফোঁটা শুকিয়ে গেল। "কিছু বিপদ হয়েছিল নাকি?" "বিপদ নয় মা," টুকুন গভীর নিঃশ্বাস নিল, "একটা জীবন বদলে দেওয়ার মতো মুহূর্ত।" সে বলতে শুরু করল - ইসমাইল চাচার গল্প, নর্দমায় ভেসে যাওয়া মাছের পোনা, আমিনা খালার কৃতজ্ঞ চোখ, লালপট্টির মাটির গন্ধমাখা গ্রামের কথা। প্রতিটি শব্দ যেন মুনমুনের বুকে গরম লোহার মতো গেঁথে যাচ্ছিল। গল্প শুনতে শুনে মুনমুনের চোখ ভিজে উঠল, ঠিক যেমন বর্ষার নদী ভেসে ওঠে আকাশের জল নিয়ে। তিনি টুকুনের হাত নিজের কোমল হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, "আমার ছেলে... তুই সত্যিই বড় হয়ে গেছিস!" গলায় ছিল গর্বের মধুর ভার। "এভাবেই মানুষকে সাহায্য করতে হয় বাবা। যাদের হাসির জন্য সামান্য এক মুঠো আলোও যেন দুর্লভ..." টুকুন মাথা নিচু করে হাসল, যেন প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া নিমগাছের ডাল। মুনমুন আবার বললেন, "ওদের খবর রাখিস তো? টাকা-পয়সার দরকার হলে আমাদের বলিস। আমরা যতই স্বচ্ছল হই না কেন, ওই মানুষগুলোর কষ্টের তুলনায় আমাদের অভাব কিছুই না।" টুকুন গম্ভীর হয়ে বলল, "পরের সপ্তাহে বন্ধুদের সাথে বাইক রাইডে যাচ্ছি... ভাবছি লালপট্টি গ্রামে একবার ঘুরে আসি। কেমন মনে হয় মা?" মুনমুনের মুখে যেন আলোর ঝিলিক খেলে গেল, ঠিক যেমন সন্ধ্যায় পুকুরে পড়া শেষ রোদের ছটা। "অবশ্যই যাবি!" তিনি বললেন উৎসাহে ভরপুর গলায়। "কিন্তু শুধু ঘুরে আসবি না... কিছু কাজের জিনিস নিয়ে যাবি।" বলে তড়িঘড়ি নিজের পার্স থেকে এক গুচ্ছ নোট বের করে টুকুনের হাতে গুঁজে দিলেন। "এটা ওদের জন্য - নতুন কাপড়, কিছু শুকনো খাবার... দেখবি কত খুশি হবে!" টুকুন হেসে উঠল, "মা, এত তাড়াতাড়ি কেন? এখনই তো রওনা হচ্ছি না!" মুনমুন ফিরে তাকালেন, তার চোখে মায়ার পাশাপাশি দৃঢ়তা। "তবু প্রস্তুতি তো আগে থেকেই রাখতে হয়! আর শোন..." - তিনি টুকুনের কাছেই আরও কাছে সরে বসলেন, "ইসমাইল চাচাদের জন্য নতুন মাছের পোনা কিনে নিয়ে যাস। গতবারের সেই দুর্ঘটনার ক্ষতি যেন কিছুটা পুষিয়ে দিতে পারিস।" টুকুন মায়ের এই ভাবনায় মুগ্ধ হয়ে বলল, "তুমি ঠিকই বলেছ মা। আমি ওই মাছের বাজার চিনি, যাওয়ার আগেই মাছের পোনা কিনে নেব।" দুএকদিন কেটে গেল। আজ ভোরের আলো ফোটার আগেই টুকুনের ঘুম ভেঙে গেল। জানালার বাইরে তখনও রাতের আঁধার কাটেনি, শুধু দূরে পূর্বাকাশে একফালি রক্তিম আভা দেখা দিচ্ছে, যেন কেউ আগুনের রেখা টেনে দিয়েছে নীল ক্যানভাসে। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু শোনা যাচ্ছে দেয়ালঘড়ির টিকটিক শব্দ। টুকুন বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে তাকাল সিলিং-এর দিকে। হঠাৎ মনে হলো - "আজ কলেজে যাওয়া হবে না। আজ তো লালপট্টি ঘুরে আসাই যায়!" সে উঠে বসল, পায়ে ঠাণ্ডা মেঝের স্পর্শ লাগতেই গা শিরশির করে উঠল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখল, গাছের ডালে বসা একটা পাখি ঠিক তখনই ডানা মেলল, যেন তার মনের কথাটাই আগে থেকে জেনে নিয়েছে। "আজ বাড়িতেও তো কেউ নেই..." - মনে মনে ভাবল টুকুন। বাবা আর মা দুজনেই বেড়াতে গেছেন। পুরো বাড়িটা আজ শুধু তারই। টুকুন দ্রুত প্রস্তুত হতে লাগল। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে সে ব্যাগে ইসমাইল চাচা আর আমিনা খালার জন্য কেনা নতুন কাপড় আর কিছু জরুরি জিনিস - এক বোতল জল, আর মায়ের দেওয়া সেই টাকার আর আমিনা খালার জন্য দেওয়া সাজার জিনিস, যা সে লালপট্টির গরিব পরিবারের জন্য রেখেছিল। বাইক চাবি হাতে নিয়ে টুকুন দরজা খুলতেই বাইরে এসে লাগল এক ঝাঁক ঠাণ্ডা হাওয়া, যেন প্রকৃতি তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সে হেলমেটটা মাথায় পরতেই ভাবল - "আজকের দিনটা একটু অন্যরকমই যাবে!" ইঞ্জিন স্টার্ট দিতেই বাইকের গর্জনে ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল, ঠিক যেমন ভাঙে ভোরের শিশিরফোঁটা পায়ের নিচে। টুকুন গতি বাড়াল, রাস্তা পেরোতে পেরোতে মনে হচ্ছিল, আজকের এই স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত হয়তো কোনো বড় পরিবর্তনের শুরু...। টুকুনের চেনা সেই সবুজে ঘেরা গ্রামের সরু রাস্তায় বাইক ছুটে চলেছে লালপট্টির উদ্দেশে। চারপাশে ধানের ক্ষেত, মাঝে মাঝে পুকুরের জলে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে। বাতাসে ভাসছে মাটির গন্ধ, আর দূর থেকে শোনা যাচ্ছে গ্রাম্য মেয়েদের কলরব। টুকুন বাইকটা ইসমাইলের বাড়ির আমগাছের ছায়ায় থামতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আমিনা বেগম - শ্যামলা রঙের শরীরে সাদা শাড়ির আঁচল উড়ছে হালকা বাতাসে। তার হাতে সবুজ চুড়ি, ঠোঁটে লেগেছে বিস্ময়ের হাসি। "আসসালামু আলাইকুম, বাবু!" আমিনা বেগম নিজের দুই হাতের তালু নিজের দুই গালে ধরে, যেন স্বপ্ন দেখছে। "এত সকালে? আল্লাহ, কত ভালো মানুষ আপনি!" টুকুন হেসে উত্তর দিল, "নমস্কার, খালা! আজ একটু সময় পেয়েছি, তাই চলে এলাম।" আমিনা বেগমের মুখে তখন এক ধরনের লাজুক উচ্ছ্বাস। তিনি টুকুনকে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তার হাতের স্পর্শে একটু কাঁপুনি - যেন কোনো দেবদূতকে স্পর্শ করার ভয়। "বাবু, তুমি আসবে জানলে তোমার ইসমাইল চাচাকে বাড়িতে থাকতে বলতাম!" তার কণ্ঠে ছিল এক ধরনের অনুতাপ, চোখের কোণে জমে থাকা জল যেন বলছিল - "পাশের গ্রামে মাছ ধরতে গেছে, তুমি এত দূর থেকে এসে খালি হাতে ফিরে যাবে!" রান্নাঘরের ঠাণ্ডা মেঝেতে পিঁড়ি পাতা। টুকুন বসতে যেতেই আমিনা বেগম তড়িঘড়ি নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে পিঁড়িটা মুছে দিলেন - একটা ধুলোর কণাও যেন ছেলেটার পোশাক নষ্ট না করে। তারপর নিজের হাতের তালু দেখলেন - ময়লা, তেল-মাটির দাগ। লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, "বাবু, তুমি বসো... আমি হাতটা একটু ধুয়ে আসি।" টুকুন পিঁড়িতে বসে পড়ল, আর ব্যাগটা খুলে বের করল নতুন কাপড়, প্যাকেটবন্দি মিষ্টি, চাল-ডালের প্যাকেট। আমিনা বেগমের চোখ ছলছল করে উঠল। তিনি টুকুনের হাত চেপে ধরলেন, "বাবু, এত কিছু... আমরা তো..." - কথা শেষ করতে পারলেন না। তার গলার স্বর ভেঙে গেল, যেন কেউ তার কণ্ঠে জড়িয়ে দিয়েছে বৃষ্টিভেজা সুতো। টুকুন হাসল, "খালা, এগুলো মা পাঠিয়েছেন। তোমার জন্য সাজার জিনিসও দিয়েছে, দেখো!" - বলে সে ব্যাগ থেকে বের করল রঙিন কৌটোয় মোড়া একটি সিন্দুক, যার ভেতর লুকিয়ে আছে শহুরে রূপচর্চার ছোঁয়া। আমিনা বেগমের চোখ দিয়ে তখন অবাধ্য জল গড়িয়ে পড়ছে, যেন বর্ষার প্রথম ধারার মত স্বচ্ছ। তিনি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, "তোমার আম্মা... জান্নাতের ফেরেশতা," - তার কণ্ঠে ভেসে এল এক অদ্ভুত মিশেল, কৃতজ্ঞতা আর লজ্জার সমন্বয়। তাড়াতাড়ি চুলায় হাঁড়ি চাপিয়ে দিলেন আমিনা বেগম। কাঠের আগুনে লালচে হয়ে উঠছে মাটির চুলা, আর তারই আলোয় আমিনার মুখে খেলছে এক আশ্চর্য আভা। টুকুন ততক্ষণে সব জিনিস গুছিয়ে রেখেছে - নতুন কাপড়গুলো ইসমাইল চাচার লুঙ্গি, গামছা, আমিনা খালার শাড়ি, ব্লাউস। চায়ের কাপে ভাঁটা দুধের গন্ধ মিশে যাচ্ছে এলাচ আর লবঙ্গের সুবাসে। আমিনা বেগম টুকুনের সামনে চা রাখলেন সাবধানে, যেন কোনো পবিত্র অর্ঘ্য দিচ্ছেন। "বাবু, একটু চেখে দেখো, ঠিক হয়েছে তো?" টুকুন এক চুমুক নিয়ে বলল, "খালা, এত মিষ্টি চা তো শহরে পাই না!" আমিনা বেগমের মুখে ফুটে উঠল এক গভীর তৃপ্তির হাসি। তিনি নিজের চায়ের কাপ নিয়ে টুকুনের পাশে বসে পড়লেন, মাটির ঠাণ্ডা স্পর্শ পায়ে লাগতেই একটু শিহরিত হয়ে। "বাবু, কলকাতার গল্প বলো তো," - আমিনা বেগমের চোখে কৌতূহল জ্বলছে, "সেখানে কি আমাদের মত গরীব মানুষও থাকতে পারে?" টুকুন গল্প শুরু করল - রিকশাওয়ালা করিম চাচার কথা, যার ছেলে ডাক্তার হয়েছে; পাড়ার মিনি মার্কেটের মালা দিদির সংগ্রামের কথা। আমিনা বেগম মাঝে মাঝে অবাক হয়ে বলে উঠছেন, "আল্লাহ! সত্যি নাকি?" টুকুনের গল্প থেমে গেল। আমিনা বেগমের কথায় ঘরটা যেন একদম নিঝুম হয়ে এল। চুলার আগুনের শব্দটাই কেবল শোনা যাচ্ছে, যেন কেউ ফিসফিস করছে। আমিনা বেগমের হাত থেকে চায়ের কাপ নামল। তার চোখ দুটো হয়ে গেল ভিজে ভিজে, ঠিক যেমন ভিজে যায় বর্ষার মাটির পথ। "আমাদের পোলাপাইন হইলো না বাবু," তিনি বললেন, গলার স্বর একটু কেঁপে কেঁপে, "একটা পোলাপাইন হইলে সব দুঃখ কষ্ট দূর হইতো!!" "খালা..." টুকুন কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার মনে পড়ল কলকাতার বাড়ির কথা - মায়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়া, বাবার সাথে ক্রিকেট খেলা। এইসব সাধারণ মুহূর্তগুলোই তো কারো কারো জন্য স্বপ্ন! আমিনা বেগম তড়িঘড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেললেন। "মাফ করো বাবু, আজ তুমি এত ভালো কথা বলছো, আর আমি..." টুকুন ইতস্তত করে বলল, "খালা, ইসমাইল চাচা বা আপনি ডাক্তার দেখিয়েছেন? আজকাল তো অনেক চিকিৎসা আছে!" আমিনা বেগমের মুখে হঠাৎ আশার আলো খেলে গেল, "ডাক্তার? আমাদের মতো গরীবের পক্ষে কি তা সম্ভব বাবু?" টুকুন দৃঢ়ভাবে বলেছিল, "আমার বাবা তো নামকরা ডাক্তার। আমি আজই ফোন করে জেনে নেব কোন বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। খরচের চিন্তা করবেন না খালা!" কিন্তু আমিনা বেগমের মুখে তখন এক অদ্ভুত ভয়। তিনি আরও উদাস হয়ে বললেন, "ডাক্তারের কাছে এইসব সমস্যা নিয়ে আমরা যদি যাই, তাহেল আমাদের নাক কাটা যাবে বাবু। মোল্লারা আমাদের ছাড়বেনা..." তার কণ্ঠে ছিল এক গভীর আশঙ্কা, যেন সামনে কোনো অদৃশ্য শক্তি দাঁড়িয়ে আছে। টুকুন অবাক হয়ে বলল, "মোল্লাদের বলার কি দরকার? এটা তো আপনাদের ব্যক্তিগত বিষয়!" আমিনা বেগম মাথা নেড়ে বললেন, "না বাবু, ওরা ঠিক জাইনা যাইবো।" তার চোখে তখন এক অদ্ভুত জেদ, যেন শতাব্দীর পুরনো বিশ্বাসে আটকে থাকা এক অবিচলতা। "তোমার ইসমাইল চাচা এমনিতে খুব ভালো মানুষ, কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাইবো না। এ গ্রামের নিয়ম এ রকম না।" টুকুন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, "তাহলে সমস্যা কি করে মিটবে খালা? তোমরা তো বাচ্চা এডপ্ট করে নিতে পারো..." আমিনা বেগমের মুখে হঠাৎ এক অদ্ভুত ভাব ফুটে উঠল। তিনি টুকুনের দিকে তাকালেন, যেন এই সম্ভাবনা কখনো তার মাথায় আসেনি। "এডপ্ট?" তিনি বললেন, শব্দটাকে যেন চিবিয়ে চিবিয়ে স্বাদ নিচ্ছেন, "আমরা গরীব মানুষ বাবু, আমাদেরকে কে বাচ্চা দিবে?" তার কণ্ঠে ছিল এক গভীর নিরাশা, যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা হতাশার স্তর ভেঙে বেরিয়ে এল। টুকুনের মুখে এক ধরনের অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। সে যেন হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো করে বলল, "খালা, কোনো সাহায্য আমি করতে পারলে বলো..." আমিনা বেগমের গলায় কাঁপুনি নেমে এল, "তোমার ইসমাইল চাচা তো বলে—'বাবু এলে আদর যত্ন করতে, আজ তো বাড়ি নেই, কি যে খাওয়াই তোমাকে, বাবু!'" তার চোখের কোণে জমে থাকা জল রোদের আলোয় ঝিলিক দিল। টুকুন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "খালা, তুমি একটু সেজে গুজে থাকো আর মন ভালো রাখো... দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে!" তার কণ্ঠে ছিল উচ্ছ্বাস, "তোমার তো বয়স বেশি না!" আমিনার শ্যামলা শরীরে একটা আলতো কাঁপুনি বয়ে গেল। তার অগোছালো শাড়ির আঁচলটা নিজেই না জেনে একটু টান দিলেন, যেন গোছাতে চাইলেন। এই সুঠাম বাঙালি যুবকের কথায় তার বুকের ভেতর অজানা একটা তোলপাড় শুরু হলো। "আচ্ছা বাবু..." আমিনা বেগমের গলা থেকে বেরিয়ে এল মৃদু স্বর, মুখটা লজ্জায় ঘুরিয়ে নিলেন, কিন্তু তার চোখের কোণে জ্বলজ্বল করছিল এক অজানা আগুন। সবুজ চুড়িগুলো ঠনঠন করে উঠল, যেন তার ভেতরের অশান্তির প্রতিধ্বনি। টুকুনের গলায় হঠাৎ শুকনো ভাব চলে এল। সে তাড়াতাড়ি কথাটা সামলে নিতে চাইল, "মানে... মানে খালা, তুমি এখনো একদম যুবতীর মত..." হাতটা সামনে বাড়িয়ে আবার টেনে নিল, "তোমাদের জন্য কিছু করতে পারলে বোলো..." হঠাৎই সে উঠে দাঁড়ালো। "খালা, আমি চলি আজ," বলল টুকুন, গলায় একধরনের তাড়াহুড়ো, "ইসমাইল চাচা এলে বোলো আবার কোনোদিন সময় পেলে আসবো।" আমিনা বেগম পিছন ফিরলেন। সকালের রোদ এসে পড়ল তার শ্যামলা গালে, চোখের দীপ্তিটা আরও তীব্র হয়ে উঠল। "আচ্ছা বাবু... আসবেন বাবু,"। বাইকে চড়ে টুকুন যখন রওনা দিল, তখন তার পিছন থেকে আমিনা বেগমের দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল, "আল্লাহ, এই ছেলেটাকে ভালো রাখো..." গ্রামের পথ ধরে বাইক ছুটছে, কিন্তু টুকুনের পিছনে থেকে যাচ্ছে এক অদ্ভুত ভার। আমিনা বেগমের সেই শেষ দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে ছিল না-বলা আকাঙ্ক্ষা, মাতৃত্বের ইচ্ছে, আর নারীর ভালোবাসার এক আশ্চর্য মিশেল। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখল আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন আমিনা বেগম, হাতটা একটু উঁচু করে নাড়ছেন। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে সেই ছবিটা ঝাপসা হয়ে এল, কিন্তু টুকুনের মনে গেঁথে রইল এক অম্লান ছবি - সাদা শাড়ি, সবুজ চুড়ি, আর চোখের সেই অদ্ভুত দীপ্তি, যে দীপ্তির অর্থ হয়তো কখনোই সে পুরোপুরি বুঝতে পারবে না। বাইকের হ্যান্ডেলে টুকুনের আঙুলগুলো সাদা হয়ে শক্ত হয়ে গেছে। পথের ধারের ধানখেতের সবুজ ঝাপসা হয়ে আসছে চোখে - যেন তারই অশ্রুতে ভেজা দৃষ্টি। আমিনা খালার কথা ভাবতে ভাবতে বুকে এক অদ্ভুত বেদনার ভার। হঠাৎই মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেই ছবি - আমিনা খালার শ্যামলা দেহ, মাটির গন্ধমাখা হাত, আর চোখের সেই ক্ষুধা... শুধু সন্তানের জন্য নয়, যেন জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তির ক্ষুধা। "যদি একটু সাজগোজ করে..." মনের ভিতর থেকে মায়ের কণ্ঠ ভেসে এল: "মানুষকে সাহায্য করতে হয় বাবা। যাদের হাসির জন্য সামান্য এক মুঠো আলোও যেন দুর্লভ..." টুকুনের ঠোঁট কাঁপল। এক অদ্ভুত চিন্তা মাথায় খেলে গেল: "সত্যিই তো... আমিনা বেগম আর ইসমাইল চাচা যদি চায়... আমার বীর্যে... আমিনা খালার সেই শেষ দৃষ্টি, চোখের কোণে জমে থাকা জল - যদি সুখ পায় ওরা!!" লালপট্টি গ্রামে ইসমাইল চাচা বাড়ি ফিরেছে। আমিনা বেগম হাসিমুখে দৌড়ে গিয়ে বলছে, "আজ বাবু এইসেছিলো গো... দেখো কত জিনিস নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য... ইনশাল্লাহ... বাবু আমাদের জন্য আল্লাহর ফেরেশতা..." ইসমাইলের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, "বলো কি! বাবুকে আজ থাকতে বলতে পারলেনা?" আমিনার মুখে একটু লজ্জার আভা, "বাবু তো হঠাৎই চলে গেল... যাওয়ার সময় বলল, 'খালা মন ভালো রাখো'..." ইসমাইল আমিনার দিকে তাকাল। বছর ত্রিশের এই স্ত্রীর মুখে আজ এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা। তার শ্যামলা গালে লালচে আভা, চোখে এক ধরনের প্রাণচাঞ্চল্য যা বহুদিন দেখা যায়নি। "তুমি আজ একটু আলাদা দেখাচ্ছ..." ইসমাইল বলল। আমিনা তড়িঘড়ি মুখ ঘুরিয়ে নিল, "কিছু না... বাবু এত ভালো ব্যবহার করল... মনে হচ্ছিল..." ইসমাইল স্ত্রীর হাত ধরে বলল, "আমিনা, আমরা কি বাবুকে বলি... সে যদি..." আমিনার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, "না না... সে তো বাঙালি বাবু... কলেজে পড়ে... কত ভালো মানুষ.. সে কি করে হয়..." তার গলার স্বরে এক ধরনের সংকোচ, "আর তোমার কি ভালো লাগবে..." ইসমাইল আমিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "অন্য কেউ হলে বলতাম না। বাবু এতো ভালো মানুষ..." তারপর একটু মজা করে যোগ করল, "আর বাঙালি তো কি হয়েছে? সবাই তো আকাট জন্মায়, খাৎনা করে জাত পরিবর্তন করা হয়!" আমিনা লজ্জায় ইসমাইলের বুক ঠেলে দিল, "ইস.. তুমি না খুব ইতর হইছো!" কিন্তু তার চোখের কোণে খেলে গেল এক ঝিলিক। দিনগুলো এখন আমিনা বেগমের জন্য নতুন রূপে সেজে উঠেছে। টুকুনের মায়ের পাঠানো সেই সাজের বাক্সটি এখন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। প্রতিদিন সকালে পুকুরের জলে মুখ ধোয়ার পরই সে বসে পড়ে ছোট্ট আয়নার সামনে। মুখে লাগায় হালকা স্যান্ডেলউডের পাউডার, যেটা তার শ্যামলা গালে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা আনে চোখের কোণে টানে সূক্ষ্ম কজল, যে রেখাগুলো তার বয়সের ছাপকে যেন লুকিয়ে ফেলে হাতে পরে সবুজ চুড়ি, যেগুলো এখন আর শুধু কাজের সময় ঠনঠন করে না, বরং টুকুন এলে বিশেষভাবে বাজে ইসমাইল চাচা মাঝে মাঝে মৃদু তামাশা করে, "আজকাল তো আমার বেগম দেখতে শহরের মেমসাহেবের মতো!" আমিনা তখন লজ্জায় মুখ ঢেকে বলে, "চুপ কর, একটু সাজতেও দেবে না!" -চলবে
Parent