বাংলা গল্প- লালপট্টি - অধ্যায় ৩১

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-70110-post-6052126.html#pid6052126

🕰️ Posted on October 7, 2025 by ✍️ rajusen25 (Profile)

🏷️ Tags: None
📖 3675 words / 17 min read

Parent
পরের সপ্তাহের এক প্রভাত। কলেজের মূল ফটকের পাশে সেই প্রাচীন আমগাছটার নিচে ছায়া নেমে এসেছে ঝকঝকে পরিষ্কার ফুটপাথ জুড়ে। সকাল সাড়ে আটটা বাজে, কোমল রোদ গায়ে মাখার মতো এক সুন্দর উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। টুকুন কাঁধে বইয়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, এমন সময় অমর চক্রবর্তী, যিনি এখন 'সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার'—নতুন ইউনিফর্মের বোতামগুলোতে সূর্যের আলো খেলে যাচ্ছে—এগিয়ে এলেন। "টুকুন বাবু!" ডাকলেন অমরবাবু, তাঁর কণ্ঠস্বরে মিশে আছে স্নেহ আর গর্বের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। মুখে ফুটে উঠল অত্যুজ্জ্বল এক হাসি, যেন সকালের রোদই প্রতিফলিত হচ্ছে তাঁর দাঁতের ঝলকানিতে। তিনি দুই হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন, "নমস্কার!" টুকুন ফিরে তাকালেন, বইয়ের ভারে একটু নুয়ে থাকা কাঁধ নিয়ে। মৃদু হাসলেন, "নমস্কার, অমরবাবু। কেমন আছেন আপনি?" অমরবাবু একটু এগিয়ে গেলেন, গলা নামিয়ে গোপন কিছু বলার ভঙ্গিতে বললেন, "বেগম শাব্বা হাকিম সাহেবা আর তাঁর পিতা, ফিরদৌস হাকিম সাহেব, আমাকে ডেকেছিলেন ওনাদের বাড়িতে... খিদিরপুরের সেই বিরাট হাবেলীটাতে... আমাকে ধন্যবাদ জানাতে!" কথাগুলো বলতে বলতে তাঁর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল, গর্বে বুকটা যেন ফুলে উঠেছিল, কিন্তু বেগম সাহেবার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি আড়ালেই থেকে গেল, কেবল একটি অনুক্ত উচ্ছ্বাস ঝিলিক দিয়ে গেল তাঁর কণ্ঠস্বরেই। টুকুন একটু আশ্চর্য হলেন, "আচ্ছা! হ্যাঁ, শুনলাম তো। গত পরশু ফিরদৌস হাকিম সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন। দেখা করতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।" অমরবাবু গর্বে স্ফীত হয়ে বললেন, "হ্যাঁ বাবু, আমিই তো তোমার মোবাইল নম্বরটি দিয়েছিলাম! ওনারা তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ! তুমি যে উপকারটি করেছিলেন, সেটা ওনারা ভোলেননি কোনোদিনই!" তিনি আরও কাছে সরে এসে যোগ করলেন, "খুব ভালোমানুষ ওনারা... আমাকে যে রকম আদর-আপ্যায়ন করলেন... বলা যায় না!" টুকুন খুশি হয়ে বললেন, "ও, সত্যি নাকি! ফিরদৌস হাকিম সাহেব তো আমার কলেজে এসে দেখা করবে বলেছিলো, কিন্তু আমি না করলাম আসতে, 'আপনার বয়স হয়েছে, কষ্ট করে আসবেন না। পরের সপ্তাহেই আমি একদিন গিয়ে সাক্ষাৎ করে নেব আপনার সাথে।'" অমরবাবু আরও কিছু বলতে যাবেন, গল্পের সুরে বললেন, "ওই হাবেলীটি তো এক কথায় রাজপ্রাসাদসদৃশ! আর বেগম সাহেবা তো..." বাক্যটি অর্ধেকেই থেমে গেল। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত, অর্থবহ হাসি খেলে গেল, চোখ দুটো এক পলকের জন্য যেন অন্য কোনও দূরের জগতে চলে গেল। টুকুন সেই হাসি, সেই অসম্পূর্ণ বাক্য লক্ষ্য করলেন। তিনি অনুভব করলেন, এখানে কিছু অকথিত রয়ে গেছে, যা দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে। শান্ত স্বরে বললেন, "আচ্ছা, তাহলে পরের সপ্তাহেই একদিন চলে যাব। সম্ভবত বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যার আগে। আপনি কি আমার সঙ্গে আসবেন?" অমরবাবু যেন একটু হকচকিয়ে গেলেন, "আরে না বাবু, আমার তো সেইদিন ডিউটি থাকে! আমি কি করে যাব!" বলতে বলতেই তাঁর চোখে এক বিশেষ দীপ্তি খেলে গেল, যেন ভিতরে ভিতরে জ্বলছে কোনো গোপন আনন্দের অগ্নিশিখা। মনে মনে ভাবতে লাগলেন, "আমি যাব শনিবার-রবিবার... যখন বেগম সাহেবার সাথে নির্জনে দেখা হবে... উফ্... সেই রাতের স্মৃতি মনে পড়লেই তো গা শিরশির করে... কী অসাধারণ ঘটনাই না সংঘটিত হয়েছিল!" টুকুন অমরবাবুর চোখের সেই বিচিত্র উজ্জ্বল ভাবটা দেখে মৃদু হাসলো। ভাবলো, সম্ভবত এই সরল-সোজা মানুষটি ওই ধনী পরিবারের আতিথেয়তায় অত্যন্ত আনন্দিত, সন্মান পেয়ে আবেগাপ্লুত। অমরবাবু নিজের চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে বললেন, "তুমি একাই যাও টুকুন বাবু। ওনারা তোমাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। আমার ডিউটির সময় তো আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।" টুকুন মাথা নেড়ে বললেন, "তা ঠিক।" এ বলেই টুকুন কলেজের অভ্যন্তরের দিকে হাঁটা দিলেন, বইয়ের ব্যাগটি কাঁধে দোল খেতে খেতে। অমরবাবু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন ফটকের পাশে, সকালের রোদে তাঁর নতুন ইউনিফর্মের বোতামগুলোতে আলোর খেলা হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল অন্যমনস্ক, মনে ভেসে উঠছিল গত শনিবার রাতের সেই সব রোমাঞ্চকর, উত্তেজনাপূর্ণ স্মৃতি—যার প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর স্নায়ুতে এখনও জ্যান্ত, গরম হয়ে আছে। সারা সপ্তাহজুড়ে টুকুনের মাথার ভিতর যেন পড়াশোনার এক নিরবচ্ছিন্ন চাপ জমে ছিল। বইয়ের স্তূপ, ক্লাসের নোট, আর প্রেজেন্টেশনের প্রস্তুতি—সব মিলিয়ে জীবনটা যেন একটু আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। অনেকদিন ধরেই আমিনা খালার সঙ্গে দেখা হয়নি, যদিও ফোনে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছিল নিয়মিতই, পড়ালেখার ভিড়ের ফাঁক ফোকর দিয়েই। সেই সকালেই আমিনা খালার সঙ্গে ফোনে দীর্ঘ কথা হয়েছিল। তাঁর গর্ভাবস্থার এখন আট মাস চলছে, আর ডাক্তারি পরীক্ষায় নিশ্চিত হয়েছে যে সবকিছুই একদম ঠিকঠাক আছে। এই সুখবরটা টুকুনের মনকে যেন একটু হালকা করে দিয়েছে, ফুরফুরে করে তুলেছে—মনে হচ্ছিল যেন একটা বড়ো রকমের চিন্তার বোঝা মাথা থেকে সরে গেল। বিকেল বেলা পড়াশোনার ফাঁকে একটু বিরতি নিয়ে টুকুন ভাবল, আজই সেরে ফেলা যাক ফিরদৌস হাকিম সাহেবের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা। গত সপ্তাহেই তো ফিরদৌস সাহেব ফোন করে তাঁর বাড়ির পূর্ণ ঠিকানা বলে দিয়েছিলেন। টুকুন একটা আরামদায়ক জিন্স আর হালকা সুতির টি-শার্ট পরল—কলকাতার গরমে এটাই যথেষ্ট। তারপর তার মোটরবাইকটা স্টার্ট করে ছুটে পড়ল খিদিরপুরের দিকে। বিকেলের ভ্যাপসা গরম হাওয়ায় ভেসে আসছিল রাস্তার ধারের গন্ধরাজ ও বেলি ফুলের মিষ্টি সুবাস। বাইক চালাতে চালাতে টুকুনের মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল—একদিকে পড়াশোনার চাপ থেকে মুক্তির আনন্দ, অন্যদিকে আমিনা খালার সুখবর। ফিরদৌস সাহেবের বাড়ির দিকে এগোতে এগোতে সে ভাবছিল, বাড়িটা আসলে কেমন হবে? অমর কাকু তো বলেই দিয়েছিলেন—ঠিক যেন রাজপ্রাসাদের মতো। বড়লোক ব্যবসায়ী, হাভেলি তো হবেই। সেই ঠিকানায় পৌঁছে টুকুন দেখল একটি বেশ বড় দুইতলা বাড়ি, তবে একে হাভেলী বলতে তার একটু ইতস্তত বোধ হলো। অমরবাবু হয়তো গ্রাম্য মানুষ, এত বড় বাড়ি দেখেননি, তাই এটাকেই হাভেলী ভেবে বসেছেন—মনে মনে এই ভাবনাটা খেলে গেল টুকুনের। টুকুনের বাইকের আওয়াজ শোনামাত্রই একজন প্রহরী তৎক্ষণাৎ লোহার বড় গেটটি খুলে দিল। টুকুন বাইকেই বসে হেলমেট খুলে বলল, "আমি টুকুন, ফিরদৌস হাকিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে..." কথা শেষ হওয়ার আগেই দারোয়ানটি সম্মান দেখিয়ে বলল, "জি হুজুর, সেলাম... হাকিম সাহেবের খাস মেহমান আপনি! সাহেব বলে রেখেছেন!" বলে দ্রুত গেট খুলে দিল। টুকুন বাইক নিয়ে গেটের ভিতরে প্রবেশ করল। হেলমেট খুলে বাইকের মিররে রাখতে যাবে, এমন সময় দারোয়ানটি বলল, "হুজুর, আমাকে দিন, আমি রেখে দিচ্ছি!" বলে সসম্মানে হেলমেটটি নিয়ে গিয়ে তার রক্ষণাবেক্ষণের ঘরে যত্ন করে রেখে এল। ফিরে এসে বলল, "চলুন হুজুর, আমি নিয়ে যাচ্ছি..." বলে পথ দেখিয়ে আগাতে লাগল। বাড়িটির গেট থেকে ইট বিছানো পথ দু'পাশে সারিবদ্ধ ফুলের বাগান দিয়ে এগিয়েছে। একটু দূরে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা একটি সুন্দর বাগান চোখে পড়ল, যেখানে গোলাপ, গন্ধরাজ আর ডালিয়া ফুলের সমারোহ। বাগানের মাঝখানে একটি ছোট ফোয়ারা থেকে জলের শব্দ ভেসে আসছিল। দারোয়ানটি টুকুনকে নিয়ে এগিয়ে চলল মূল বাড়ির দিকে, যার সাদা রঙের দেয়ালে লতানো গাছের আংশিক আচ্ছাদন একটি প্রাচীনত্বের আভাস দিচ্ছিল। একটু এগোতেই টুকুনের চোখ আটকে গেল বাগানের সীমানা ঘেঁষে থাকা লোহার রেলিংটার ওপর বসে থাকা এক তরুণীর দিকে। তার ভঙ্গিটি দেখতে ঠিক যেন মুক্তপাখির মতো—অনিয়ন্ত্রিত, প্রাণবন্ত। দু'পা নিচে দুলছে হালকা হাওয়ায়, আর সন্ধ্যার শীতল সমীরণে তার কাঁধের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত কালো চুলগুলো দুলছে এক মন্ত্রমুগ্ধকর ছন্দে। চুল থেকে ভেসে আসা শ্যাম্পুর মৃদু মিষ্টি গন্ধ মিশে যাচ্ছে সন্ধ্যার ভিজে মাটির স্নিগ্ধ সৌরভের সঙ্গে। তার কোমল ত্বকের বর্ণ দুধে-আলতার মতো উজ্জ্বল, আর রেলিংয়ের গাঢ় কালো রঙের পটভূমিতে সে দেখতে লাগছিল ঠিক যেন জীবন্ত শিল্পকর্ম। যখন সে মাথা ঘোরায়, সন্ধ্যার শেষ সোনালি আভা এসে পড়ে তার গালে, নাকে, ঠোঁটে—যেন প্রকৃতি নিজেই তার ওপর সোনার প্রলেপ দিয়েছে। তার বড় বড় চোখ দুটো গাঢ় বাদামি, কিন্তু এখন সেগুলো ছিল স্বপ্নে ভরা। সে তাকিয়ে আছে দিগন্তে ডুবতে থাকা সূর্যের দিকে, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন হারিয়ে গেছে অনেক দূরে, কোনো অজানা জগতে। তার পরনের পাতলা সুতির সালোয়ার-কামিজটি শরীরে লেগে আছে স্বাভাবিকভাবে। নরম সাদা কাপড়টি তার যৌবনকেই যেন আরও বেশি করে উন্মোচিত করেছে। তার শারীরিক গঠন ছিল যৌবনের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা—সদ্য পাকা আমের মতো রসালো ও কোমল। তার বক্ষযুগল স্পষ্টভাবে বিকশিত, যা কাপড়ের ভেতর থেকেই স্পষ্ট। তার সরু কোমর, যা তার নিতম্বের বক্ররেখাকে আরও বেশি করে প্রকাশ করেছে। যখন সে নিঃশ্বাস নেয়, তার পুরো শরীরে একটা মৃদু কম্পন যায়। তার কানে লাগানো ছোট্ট প্লাটিনামের কানের দুল ম্লান হয়ে যায় তার হাসির তুলনায়। যখন সে হাসে, তার গালে যে গর্ত পড়ে, তা তাকে আরও বেশি করে কিশোরী দেখায়। তার হাতের আঙুলগুলি লম্বা ও সুগঠিত, যেন বিশেষভাবে ছবি আঁকার জন্যই তৈরি। এক হাত দিয়ে সে রেলিংটা ধরে আছে, আর অন্য হাতটা রেখেছে হাঁটুর ওপর। তার পায়ের পাতা দেখতে একদম কোমল, নখগুলো গোলাপি এবং পরিষ্কার। যখন সে অলসভাবে পা দুলোচ্ছে, তার পুরো শরীরে একটা ছন্দময় নড়াচড়া খেলা করে – মনে হয় সে শুনতে পাচ্ছে এমন কোনো সুর যা শুধু তার কানেই বাজছে। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে আছে এক ধরণের স্বতঃস্ফূর্ততা, যা এই বয়সেরই বিশেষ সৌন্দর্য। টুকুনের হাঁটার গতি আপনা-আপনিই একটু ধীর হয়ে এলো। ঠিক সেই মুহূর্তেই তরুণীটি তার দিকে ফিরে তাকাল। দুজনের চোখাচোখি হলো—এক অদ্ভুত, নিবিড় দৃষ্টিবিনিময়, যেন সময়ই থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। সেই দৃষ্টিতে ছিল এক অবিশ্বাস্য আকর্ষণ, এক অদৃশ্য তড়িতের ঝলকানি, যা দুজনকেই স্পর্শ করে গেল। টুকুনের হৃদয়টা যেন একপলকে দ্রুত স্পন্দিত হতে শুরু করল। তরুণীর চোখ দুটোও যেন কিছুক্ষণের জন্য আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠল এক ক্ষীণ, লাজুক হাসির রেখা। এ ছিল প্রথম দর্শনেই এক গভীর সংযোগের অনুভূতি, যেমনটা প্রেমের গল্পে বলা হয়। চারপাশের দুনিয়া যেন মিলিয়ে গেল—বাগানের ফুলের গন্ধ, দূরের ফোয়ারার শব্দ, সবকিছুই যেন পটভূমিতে চলে গেল। শুধু রয়ে গেল দুজনের মধ্যেকার সেই নীরব, কিন্তু অর্থপূর্ণ দৃষ্টি, যা বলতে চাইছে অনেককিছু, অনেক অকথিত কথা। তরুণীটি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো টুকুনের দিকে। টুকুন লক্ষ করলো, তার উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হলেও গড়নটি একদম নিখুঁত—তেত্রিশ-আটাইশ-তেত্রিশ ইঞ্চির সেই পরিমাপ যেন শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তির মতো সম্পূর্ণ। তরুণীটিও টুকুনের দৃষ্টি এড়াতে পারছিল না। টুকুনের মতো ছয় ফুট লম্বা, বলিষ্ঠ, পুরুষসুলভ যুবক সে খুব কমই দেখেছে। তার প্রশস্ত কাঁধ, মজবুত গড়ন এবং আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিটি তরুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল অবিশ্বাস্য রকমভাবে। টুকুনের চোখে পড়লো তরুণীর হাঁটার ভঙ্গিটি—একটা স্বতঃস্ফূর্ত লয়বদ্ধতা নিয়ে সে এগিয়ে আসছিল, যেন নদীর জলের মতো প্রাকৃতিক। তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল এক অদ্ভুত মাধুর্য। দুজনের চোখই যেন বলছিল অনেক অকথিত কথা। টুকুনের মনে হচ্ছিল, এই তরুণীটির সাথে তার পরিচয় যেন আগে থেকেই অদৃশ্য সূত্রে বাঁধা ছিল। আর তরুণীর চোখেও ছিল একই প্রশ্ন, একই কৌতূহল—কে এই যুবক, যে এক নিমেষে তার মনটা দখল করে নিল? দারোয়ানের কর্কশ কণ্ঠস্বর হঠাৎ করেই ভঙ্গ করল সেই নিস্তব্ধ, রোমাঞ্চকর মুহূর্তটি। "সেলাম, ছোট বিবি সাহেবা!"—বলে সে টুকুনের দিকে ইশারা করল, "এই সাহেব এসেছেন হাকিম সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।" তরুণীটি মুখ ফিরিয়ে দারোয়ানের দিকে তাকাল, কিন্তু তার চোখের প্রান্তে তখনও টুকুনের ছবি যেন ভাসছিল। "জি, চাচা, আমি নিজেই নিয়ে যাচ্ছি..."—বলে সে আবার টুকুনের দিকে ফিরল। তারপর এক মধুর হাসি ফুটিয়ে বলল, "হাই, আমি আমিশা"—বলে হাত বাড়ালো পরিচয় দেবার জন্য। টুকুনের বুক তখন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে ভরা। সে আমিশার হাতটি নিজের হাতের তালুতে নিল। কোনো শব্দ নেই। কেবল চোখের দৃষ্টিতে বিনিময় হয়েছিল অফুরন্ত স্নেহ আর আকর্ষণের এক গভীর অনুভূতি। সেই দিন তারা ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করে বলেনি, কিন্তু তাদের সমস্ত আচরণ, তাদের সমস্ত চলাফেরাই হয়ে উঠেছিল এক গভীর ও হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার প্রকাশ। টুকুনের মনে হচ্ছিল এই তরুণীর হাসিটি যেন সমস্ত বাগানটিকেই আলোকিত করে দিল। তার কণ্ঠস্বর ছিল মধুর মতো মিষ্টি, ঠিক যেমন ভাদ্র মাসের হালকা বাতাস কানের পাশ দিয়ে বয়ে যায়। "হ্যালো, আমি টুকুন, ফিরদৌস হাকিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি!"—বলে পরিচয় দিতে গিয়ে সে একটু ভ্রু কুঞ্চিত করল। আমিশাও বলে উঠল, "ওহ, আপনি তো আমার নানুর সঙ্গে দেখা করবেন!"—বলে হাত ছেড়ে দিল, "চলুন, আমি নিয়ে যাই নানুর কাছে!!" তরুণীটি এগিয়ে চলল, তার পায়ের কোমল পদধ্বনি লাল ইটের সাজানো পথে মৃদু শব্দ তুলল। টুকুন তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগল, কিন্তু তার দৃষ্টি সব সময় আটকে থাকল তরুণীরই উপর—তার কাঁধে পড়ে থাকা কালো চুলের গুচ্ছ, যা হালকা বাতাসে দুলছিল, তার কোমর থেকে নিতম্ব পর্যন্ত মোহনীয় বক্ররেখা, যা সালোয়ার-কামিজের নরম কাপড়ের নিচে অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তরুণীটিও মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকাত, যেন দেখতে চাইছিল টুকুন ঠিকভাবে পিছনে আসছে কিনা। যখনই তাদের চোখাচোখি হত, দুজনেরই বুকের ভিতর এক অদ্ভুত ধরনের স্পন্দন অনুভূত হত, যেন মনের ভিতর সবচেয়ে মধুর সুর বাজছে। টুকুন লক্ষ করল, তরুণীটির হাঁটার ভঙ্গিতে আছে এক ধরনের স্বাভাবিক কমনীয়তা, ঠিক যেমন একটি মুক্ত হরিণ বনে অনায়াসে চলাফেরা করে। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে ছিল এক স্বকীয়তা, যা টুকুনের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। ফিরদৌস হাকিম সাহেবের ঘর পর্যন্ত ত্রিশ সেকেন্ডের পথটি অতিক্রম করতে তাদের যেন ত্রিশ ঘণ্টা কেটে গেল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন প্রসারিত হয়ে অনন্তকালের মতো মনে হচ্ছিল। দুজনের চোখেই প্রতিফলিত সেই যৌবনের মিষ্টি প্রেম, সেই প্রথম দর্শনের আকর্ষণ, সেই নির্মল ভালোবাসা। বাতাসে ভাসা গন্ধরাজ ফুলের সুবাস যেন হয়ে উঠেছিল তাদের প্রেমের প্রথম সাক্ষী। পায়ের নিচে মার্বেল পাথরের পথে তাদের পায়ের শব্দ যেন একসাথে বেজে উঠছিল, মিলে যাচ্ছিল দুই হৃদয়ের স্পন্দনের সঙ্গে। চোখের ভাষায় তারা যেন বলাবলি করছিল অনেক অকথিত কথা—শব্দ ছাড়াই বুঝে নিচ্ছিল একে অপরের অনুভূতি। এই স্বল্প সময়ের পরিচয়েই যেন গড়ে উঠেছিল এক গভীর বোঝাপড়া, যা সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। আমিশা বড়সড় একটি দরজার মখমলি পর্দা টেনে সরাতেই দুজনে ঢুকে পড়ল ফিরদৌস হাকিম সাহেবের বসার ঘরে। ঘরটি ছিল বিশাল আকারের, দেয়ালে ঝুলছে ক্যালিগ্রাফি করা কোরআনের আয়াত, যেগুলো সোনালি ফ্রেমে বাধানো। এক কোণে রাখা আছে একটি প্রাচীন কাঠের নামাজের মাদুর, যাতে জরির কাজ করা। ঘরের মাঝামাঝি জায়গাজুড়ে রাখা আছে একটি বিশাল আকৃতির সোফা, যার উপর সাদা-নীল রঙের কাশ্মীরি শাল বিছানো। সোফার পাশেই একটি ছোট পার্পল রঙের ওটোমান রাখা, যাতে সাজানো আছে কপার তৈরী হুক্কা। মেঝেতে বিছানো আছে হাতে বোনা পারস্য কার্পেট। ঘরের একটি কোণে সাজানো আছে কাঠের তৈরি একটি আলমারি, যাতে সজ্জিত আছে প্রাচীন ইসলামী পান্ডুলিপি এবং বিভিন্ন ধরনের ইসলামী বই। আলমারির ওপর রাখা আছে একটি প্রাচীন ব্ব্রোঞ্জের তৈরী দীপাধার, যাতে জ্বলছে আতরের সুগন্ধি মোমবাতি। পুরো ঘরজুড়ে ভাসছে চন্দন ও গোলাপের মিশ্র সুবাস। জানালার পাশে রাখা আছে কয়েকটি গমলায় সাজানো মানিপ্ল্যান্ট, যার পাতা সন্ধ্যার হালকা বাতাসে দুলছে। ঘরের ছাদ থেকে ঝুলছে একটি ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি, যার কাঁচগুলো থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সন্ধ্যার শেষ রোদের আভা। ফিরদৌস হাকিম সাহেব বসেছিলেন সোফার এক প্রান্তে, হাতে ছিল প্রাচীন একটি কুরআন শরীফ। সন্ধ্যার কোমল আলোয় তার চশমার কাঁচে ঝিলিক দিচ্ছিল। ঘর ভরে ছিল বইয়ের গন্ধে, মিশে থাকা আতরের মিষ্টি সুবাসে। হঠাৎ দরজার পর্দা সরার শব্দে তিনি মাথা তুলে তাকালেন। "ওয়া আলাইকুম আসসালাম, হ্যান্ডসাম ম্যান!" বলে তিনি বইটি বন্ধ করলেন। বইটি রাখার সময় তার হাতের আঙুলগুলো একটু কাঁপছিল, আবেগে ভরে উঠে। টুকুন এগিয়ে গেল, কিন্তু শালীনতা রেখে শুধু মুচকি হাসল। তার চোখে ছিল এক ধরনের লাজুক জ্যোতি। আমিশা পাশে এসে দাঁড়াল। ফিরদৌস হাকিম সাহেব টুকুনকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই আলিঙ্গনের মধ্যে ছিল অনেক না বলা কৃতজ্ঞতা। তিনি টুকুনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর দুই কাঁধে হাত রেখে আমিশার দিকে তাকালেন। "বেটা, টুকুন..."—বলতে বলতে তার গলা একটু ভারী হয়ে এল—"এই হ্যান্ডসাম বয়, তোমার নানুর জান বাঁচিয়েছে!!!" তার চোখে জমে থাকা জল চশমার ভিতর থেকে ঝকঝক করল। "মাশাআল্লাহ, সাচ আ ইন্টেলিজেন্ট বয়!" ঘরের বাতাসে ভাসতে থাকা আতরের গন্ধ যেন আরও ঘন হয়ে এল। দূর থেকে ভেসে আসছিল মসজিদের আজানের সুর। ফিরদৌস সাহেবের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, যেন বছরের পর বছর জমে থাকা কৃতজ্ঞতা একবারে বেরিয়ে আসছে। টুকুন নিচু মাথায় দাঁড়িয়ে রইল। তার পরনের টিশার্টে সন্ধ্যার আলো পড়ে এক অপার্থিব দীপ্তি তৈরি করছিল। আমিশার চোখেও জল জমেছিল, সে টুকুনের দিকে তাকাল এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে—গর্ব, কৃতজ্ঞতা, আর তার থেকেও বেশি এক নতুন ভালোবাসা। ফিরদৌস সাহেব আবার বললেন, "বেটা, তুমি জানো না...সেই দিনগুলো কত ভয়ঙ্কর ছিল..." তার হাত তখনও টুকুনের কাঁধে ছিল, যেন তিনি এই যুবকটিকে ছেড়ে দিতে চাইছেন না। টুকুন এবার নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল, "আপনি তো আমাকে আগে কখনও দেখেননি, তাহলে আমাকে চিনলেন কীভাবে, ফিরদৌস হাকিম সাহেব?" ফিরদৌস হাকিম টুকুনকে সোফার দিকে ইশারা করে বললেন, "বসো বেটা..." তারপর নিজেও একটি সিঙ্গেল সোফায় বসতে গিয়ে বললেন, "ওই যে দারোয়ান... সে ইন্টারকমে ফোন করে বলে দিয়েছিল যে তুমি আসছো।" টুকুন হালকা করে হেসে বলল, "ওহ, বুঝেছি..." এদিকে আমিশা ততক্ষণে তার দাদুর পাশে এসে সোফার হ্যান্ডেলে বসে পড়ল। ফিরদৌস হাকিম তার নাতনীর কোমর স্নেহে জড়িয়ে ধরে বললেন, "এই যে আমার ছোট্ট পুতুল... আমার আমিশা।" নাতনীর কোমরে স্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে তিনি টুকুনের দিকে ফিরে বললেন, "সেন্ট জোসেফ কলেজ, নর্থ পয়েন্টে পড়ে আমার এই নাতনিটি।" আমিশা লজ্জায় মাথাটা একটু নিচু করে রাখল, কিন্তু তার চোখের কোণ দিয়ে টুকুনের দিকে এক ঝলক চোখ ফিরিয়ে নিল। ফিরদৌস হাকিমের স্নেহভরা স্পর্শে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক লুকানো হাসি, যেন ফুটন্ত গোলাপের কুঁড়ি। সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল এক আন্তরিক পরিবারের মধুর সম্পর্কের ছোঁয়া। টুকুনও আমিশার সেই চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে এক অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। তাদের এই নীরব কথোপকথন যেন ঘরের বাতাসে মিশে গেল। ফিরদৌস হাকিম আবেগী কণ্ঠে বললেন, "শুকরিয়া, বেটা, তুমি যা করেছো! তোমার জন্যই ওই কিডন্যাপারদের হাত থেকে আজাদ হয়েছি!!" বলে তিনি আমিশার দিকে তাকিয়ে বললেন, "বেটা, টুকুনের জন্য কিছু জল-খাবার আনতে বল তো!" আমিশা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, "জি, নানু!" বলে সে উৎসাহের সঙ্গে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার সালোয়ার-কামিজের নরম কাপড় হাওয়ায় দুলতে দুলতে সে যখন হেঁটে যাচ্ছিল, তখন তার পায়ের ঘুঙুরের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঘর থেকে বেরোনোর সময় আমিশা আরেকবার পিছন ফিরে টুকুনের দিকে তাকাল, যেন নিশ্চিত হতে চাইল সে আসলে আছে কিনা। তারপর দরজার পর্দা দুলতে দুলতে সে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু রেখে গেল এক মিষ্টি সুগন্ধ, যেন গোলাপজল আর তরুণীর কোমলতার মিশ্রণ। ঘরটিতে টুকুন আর ফিরদৌস হাকিম দুজনে নানান গল্পে মগ্ন। ফিরদৌস হাকিম বলছিলেন তার অপহরণের মর্মস্পর্শী কাহিনী—কীভাবে তারই বিশ্বস্ত হিসাবরক্ষক ফারুক মীরজাফরের মতোই অর্থের লোভে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। তার দলবল নিয়ে কীভাবে পরিকল্পনা করেছিল ফিরদৌস হাকিমকে অপহরণ করার। গল্প করতে করতে ফিরদৌস সাহেবের কণ্ঠস্বর কখনো রাগে কাঁপছিল, কখনো বা আবেগে ভারী হয়ে আসছিল। অন্যদিকে রান্নাঘরে আমিশা ব্যস্ত টুকুন আর তার নানুর জন্য নাস্তার আয়োজনে। কিন্তু তার মনটা পড়ে আছে ওই বসার ঘরেই, যেখানে টুকুন বসে আছে। সে পরিচারিকাদের নির্দেশ দিচ্ছে, কিন্তু মনের মধ্যে চলছে অন্য চিন্তা। টুকুনের সেই সুন্দর চোখদুটো, তার কথা বলার ভঙ্গি—সবই যেন আমিশার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমিশার হাতের কাজে মনোযোগ নেই। কখনো সে চাের কাপে চা ঢালতে গিয়ে উপচে পড়ছে, কখনো বা প্লেটে স্যান্ডউইচ সাজাতে গিয়ে হাত কাঁপছে। তার মনের অস্থিরতা যেন কাজেও প্রকাশ পাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে নিজেই লজ্জা পাচ্ছে, কিন্তু চোখ ফেরাতে পারছে না। এদিকে বসার ঘরে ফিরদৌস হাকিম টুকুনকে বলছিলেন, "বেটা, সেই দিনগুলো মনে হলে এখনও গা শিউরে ওঠে। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তোমার মতো সাহসী যুবক পেয়েছি।" টুকুন নম্রভাবে শুনে যাচ্ছিল, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছিল কিছু প্রশ্ন। রান্নাঘর থেকে যখন আমিশা ট্রেটি হাতে নিয়ে এল, তখন তার চোখ প্রথমেই খুঁজে নিল টুকুনকে। টুকুনও তার দিকে তাকাল, আর সেই এক সেকেন্ডের দৃষ্টিবিনিময়েই যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। আমিশা ট্রেটি টেবিলে রেখে বলল, "নানু, কী গল্প করছো তোমরা!" তার কণ্ঠস্বর ছিল একটু নরম, একটু লাজুক। গালে একটু লালচে ভাব। সে ট্রেতে সাজিয়ে এনেছে গরম গরম সিঙাড়া, মিষ্টি রসগোল্লা, আর চায়ের কাপ। সবকিছু সাজানো ছিল খুবই সুন্দর করে, যত্ন করে। ফিরদৌস হাকিম মিষ্টি হেসে বললেন, "ওই, কিডন্যাপিনের, পুরনো দিনের গল্প করছিলাম।" তার চোখে ছিল একটু চাপা হাসি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার নাতনীর মনের অবস্থা। আমিশা চায়ের কাপগুলো সবার সামনে রাখতে লাগল। যখন সে টুকুনের সামনে কাপ রাখল, তাদের আঙুলগুলো একসাথে স্পর্শ করল। সেই স্পর্শে দুজনেরই গায়ে এক শিহরণ বয়ে গেল। আমিশা তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে নিল। টুকুন হালকা করে বলে উঠল, "থ্যাংক্স।" তার কণ্ঠস্বর ছিল একটু কাঁপা কাঁপা। আমিশা কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ল। তারপর সে তার নানুর পাশে গিয়ে বসল। কিন্তু তার চোখটা ছিল টুকুনের দিকেই। টুকুন একটু পরিস্থিতি হালকা করতে বলল, "অমর বাবুর সাথে দেখা হয়েছিল কলেজে।" – বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলল, "অমর চক্রবর্তী, আমাদের কলেজের সিনিয়র সিকিউরিটি সুপারভাইজার!" – হেসে যোগ করল, "সে তো আপনাদের খুব প্রশংসা করে, খুব খুশি আপনাদের সাথে কথা বলে!" ফিরদৌস হাকিম স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, "আলহামদুলিল্লাহ, আমার মেয়ের হাভেলীতে দেখা হয়েছে ওনার সাথে!" কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "মাশাল্লাহ, খুবই ঈমানদার লোক।" টুকুন মনে মনে ভাবল, "ওহ, তাহলে অমর বাবু এই বাড়িতে আসেন নি, বেগম শাব্বা হাকিমের হাভেলীর কথাই বলছিলো তাহলে..." – তারপর ফিরদৌস হাকিম আরও বলতে লাগলেন, "আমার মেয়ে শাব্বা, খুব ব্যস্ত আছে কয়েকদিন ধরে, পার্টির কিছু কাজ নিয়ে। নাহলে অবশ্যই তোমার সাথে দেখা করতে আসতো। আমাকে বলেছে তোমাকে তার সালাম জানাতে!" আমিশা এসময় চায়ের কাপে চা ঢালছিল। সে টুকুনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল, যেন এই কথোপকথনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অর্থটা বুঝতে চাইল। ফিরদৌস হাকিমের কথায় ঘরটিতে এক আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যেখানে তিন প্রজন্মের কথোপকথন যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে ফিরদৌস হাকিম বললেন, "শাব্বা এত ব্যস্ত থাকে যে, আমার এই ছোট্ট নাতনীকেও সময় দিতে পারছে না। বেচারী ছুটি নিয়ে এসেও এখানে একঘেয়েমি অনুভব করছে!" বলে তিনি আমিশার দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকালেন। আমিশা লজ্জায় মুখটি আরও নিচু করে ফেলল। তার গালে লালচে আভা যেন গোলাপের পাপড়ির মতো ফুটে উঠল। সে একটু অভিমান মিশ্রিত সুরে বলল, "নানু, আর কী করা যাবে! দুই দিন পর তো আমাকে আবার কলেজে চলে যেতে হবে!" ফিরদৌস হাকিম হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন, "কলেজের কথা মনে পড়ল..." – তিনি টুকুনের দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে, "বেটা, তোমার যদি সময় থাকে, আমার এই নাতনীটাকে একটু তোমার কলেজ আর কলকাতাটা ঘুরিয়ে দাও না? আমার এই গুরিয়ার ভালো লাগবে, ইনশাল্লাহ!" – তিনি নাতনীর দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, "ওর বয়সী কেউ নেই এখানে, তাই বেচারী সারাদিন ঘরেই থাকে!" আমিশা এই প্রস্তাবে চমকে উঠল। সে টুকুনের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। তার হাতের চায়ের কাপটি একটু নড়ে উঠল, চা যেন উপচে পড়তে চাইল। হৃদয়টি দ্রুত স্পন্দিত হতে লাগল এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে। টুকুন প্রথমে একটু হকচাকিয়ে গেল, কিন্তু তারপরেই একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। সে ফিরদৌস হাকিমের দিকে তাকিয়ে বলল, "আজ্ঞে, অবশ্যই! আমি খুবই খুশি হবে আমিশাকে আমাদের কলেজ ও কলকাতা দেখাতে।" ঘরের বাতাসে যেন এক নতুন উদ্দীপনা ভেসে বেড়াতে লাগল। জানালা দিয়ে প্রবেশ করা সন্ধ্যার আলোয় আমিশার মুখখানি আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ফিরদৌস হাকিমের চোখে প্রকাশ পেল এক গভীর সন্তুষ্টি, যেন তিনি দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধনের সূচনা করতে পেরেছেন। আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চা-নাস্তা শেষ করে টুকুন উঠে দাঁড়াল। বলল, "আচ্ছা, আমি এখন আসি হাকিম সাহেব, রাত হয়ে আসছে!" ফিরদৌস হাকিম বললেন, "শুকরিয়া বেটা, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল!" তারপর আমিশার দিকে তাকিয়ে স্নেহভরা সুরে বললেন, "বেটা, টুকুনকে একটু গেট পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আয়।" আমিশা নিচু স্বরে উত্তর দিল, "জি, নানু।" তারপর টুকুনের দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জিত হাসি দিল। দুজনে একসাথে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাগানের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমিশা বলল, "কাল তাহলে কখন বেরোবো আমরা?" টুকুন উত্তর দিল, "তুমি বলো কখন বেরোতে পারবে? তুমি যখন বলবে!" তাদের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল শুধু, আর দূর থেকে ভেসে আসছিল জাহাজের হুইসেলের আওয়াজ। আমিশা হাসিমুখে বলল, "তুমি যখন বলবে, সকাল দশটায়?" তারপর যোগ করল, "এত বোরিং লাগছে বাড়িতে, কী বলব!" মুচকি হাসি দিয়ে বলল, "নানু তো তোমাকে বলেছে, ভালোই হলো।" দুজনার মধ্যে চলতে লাগল নানুকে নিয়ে কথোপকথন। বাগানের আলোয় আমিশার মুখখানি দেখতে ছিল একদম স্বপ্নের মতো। টুকুন লক্ষ করছিল কীভাবে তার চুলের গুচ্ছ হালকা বাতাসে দুলছিল। আমিশা বলল, "নানু তো তোমার খুব প্রশংসা করছেন। তিনি বললেন তুমি খুব ভালো ছেলে।" টুকুন হেসে উত্তর দিল, "তোমার নানু, ফিরদৌস হাকিম সাহেব তো খুব ভালো মানুষ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগল।" গেটের কাছে পৌঁছে দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশে জড়িয়ে থাকা সন্ধ্যার আবহাওয়া যেন তাদের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত সৃষ্টি করেছিল। আমিশা শেষবারের মতো বলল, "তাহলে কাল সকাল দশটায়?" টুকুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, "হ্যাঁ, ঠিক দশটায়।" তারপর বাইকে চড়ে বসে বলল, "আমার বাইকে চড়ে যেতে কোনো অসুবিধা হবে না তো?" – যেন একটু লজ্জা আর আশার সঙ্গে জানতে চাইল। আমিশার মুখে লজ্জা আর আনন্দের এক অপূর্ব মিশেল দেখা গেল। সে শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিল, যা টুকুন গভীরভাবে প্রত্যাশা করছিল। তার চোখের ভাষায় ছিল এক ধরনের সম্মতি আর উৎসাহ। "তাহলে আমি কাল ঠিক দশটায় আসব তোমাকে নিতে!" – টুকুন বলল একদম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। আমিশা এবার একটু স্পষ্ট করে বলল, "জি, ঠিক আছে।" তার কণ্ঠস্বর ছিল একটু কাঁপা কাঁপা, কিন্তু তাতে মিশে ছিল অদ্ভুত এক মিষ্টি। টুকুন হেলমেটটা মাথায় পরতে গিয়ে বলল, "তুমি এখন ভিতরে যাও। রাত হয়ে গেছে।" আমিশা দাঁড়িয়ে রইল গেটের পাশে, হাত দুটো সামনে জড়িয়ে ধরে। টুকুনের বাইক যখন স্টার্ট করল, তখন তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিল। বাইকের আওয়াজ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকল, কিন্তু আমিশার হৃদয়ের স্পন্দন তখনও দ্রুত চলছিল। সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না বাইকের লাল টেইল লাইট সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। তারপর ধীরে ধীরে ফিরে গেল বাড়ির দিকে, কিন্তু মনটা রয়ে গেল রাস্তায়, সেই যুবকের সঙ্গেই। - চলবে
Parent