বাংলা গল্প- লালপট্টি - অধ্যায় ২৩

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-70110-post-6040776.html#pid6040776

🕰️ Posted on September 22, 2025 by ✍️ rajusen25 (Profile)

🏷️ Tags: None
📖 3252 words / 15 min read

Parent
কলেজের গেট পেরিয়েই টুকুনের মনে হলো যেন ভয়ানক কোন ঝড় এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে, আর এখন তার নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। দু’সপ্তাহ কেটে গেছে সেই উত্তাল ঘটনার পর। কলেজের ইমারতগুলো যেন আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে, রোদে তার দেয়াল গরম হয়ে উঠেছে। ভেতরে এখন পুরোদমে ক্লাস চলছে, এক classroom থেকে আরেক classroom-এ অধ্যাপকদের গমগমিয়ে ওঠা গলা, পড়ার চাপে ছাত্রছাত্রীদের মাথা ঘামাতে ঘামাতে চলাফেরা, আর ক্যান্টিনে গল্প-গুজবের শেষ নেই! অমর কাকাকে প্রমোশন দিয়ে সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার বানানো হয়েছে। নতুন করে দু’জন তরুণ-সবল গার্ড নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, আর পুরনো ঝাপসা সিসি টিভি ক্যামেরাগুলোর বদলে লাগানো হয়েছে ঝকঝকে হাই-রেজোলিউশনের ক্যামেরা, যেন চোর-বাটপারদের চোখে চোখ রেখেই তাকিয়ে থাকে! টুকুনও আস্তে আস্তে তার পুরনো রুটিনে ফিরে এসেছে—সকাল সকাল ক্লাস, তারপর ল্যাবে প্র্যাকটিক্যাল, আর সন্ধ্যেবেলা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। সেদিন সকালবেলা। টুকুন ক্লাসরুমে বসেছে। ক্লাসের কাঁচের জানালা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে তার ডেস্কের উপর। অধ্যাপক মহাশয় ব্ল্যাকবোর্ডে একের পর এক জটিল অঙ্ক কষিয়ে চলেছেন, খড়খড় করে চক ঘষার শব্দ হচ্ছে। ঠিক সেই সময়ই টুকুনের শার্টের পকেটে টনটন করে কাঁপুনি উঠল—তার মোবাইল ফোনটি ভাইব্রেট হতে লাগল। সাইলেন্ট মোডে রাখা সত্ত্বেও ফোনটা যেন জোরেই কাঁপছে। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে একটি একদম অচেনা নম্বর। টুকুন সাধারণত ক্লাসের মধ্যে ফোন ধরতে যায় না, কিন্তু সেদিন অজানা একটা কারণে তার গা ছমছম করে উঠল, মনে হলো ফোনটা নিতেই হবে। সে অধ্যাপক মহাশয়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে করিডোরের দিকে এগিয়ে গেল। ফোনের রিসিভ বোতামে আঙুল চাপতেই— "হ্যালো?" — টুকুন একটু অনিশ্চিত গলায় বলল। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে একটা দৃঢ়, কর্তৃত্বপূর্ণ, কিন্তু কিছুটা ক্লান্ত গলা ভেসে এল, "হ্যালো, টুকুন? আমি সল্ট লেক থানা থেকে ওসি আনিসুর রহমান বলছি।" থানার ওসির নাম শুনে টুকুনের বুকটা একবার দুরুদুরু করে উঠল। গলায় একটু খড়িমাটি লাগার মতো অনুভূতি! "হ্যাঁ, স্যার। বলুন।" ওসির কণ্ঠে কোনও বাড়তি ভাবের ছাপ ছিল না, শুধুই রুটিন কাজের একটা গম্ভীর সিরিয়াস ভাব, "তোমাকে কাল থানায় আসতে হবে, সকাল দশটায়।" "কেন, স্যার? কী বিষয়?" — টুকুনের কণ্ঠে কৌতূহল আর একটুখানি উৎকণ্ঠা মিশে থাকল। "সবকিছু এখানে এসেই বুঝতে পারবে। বিষয়টা হলো সেই কম্পিউটার চুরির কেস। আমাদের কিছু ক্লিয়ারেন্স দরকার।" — ওসি বাড়তি কোনও কথা না বলে সোজাসুজি বলে দিলেন, "কাল সকাল দশটা। সময় মেনে আসতে হবে।" "ঠিক আছে স্যার, আমি ঠিক সময়ে হাজির হব।" — ফোন কাটার পর টুকুন কিছুক্ষণ করিডোরেই দাঁড়িয়ে রইল। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল নানা রকমের প্রশ্ন—‘কেস তো প্রায় সলভ হয়ে গেছে? চোরেরা ধরা পড়েনি বটে, কিন্তু আমাকে আবার ডাকার কারণ কী? ওসি নিজে সরাসরি ফোন করছেন? এটা কি শুধুই ক্লিয়ারেন্স নেওয়া, নাকি আরও কিছু গভীর ব্যাপার আছে?’ সেই দুপুরেই টুকুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাহুলকে সব কথা খুলে বলল। রাহুলের প্রতিক্রিয়া ছিল একদম স্পষ্ট আর সোজা। "ওসি নিজে ফোন!? ওরে বাবা! এটা তো সাধারণ কোনও বিষয় হতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও নতুন সূত্র পেয়েছে পুলিশ! নাহলে ওসি সাহেব নিজে ফোন করবেন কেন ভাই?" পরদিন সকাল দশটার ঠিক এক মিনিট আগে, টুকুন সল্ট লেক থানার সামনে দাঁড়িয়ে। থানার ভেতরকার জবরদস্ত কর্মব্যস্ততা, আসা-যাওয়া, মানুষের হাহাকার—এসব দেখে তার একটু চিন্তা হচ্ছিল। একজন ইউনিফর্ম-পরা কনস্টেবল তাকে ওসি সাহেবের রুম পর্যন্ত নিয়ে গেল। ওসি আনিসুর রহমান তার ডেস্কে বসে একটি মোটা, পুরনো ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। তিনি টুকুনকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তাঁর চেহারায় স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ, চোখের নিচে কালি, কিন্তু চোখ দুটো স্থায়ী সজাগ। "টুকুন, আমরা তোমাকে আবারও ধন্যবাদ জানাই। তুমি না হলে আমরা ভুল মানুষকে সন্দেহ করতাম," — ওসি কথা শুরু করলেন। — "কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা যে তিন সন্দেহভাজনের সঠিক পরিচয় এখনও পাইনি।" টুকুন একটু অবাক হয়ে তাকালো। "সিসি টিভির ফুটেজ তো খুব পরিষ্কার ছিল, স্যার! সব তো দেখা গিয়েছিল!" ওসি একটু হালকা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, "হ্যাঁ, ফুটেজ পরিষ্কার ছিল। কিন্তু ওই তিনজন লোকের মুখ ঠিকঠাক দেখা যায়নি। তারা খুব চালাক ছিল। তারা ক্যামেরার সোজা অ্যাঙ্গেলে খুব কম এসেছে। আমরা ফুটেজটা এনহ্যান্সও করিয়েছি, কিন্তু তাদের চেহারা স্পষ্টভাবে চিনতে পারার মতো করে ওঠেনি।" ওসি তার ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে টুকুনের দিকে করলেন। মনিটরে সেই ফুটেজটি চালু করলেন। টুকুন নিবিষ্ট হয়ে দেখল। সত্যিই, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা তিনজন লোকের মুখ একদমই ঝাপসা, উপরন্তু আলো-আঁধারের খেলা। তারা ইচ্ছে করেই মাথা নিচু রেখে কাজ করছে, জানেশুনে ক্যামেরা এড়িয়ে চলছে। "আমরা তোমাকে ডেকেছি এই কারণেই," — ওসি গম্ভীর হয়ে বললেন। — "তুমিই একমাত্র মানুষ যে ফুটেজটা এত গভীরভাবে দেখেছিলে। তোমার দেখার ক্ষমতা অসাধারণ। হয়তো তোমার স্মৃতিতে এমন কোনো ছোট্ট খুঁটিনাটি বিষয় আছে, যা ফুটেজে ধরা পড়েনি, অথবা তুমি ওই তিনজনের হাঁটাচলার ভঙ্গি, শরীরের ভাষা, বা কোন বিশেষ অভ্যাস লক্ষ্য করেছ, যা আমাদের ওই সন্দেহভাজনদের চিনতে সাহায্য করতে পারে।" টুকুন চুপ করে সেই দিনটির কথা মনে করতে লাগল, ফুটেজের একেকটা ফ্রেম যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকল। তারপর হঠাৎই, তার মাথায় একটা কথা খেলে গেল! "স্যার! একটা জিনিস!" — টুকুন উত্তেজিত হয়ে উঠল, "সেই দিন আমি প্রথমে যে ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছিলাম, তাতে একটা ঘটনা হয়েছিল! যখন অমর কাকা ল্যাবে ঢুকছিলেন, ঠিক তখন একটা ক্যামেরা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে?" "হ্যাঁ, মনে পড়ছে," — ওসি বললেন। "ওসি স্যার, সেই বিশেষ ক্যামেরাটা বন্ধ হওয়ার সময়, তার স্ক্রিনে এক সেকেন্ডের জন্য একটা রিফ্লেকশন ধরা পড়েছিল! মনে হয় পাশের কাচের আলমারিতে রিফ্লেক্ট হয়ে একটা মানুষের হাত দেখা গিয়েছিল, যার কবজিতে একটা স্পষ্ট ওয়াচ বা ব্রেসলেট ছিল! আমি তখন সেটা দেখেছিলাম, কিন্তু পরে মূল ঘটনা বলার সময় সেটা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলাম!" ওসি হঠাৎই সোজা হয়ে বসে পড়লেন, ক্লান্তি যেন উড়ে গেল। "রিফ্লেকশন? তুমি নিশ্চিত? সেই ফুটেজটা এখনও আমাদের কাছে আছে।" "হ্যাঁ স্যার, একদম নিশ্চিত! সেটা খুব তড়িঘড়ি হয়েছিল, কিন্তু আমি দেখেছিলাম। একটা ধাতুর ব্রেসলেট-এর মতো কিছু, যাতে একটা বড়, চৌকো ডায়াল বা চার্ম ছিল!" ওসি তৎক্ষণাৎ তার একজন সাব-অফিসারকে ডাকলেন এবং সেই সঠিক ফুটেজটি আনতে বললেন। কয়েক মিনিট পরে, তারা ফ্রেম বাই ফ্রেম সেই ফুটেজ দেখতে শুরু করল। আর তখনই, অসম্ভবটা ঘটে গেল! ঠিক যেমনটা টুকুন বলেছিল, ক্যামেরা বন্ধ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তের সেই ফ্রেমে, কাচের আলমারিতে প্রতিফলিত হয়ে একটা মানুষের হাত স্পষ্ট দেখা গেল। বাঁ হাতের কবজিতে আঁটসাঁট করে পরা ছিল একটা মোটা, সাদা রঙের ধাতুর ব্রেসলেট, যার একদম মাঝখানে বড়সড় একটা চৌকো নীলকান্ত পাথর (বা নকল পাথর) ঝলমল করছিল! কিন্তু তার চেয়েও বেশি, যা চোখে পড়ার মতো – সেই হাতে পাঁচটা নয়, বরং ছয়টা আঙ্গুল ছিল! একটা এক্সট্রা আঙ্গুল স্পষ্টই দৃশ্যমান ছিল! "পেয়ে গেছি!" ওসি আনিসুর রহমান উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, "টুকুন, এই ডিটেইলটা আমরা একদম মিস করেছিলাম! এই ব্রেসলেট আর এই অনন্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যই এখন সবচেয়ে বড় সূত্র! এই দুটো জিনিস একসাথে আছে, এমন মানুষকে খুঁজে বের করা অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে সহজ হবে!" ওসি টুকুনের কাঁধে হাত রেখে বললেন, "তুমি সত্যিই জন্মসূত্রে Investigator! এই একটা সূত্র পুরো কেসটাই উল্টে দিতে পারে!" টুকুন থানা থেকে বেরিয়ে এল, কিন্তু তার মনটা খুব অস্থির হয়ে উঠল। এই ব্রেসলেটটা, আর বিশেষ করে সেই ছয় আঙ্গুলওয়ালা হাত... ওই অস্বাভাবিক কম্বিনেশনটা সে কোথায় যেন দেখেছে! খুবই চেনা চেনা লাগছে! কিন্তু ঠিক কোথায়, কখন – সেটা সে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। মাথার ভেতর যেন একটা কিছু লাফিয়ে পড়তে চাইছে, কিন্তু স্মৃতিটা ধরা দিচ্ছিল না। টুকুনের মাথায় দিনের পর দিন ঘুরতে লাগল শুধুই সেই ব্রেসলেটের ছবি। সে একদম নিশ্চিত, এই অদ্ভুত ডিজাইনের ব্রেসলেটটা সে আগেও দেখেছে। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও কিছুতেই মনে পড়ছিল না কোথায় দেখেছে। পুরো একটা সপ্তাহ ধরে সে নানা জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছে, নিজের পুরনো অ্যালবাম থেকে শুরু করে কলেজের বিভিন্ন কোণায় চোখ বুলিয়েছে, তবুও কোন কিনারা পায়নি। হঠাৎ একদিন, তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। স্থানীয় পুরনো সংবাদপত্রগুলোতে কি কিছু পাওয়া যায়? সঙ্গে সঙ্গে সে কলেজ লাইব্রেরির নিচতলায়, ধুলোয় ভরা পুরনো পত্রিকার স্তূপের কাছে হাজির হল। একের পর এক পত্রিকা উল্টে পেছনের তারিখের দিকে যেতে থাকল সে। তারপরই হঠাৎ! তার চোখ আটকে গেল প্রায় তিন সপ্তাহ আগের একটা খবরের উপর। খিদিরপুর এলাকার নামকরা এক কাপড়ের ব্যবসায়ী, ফিরদৌস হাকিমের অপহরণের খবর ছিল সেটা। সংবাদপত্রে ছাপা ছিল ফিরদৌস হাকিমের একটা বড় ছবি। আর সেই ছবিতেই, স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল তার বাঁ হাতের কবজিতে একইরকম মোটা সাদা ধাতুর ব্রেসলেট, যার একদম ঠিক মাঝখানে জুড়ে বসানো বড়সড় চৌকো নীলা পাথরটা ঝলমল করছিল! টুকুনের বুকটা ধক করে উঠলো। অপহৃত একজন মানুষের ব্রেসলেট কীভাবে কলেজের কম্পিউটার চোরের হাতে এলো? এই যোগসূত্রটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর রহস্যজনক! সে কোনোরকম দেরি না করে পত্রিকাটা হাতে নিয়ে ছুটে গেল সল্ট লেক থানায়। ওসি আনিসুর রহমানকে সব কথা খুলে বলল আর তাকে পত্রিকাটা দেখাল। খবরটা শুনে আর ছবিটা দেখে ওসি সঙ্গে সঙ্গে খুব সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। তিনি তখনই এই নতুন তথ্যকে মূল কেস-এর সঙ্গে যুক্ত করলেন। কেসটা এখন আর শুধু একটা কম্পিউটার চুরির কেস থাকল না, বরং একটা বড় অপহরণ কেস-এর সাথেও জড়িয়ে গেল। হতে পারে চোরেরা অপহৃত লোকটার জিনিসপত্র ব্যবহার করছিল, নাহলে তাদের মধ্যে কোন গভীর সম্পর্ক ছিল। ওসি টুকুনকে ধন্যবাদ দিলেন আর তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করলেন। এই কেসটাকে একদম নতুন এক দিকে ঘুরিয়ে দিল। টুকুন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এতদিনের চেষ্টা, এত খোঁজাখুঁজি—অন্তত ব্রেসলেটের সূত্রটা সে উদ্ধার করতে পেরেছে! এই ভাবনা তাকে মানসিকভাবে অনেকটা হালকা করল। সে আবার পুরোদমে পড়াশোনায় মন দিল, রুটিন লাইফে ফিরে গেল। কিন্তু এক মাস পরই, হঠাৎ এক শীতল সন্ধ্যায়, তার মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে চেনা নম্বর—ওসি আনিসুর রহমান। আবারও ডাক পড়ল থানায়। পরদিন থানায় গিয়েই টুকুনের চোখে পড়ল ওসির মুখে এক অভূতপূর্ব আত্মতৃপ্তির হাসি। তিনি টুকুনকে তার অফিসে নিয়ে গেলেন। ঘরটায় যেন বিজয়ের আবহ। "বসো, টুকুন," ওসি গম্ভীর কিন্তু আবেগধরা কণ্ঠে বললেন, "কেস সলভ হয়েছে। পুরো পাজলটা এখন সম্পূর্ণ।" টুকুন নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে শুনতে লাগল। "তোমার পাওয়া সেই ব্রেসলেট আর ছয় আঙুলের সূত্রই সব বদলে দিয়েছে," ওসি বলতে থাকলেন, "ফিরদৌস হাকিমের মেয়ে, শাব্বা হাকিম—যিনি কলকাতা মাইনোরিটি মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন—তিনি ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে এসেছেন। আমরা তাকে ফুটেজ দেখিয়েছিলাম। তিনি যখনই ক্যামেরার ফুটেজে ওই ছয় আঙুলওয়ালা হাতটি দেখলেন, তখনই তিনি চিৎকার করে উঠলেন—'এটা তো আমাদেরই হিসাবরক্ষক, ফারুক!'" ওসি এক মুহূর্ত থেমে গেলেন, মনে হচ্ছিল তিনি সেই মুহূর্তটা আবার জীবন্ত দেখছেন। "ফারুক তাদের পারিবারিক ব্যবসারই বিশ্বস্ত হিসাবরক্ষক ছিল। সে তার সুবিধা নিয়েই ফিরদৌস সাহেবকে অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল, আর কম্পিউটার চুরির ঘটনাটাও তারই মাস্টারমাইন্ড ছিল। সে ভেবেছিল, কলেজের কম্পিউটার চুরিকে সে অপহরণের ঘটনা ঘুরিয়ে দিতে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এই ব্রেসলেটটি পরা, আর তার সেই অনন্যতা—ছয়টি আঙুল!" ওসি টুকুনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, "তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে, আমরা হয়তো কখনোই ফারুকের দিকে সন্দেহ করতাম না। সে তো আমাদের চোখের আড়ালেই ছিল।" টুকুন শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ভাবতেও পারেনি যে তার দেখা একটা ছোট্ট detail এত বড় একটা রহস্যের সমাধান করে দেবে! "ফারুক, করিম, আর সেলিম—তিনজনই এখন পুলিশের হেফাজতে," ওসি শেষ করলেন, "আর ফিরদৌস হাকিমকেও নিরাপদে উদ্ধার করা হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে তোমার অবদান আমরা কখনো ভুলব না, টুকুন।" ওসি আরও বললেন, "আর হ্যাঁ, ফিরদৌস হাকিমের মেয়ে, শাব্বা হাকিম, তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন, শুকরিয়া জানাতে চান!" টুকুন একটু নরম ভাবে, বিনয়ের সঙ্গে বলল, "আমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, ধন্যবাদের আসল দাবিদার তো 'অমর চক্রবর্তী', ওনার সাহস আর সততার জন্যই তো আজ দুটো কেস সলভ হলো।" ওসি আনিসুর রহমান টুকুনের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে বললেন, "তোমার এই বিনয় সত্যিই প্রশংসার যোগ্য, টুকুন।" তিনি একটি ফাইল থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে বললেন, "আমরাও কিন্তু অমর চক্রবর্তীর অবদান কখনো ভুলিনি।" "এই তো সেদিন," ওসি বলতে থাকলেন, "কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমরা অমর চক্রবর্তীকে 'সাহসিকতার জন্য নাগরিক সম্মাননা'র জন্য মনোনীত করেছি। আর পুলিশ বিভাগ থেকে তিনি পাচ্ছেন 'বিশেষ কৃতিত্ব পুরস্কার'। পরের সপ্তাহেই একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তাকে সম্মানিত করা হবে।" ওসি হাসতে হাসতে বললেন, "আর তোমার কথাটা আমি শাব্বা হাকিমকে ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছি। তিনি এখন অমর চক্রবর্তীর সাথেও দেখা করতে চান এবং তাঁকেও ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ দিতে চান আর একটি বিশেষ আর্থিক পুরস্কারও দিতে চান!" টুকুনের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল। সে মনে মনে ভাবল, সত্যিকারের নায়করা কখনই আলোর মঞ্চে দাঁড়াতে চায় না—তারা নীরবেই তাদের দায়িত্ব পালন করে যায়। অমর কাকা যেমনটা করেছিলেন। "তিনি সত্যিই এই সম্মানের যোগ্য," টুকুন কোমলভাবে বলল, "কারণ সেদিন অমর কাকা যদি সাহস দেখিয়ে চোরদের মুখোমুখি না হতেন, তাহলে আমি কখনোই সেই ফুটেজ দেখতে পেতাম না। আসলে তিনিই এই সাফল্যের আসল নায়ক।" ওসি সম্মতিতে মাথা নাড়লেন, "সত্যি বলেছ, টুকুন। ঈমানদার লোকই আসলে সবচেয়ে বড় বীর। আমি নিশ্চিত করেই শাব্বা হাকিম ম্যাডামকে অমর চক্রবর্তীর সমস্ত কথা জানাবো। তিনি নিশ্চয়ই অমর বাবুর এই নিষ্ঠা ও সততার জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ থাকবেন। ইনশাল্লাহ!!" কলেজ প্রাঙ্গণে ঘটনাটি জানাজানি হতে সময় লাগল না। গল্পটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল ক্লাসরুম থেকে ক্যান্টিন, লাইব্রেরি থেকে খেলার মাঠ—সবখানে। সবাই টুকুনের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর স্মরণশক্তির প্রসংশায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছিল ‘অমর চক্রবর্তী’—সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার—তার অসামান্য সাহস আর সততার কথা। ছাত্র-শিক্ষক সবার মুখেই শুধু এক কথা, “অমর কাকা না থাকলে তো সব শেষ হয়ে যেত!” কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। কলেজের গতিছন্দ আবারও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কিন্তু অমর চক্রবর্তীর প্রতি সবার শ্রদ্ধা আরও গভীর হয়েছে। একদিন সকালবেলা। অমর কাকা তার ছোট্ট অফিস রুমে বসে রোজনামচা লিখছিলেন। জানালা দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়েছে তার ডেস্কের উপর। ঠিক তখনই দরজায় একটা খসখস শব্দ। একজন ভদ্রলোক, গায়ে নিয়ম-মাফিক সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, হাতে একটি সিলমোহর করা খাম নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। “অমর চক্রবর্তী?” ভদ্রলোক নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন। অমর কাকা মাথা তুলে তাকালেন, “হ্যাঁ, আমি। কী চাই?” ভদ্রলোকটি এগিয়ে এসে খুব সম্মানের সঙ্গে খামটি তাঁর ডেস্কের উপর রেখে বললেন, “এই খামটা বেগম শাব্বা হাকিম পাঠিয়েছেন আপনার জন্য। তিনি ফিরদৌস হাকিম সাহেবের মেয়ে, আপনাকে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একটু সামান্য উপহার দিতে চেয়েছেন।” অমর কাকা কিছুক্ষণ খামের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আস্তে করে সিল ভাঙলেন। খামের ভেতরে একটি অভিনন্দন পত্র আর সঙ্গে ছিল এক বান্ডিল নতুন নোট—পরিষ্কার দেখেই বোঝা যাচ্ছিল,পরিমাণটা মোটেও সামান্য নয়। অমর চক্রবর্তীর চেহারা দেখে মনে হলো না যে তিনি টাকা দেখে অভিভূত হয়েছেন। বরং তাঁর মুখে এক গম্ভীর, শান্ত ভাব ফুটে উঠল। তিনি খুব ধীরে, স্নেহময়ী কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “ভাইসাব, দয়া করে বেগম শাব্বা হাকিমকে আমার পক্ষ থেকে বলবেন... আমি এই টাকা নিতে পারব না।” ভদ্রলোক একটু আশ্চর্য হয়ে তাকালেন, “কিন্তু স্যার, এটা তো বেগমসাবের ইচ্ছে... আপনার সাহসিকতা আর সততার জন্য...” অমর কাকা হালকা করে হেসে, “জানি। তাদের ইচ্ছের জন্য আমি তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবেন। কিন্তু দেখুন, ওই দিন আমি যা করেছিলি, সেটা তো আমার কাজ, আমার দায়িত্ব। একজন সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কলেজের জিনিসপত্র, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করা আমার কর্তব্য ছিল। কর্তব্য করে তার জন্য পুরুস্কার নেওয়া—এটা আমার নীতি নেই।” তিনি আবারও খামটার দিকে তাকালেন, যেন সেটা শুধুই একটি কাগজ, “আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করেছি, আর সেটা করতে পেরে আমি নিজেই খুব খুশি। বেগমসাব যদি সত্যিই খুশি হয়ে থাকেন, তাহলে সেটাই আমার বড় পুরস্কার। ওনাকে আমার অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাবেন।” বেশ কিছুদিন আরামে, শান্তিতে কেটে গেল। কলেজের রুটিন কাজকর্ম, ছাত্রছাত্রীদের হাসি-ঠাট্টা, ক্লাস—সব কিছুই যেন আগের মতোই চলছে। অমর বাবুও তার নিয়মিত দায়িত্বে ব্যস্ত, পুরনো সেই ঘটনার উত্তেজনা এখন অনেকটাই মিলিয়ে এসেছে। একদিন আবারও সেই সন্ধ্যা। অমর কাকা তার ছোট্ট অফিস রুমটি গুছিয়ে রেখেছেন, বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তখনই দরজায় পরিচিত খসখস শব্দ। আগেরবারের সেই ভদ্রলোকটি আবারও হাজির, তাঁর হাসিমাখা মুখে একটু বিশেষ খবর নিয়ে। "স্যার, আবারও বিরক্ত করলাম," ভদ্রলোকটি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, "বেগম শাব্বা হাকিম সাহেবা আপনার সাথে সরাসরি একবার দেখা করতে চেয়েছেন। তিনি খুবই ইচ্ছুক, আপনি যদি একটু সময় করে..." অমর চক্রবর্তী একটুও দ্বিধা না করে, খুব স্বাভাবিক আর সাদামাটা ভাবেই বলে উঠলেন, "নিশ্চই, নিশ্চই! এটা তো আমারই সম্মানের।" তিনি একটু ভেবে বললেন, "কাল শনিবার, আমার কলেজ বন্ধ। কাল সন্ধের পর যদি ওনার সময় হয়, তাহলে আমি..." ভদ্রলোকটি খুব খুশি হয়ে, "বেশ তো স্যার! একদম ঠিক কথা। আমি এখনই বেগম সাহেবাকে বলে দেব। আপনি কি... ওনার বাড়িতে যেতে পারবেন? তাঁর খুবই ইচ্ছে আপনি যেন তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতেই দেখা করেন।" অমর চক্রবর্তী এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা করলেন না। তাঁর কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস আর সরলতা, "নিশ্চই! ঠিকানা দিলে নিশ্চই যেতে পারবো!! কোনো সমস্যা নেই।" ভদ্রলোকটি খুব খুশি হয়ে একটি visiting card বের করে অমর বাবুর হাতে দিলেন। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল বেগম শাব্বা হাকিমের বাসার ঠিকানা—একটি অভিজাত এলাকার নাম। "ধন্যবাদ, স্যার," ভদ্রলোকটি বললেন, "আমি এখনই বেগম সাহেবাকে জানাব। কাল সন্ধ্যায় তাঁর গাড়ি আপনাকে নিয়ে আসার জন্য পাঠানো হবে।" অমর কাকা মৃদু হেসে বললেন, "গাড়ির দরকার নেই ভাই। আমি নিজেই বাসে-ট্রামে চলে যাব। ঠিকানা পেয়েছি, হাজির হব।" ভদ্রলোকটি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অমর কাকার দৃঢ় কিন্তু বিনয়ী হাসি দেখে আর জোর করলেন না। তিনি জানতেন, এই মানুষটির সরলতা-ই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। ভদ্রলোকটি চলে গেলেন। অমর বাবু একা দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সন্ধ্যার রাঙা আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসছে, আকাশে জ্বলজ্বল করে উঠেছে প্রথম তারাটা। কাল সন্ধ্যায় যে দেখা হবে, সেটা নিয়ে তাঁর বুকটা একটু-আধটু দুরুদুরু করছে। কারণ শাব্বা হাকিমকে তিনি চেনেন... না ব্যক্তিগতভাবে নয়, কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় তো তাঁর জোরালো উপস্থিতি অনেকবারই দেখেছেন! শাব্বা হাকিমের বাবা ফিরদৌস হাকিম খিদিরপুর এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, কাপড়ের ব্যবসায় তাঁর একচেটিয়া দাপট। কথিত আছে, তিনি ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতির গলিঘুঁজিতেও বেশ সক্রিয়, একটি বড় রাজনৈতিক দলের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র। আর তাঁর মেয়ে শাব্বা হাকিম? তিনি তো তাঁর বাবার চেয়েও বেশি সক্রিয় এবং প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শুধু কলকাতা মাইনোরিটি মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসনই নন, সামাজিক কাজে তাঁর ভূমিকা খুবই শক্তিশালী। তবে অমর কাকা তাঁকে চেনেন আরেকটি কারণে। গত বছরই তো... জুনিয়র ডাক্তারদের ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন হচ্ছিল, হাসপাতালের সামনে ধর্মঘট। সেখানে হঠাৎ করেই দেখা গেল শাব্বা হাকিমকে, মাইক্রোফোন হাতে, ডাক্তারদের পক্ষে জোরালো বক্তৃতা দিচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, ওই আন্দোলনটা তো তাঁর বাবার রাজনৈতিক দলের নীতিরই বিরুদ্ধে ছিল! তিনি দলীয় লাইনের তোয়াক্কা না করে, নিজের বিবেকের ডাকে সেখানে গিয়েছিলেন। এই স্পষ্টবাদিতা, এই সাহসটাই অমর বাবুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এইজন্যই, তাঁর মধ্যে একটু অদ্ভুত রকমের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। একদিকে তিনি একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী মহিলা—এমন একজন মানুষের সাথে একান্তভাবে সাক্ষাৎ করা নিত্যদিনের ঘটনা তো নয়ই! যদিও বয়স খুব বেশি না, বড়জোর চল্লিশের কোটায়। কিন্তু দেখতে একদম সাধারণ গৃহিণীর মতো নন—চেহারায় একটা আলাদা জোরালো ভাব, পোশাক-পরিচ্ছদে আধুনিক, চালচলনে একদম ডাকসাইটে, আর ব্যক্তিত্বে তেমনি দাপট। তাঁর দাপট থাকবেই না কেন? পয়সা, ক্ষমতা, প্রভাব—সবই তো তাঁর হাতের মুঠোয়। আর রূপ? সেটাও কম নয়—গায়ের রং ফর্সা, কিন্তু চোখেমুখে একটা তেজস্বী জ্যোতি, চলাফেরায় একটা অনন্য গাম্ভীর্য। তবুও, অমর বাবু ঠোঁটের কোণে একটু মৃদু হাসি ফুটিয়ে নিলেন। তিনি তো আর কাউকে দেখে ভয় পাবার মানুষ নন। তিনি সারাজীবন শুধু একটাই কাজ করেছেন—নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। এর বাইরে তিনি কিছু চানওনি, কিছু আশাও করেন না। তিনি গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস নিলেন, জানালার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে অফিস রুমের লাইটটি বন্ধ করে দিলেন। বাইরে রাত নেমেছে, একটি তারা ঠিক তাঁর জানালার বাইরে জ্বলজ্বল করছে। কালকের দিনটা... কালকেই দেখা যাবে। এখন ঘরে ফেরার সময়। অমর চক্রবর্তী, বয়স আনুমানিক ৪৯/৫০। একেবারে খাঁটি বাঙালি ',, মুখে এক সহজ-সরল কিন্তু দৃঢ় ভাব। জীবনের চাপায় খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি, কিন্তু সাধারণ জ্ঞান আর বাস্তববুদ্ধির কোনও অভাব নেই। চেহারা দেখেই বোঝা যায় গ্রামের মাটি থেকে উঠে আসা মানুষ—শরীরটা সুঠাম, হাড়ে-মাংসে ভরপুর, হাতের তালুতে পরিশ্রমের দাগ স্পষ্ট। গরিব ঘরের সন্তান, কিন্তু সততা আর পরিশ্রমে কখনো আপোস করেনি। টাকার অভাবের কারণে স্ত্রী আর চোদ্দ বছরের ছেলেটাকে গ্রামের বাড়িতেই রেখে এসেছেন। শহরে দারোয়ানের কাজ করে যা রোজগার হয়, তার বেশিটাই বাড়ি পাঠিয়ে দেন। শনিবার সন্ধ্যা নেমেছে কলকাতায়। অমর চক্রবর্তী সদ্য স্নান করে পরিষ্কার একটি সাদা পাঞ্জাবি আর ধূসর পায়জামা পরেছেন। একটু পুরনো কিন্তু ঝকঝকে পরিষ্কার জুতো জোড়া পায়ে। ঠিকানা জানা ছিল, তাই তিনি রওনা দিলেন সেই অভিজাত এলাকার দিকে। বাসে চেপে, তারপর কিছুদূর হেঁটে, তিনি পৌঁছে গেলেন বেগম সাহেবার বাড়ির সামনে। তখন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা বাজে। বাড়িটা দেখে তিনি একপলক চোখ বুলাতে পারলেন না—একটি বিশাল, সাদা-সবুজ মার্বেল-মোড়া অট্টালিকা, যেন হাভেলি। উঁচু উঁচু গেট, তার পিছনে ঝকঝকে তকতকে রাখা বাগান। গেটের বাইরে ইউনিফর্ম-পরা এক দারোয়ান গম্ভীর মুখে পাহারা দিচ্ছিল। অমর বাবু একটু অনিশ্চিত ভাবেই এগিয়ে গেলেন। "আমি অমর চক্রবর্তী। বেগম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি," তিনি বললেন। দারোয়ানটি তাঁর দিকে তাকিয়েই যেন চিনতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে ভাবটা বদলে গেল—সম্মানের সঙ্গে স্যালুট করল, "জি হ্যাঁ স্যার, দয়া করে ভেতরে আসুন।" বড় লোহার গেটটি খুলে দিল দারোয়ান। অমর বাবু ভেতরে পা দিতেই চোখ ঝলসে গেল—চওড়া রাস্তা, দুপাশে ফোয়ারা, আর দূরে মূল বাড়িটির ঝলমলে আলো। দারোয়ান তাঁকে নিয়ে গেল একটি পাশের বিল্ডিংয়ে, একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে। ঘরটা খুব বড়, মসৃণ কাঠের মেঝে, দেয়ালে দামী ছবি। "দয়া করে এখানে একটু বসুন। বেগম সাহেবা এখনই আসছেন," এ কথা বলে প্রহরীটি সম্মানজনকভাবে সরে গেল। অমর চক্রবর্তী সোফায় একটু সশব্দে বসলেন, নরম কার্পেটে তাঁর পুরনো কিন্তু ঝকঝকে জুতো জোড়াটা একটু অস্বস্তিকর ঠেকল। বাস-ট্রামে চেপে আসতে আসতে কলকাতার গরমে তাঁর সাদা পাঞ্জাবিটা একদম ভিজে গিয়েছে ঘামে, কাপড় এখন গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। তিনি একটু অস্বস্তি বোধ করলেন, পাঞ্জাবির কলারটা টান দিয়ে ঠিক করে নিলেন। আজ ভেতরে স্যান্ডো গেঞ্জি পড়েননি, তাই তাঁর ঘন কালো গায়ের লোম সাদা পাঞ্জাবির ভেতর থেকে স্পষ্ট ফুটে উঠছে। "উফফ... সারা গায়ে যেন ভালুকের মতো লোম," তিনি নিজের মনেই মৃদুভাবে মন্ত্র জপ করলেন, একটু অসস্থি হাসলেন। তবুও তিনি চারপাশ দেখতে লাগলেন—চকচকে মার্বেলের মেঝে, দেয়ালে ঝোলানো দামী ছবি, নিখুঁতভাবে সাজানো ঘর... এত সম্পদ, এত জাঁকজমক! কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে কোনো ঈর্ষা বা ভয়ের ভাব নেই, নেই কোনো হীনম্মন্যতা। তিনি শুধু একজন শান্ত, গম্ভীর পর্যবেক্ষকের মতোই সব দেখছেন, যেন এই বিলাসিতা তাঁকে স্পর্শই করতে পারবে না। তিনি তাঁর সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন, পুরোপুরি স্থির, অটল। তাঁর সততাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি, সবচেয়ে মজবুত রক্ষাকবচ। - চলবে
Parent