ভাগ্যের খেলা【নতুন সূচনা- খন্ড ৭】 - অধ্যায় ১৪
নতুন সূচনা: খন্ড ৫
হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই ঘুম ভেঙে যায় অবন্তী। তখন ক’টা বাজে অবন্তী জানে না,জানার ইচ্ছে হচ্ছে না তার। অবন্তী বাঁ দিকে পিঠ করে শুয়ে ছিল,তার পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে আহানের জন্যে জায়গা সে আলাদা করে রেখেছে। হঠাৎ কি মনে করে অবন্তী পেছন ফিরলো আহানকে দেখতে। কিন্তু একি! তার পেছনে জায়গাটা খালি পরে আছে। অবন্তী তাকায় রুমের কোণে সোফার দিকে,তারপর বেলকনির দিকে। কিন্তু আহানকে কোথাও না দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে ওঠে অবন্তী। গতকাল রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে ক্লান্তির কারণে একটু আগে আগেই ঘুমিয়ে পরে সে। তবে সে ভেবেছিল আহান বিছানায় এসে শোবে। কক্সবাজার হোটেল একসাথেই এক বিছানায় ঘুমাতো তারা।তাই অবন্তী সংকোচ কেটে গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু অবন্তী যা ভেবেছে তা হয়নি। কারণ সোফায় একটা বালিশ ও চাদর পরে আছে। সে দিকে তাকিয়েই অবন্তী চোখ পরে সোফার সামনে ছোট্ট টেবিলটার ওপরে।আহানের দেওয়া শাড়িটা সেখানে টেবিলের ঠিক পাশেই মেঝেতে পরে আছে।আর তার থেকে একটু দূরেই একটা খাম ও কাগজ। এটা দেখেই চমকে ওঠে অবন্তী। বিছানা থেকে নেমে দ্রুত সোফার কাছে গিয়ে মেঝে থেকে কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে “ডিভোর্স পেপার”। কিন্তু কীভাবে!তার স্পষ্ট মনে আছে খামে পেপারটা ভরে সে রাত্রির সামনে টেবিলে রেখে দিয়েছিল,তাহলে এটা এখানে কেন! কি ভাবেই বা এলো এখানে। অবন্তী হঠাৎই মনে পড়লো। ফিরে আসার সময় রাত্রি তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়েছিল,তাহলে কি তখনই শাড়ির ভেতরে..।অবন্তীর ভাবনা শেষ হবার আগেই বাথরুমে কিছু একটা ভাঙার শব্দে আবারও চমকে ওঠে সে। বাথরুমে আলো জ্বলছে।অবন্তী পেপার টা ফেলে দিয়ে ধিরে ধিরে এগিয়ে যায় বাথরুমের দরজার দিকে। দরজাটা একটু খোলাছিল,তার ফাঁক থেকেই সাদা আলো বেরোচ্ছে। দরজার সামনে আসতেই আজান এক ভয়ে তার বুকের ভেতরটা কেমন ধুক ধুক করতে থাকে। অবন্তী আস্তে করে হাত রাখে দরজার হাতলে,তারপর অল্প ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায় বেশ কিছুটা। দরজাটা খুলতেই আহানের চেহারার দিকে তাকিয়ে অবন্তীর ভয় আরো তীব্র হয়ে ওঠে। বাথরুমের বেসিংয়ের সামনে বাঁ হাতে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাঁপছে আহান।তার পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। তার ডান হাত কেটে রক্তের ধারা গড়িয়ে পরছে আঙুল বেয়ে মেঝেতে পায়ের কাছে। কিছু কাঁচের টুকরো পরে আছে নিচে মেঝেতে আহানের পায়ের কাছে ও বেসিংয়ের ওপরে। বেসিংয়ের সামনের আয়নাটা ভাঙা,আহান আয়নায় ঘুষি বসিয়েছে তা বোঝার বাকি থাকেনা তার।অবন্তী ছুটে আহানের কাছে গিয়ে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে দুহাতে চেপে ধরে আহানের হাতটা। মুহূর্তের মধ্যেই আহান হাত ঝাড়ি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অবন্তীকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।
আহানের এমন আচরণে অবন্তী আহানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। আহানের চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।অবন্তী বুঝতে পারছে আহান নিজের মধ্যে নেই,এখন সে কি করছে সে নিজে ও জানে না।কিছুক্ষণ অবন্তীর দিকে তাকিয়ে থেকে একসময় আহান অবন্তী কাছে যেয়ে দুবাহুতে শক্ত করে ধরে অবন্তীকে পেছনের দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে রাগে চিৎকার করে বলে,“ আপনি কি করতে চাইছেন?” আহানের মুখটা অবন্তীর মুখের খুব কাছে চলে এসেছে। এই প্রথম আহানকে দেখে ভয় পেল অবন্তী,সে আহানের চোখের দিকে তাকাতেই পারছে না। অবন্তী ধিরে ধিরে চোখ খুলে দেখলো আহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। আহানের রাগি চোখের দৃষ্টিতে অবন্তীর সব গুলিয়ে গেলো।এই মুহুর্তে কি করা উচিৎ সে বুঝে উঠতে পারছে না। অবন্তী ভয়ে ভয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলতে লাগেল,“ আহান তোমার হাত... ।" কিন্তু অবন্তীকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে। আহান তার রক্তমাখা হাতে চেপে ধরে অবন্তীর বাঁ হাতের কব্জিতে। তারপর টানতে টানতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে অবন্তীকে নিয়ে,“উউঃ...কি করছো আহান! লাগছে আমার”
বাথরুম সেকে বেড়িয়ে সোফার কাছে এসে থামলো আহান তবে অবন্তী হাত ছাড়লো না। আহান কিছুটা ঝুঁকে ডিভোর্স পেপারটা হাতে তুলে নিয়ে বলতে লাগলো,“প্রতিটা মুহূর্ত কেনো জানি বড় একেলা ও অসহায় লাগে আমার। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করে ভয় হয় বাবা,মা কষ্ট পাবে বলে। আমি জানি আপনি ভালো নেই। কিন্তু আমি কি ভালো আছি? আপনার কি মনে হয়ে কষ্ট শুধু আপনি একাই ভোগ করছেন,আমার কোন কষ্ট নেই! আমি কি মানুষ নোই। আমাদের এই সম্পর্ক থেকে আপনার চাওয়া পাওয়া গুলো তো আপনি ওই দিন রাতেই বলে দিয়েছিলেন। কই আমিতো বলিনি কিছু। আমি শুধু বাবা,মা ও আপনাকে খুশি দেখতে চেয়েছি। আপনার কাছে শুধু মাত্র এটুকুই চাওয়া ছিল আমার। এটুকু চাওয়া কি খুব বেশি মনে হয়েছে আপনার কাছে!” অবন্তী তাকিয়ে দেখলো আহান সোফার সামনে টেবিলটায় ডিভোর্স পেপারটা রেখে কিছু কাঁচের চুড়ি তার বাঁ হাতে তুলে নিচ্ছে। অবন্তী বুঝতে পেরে হাত বারিয়ে থামাতে চায় আহানকে কিন্তু আহান তার হাতের কব্জি তে মোচড় দিতেই "আআঃ" বলে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। আর সেই সাথেই বাঁ হাতের এক চাপে চুড়িগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে আহান। অবন্তী দেখে আহানের বাঁ হাত কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে।এসব দেখে চোখে জল চলে আসে অবন্তী। সে কাতর কণ্ঠে বলে,“ আহান দয়াকরে এই সব থামাও,একটু শান্ত আআঃ...” তার হাতে আর একবার মোচড় পরে।তবে এবার আগের থেকেও জোরে। অবন্তী ব্যথায় কাতরে উঠে অন্য হাতে তা ছাড়ানোর চেষ্টা করে বিফল হয় সে।
– আঃ... আহান প্লিজ ছাড়ো আমায় প্লিজ।
– ব্যথা লাগছে তো,আমারও লেগেছে তবে মনে। আমার বিশ্বাস করতাম আপনি আমার সাথে খারাপ আচরণ করলেও,বাবা মাকে কখনোই দুঃখ দেবেন না। আমি আপনার কাছে ভালোবাসা চাইনি। স্বামীর অধিকার দাবি করিনি কখনো। শুধু চেয়েছিলাম এই দুঃখের সময় আপনি আমার পরিবারের পাশে দাড়াবেন।বাবা মা আপনাকে কতটা ভালোবাসে তা আপনি যানেন। তারপরেও সবটা যেনে এতটা স্বার্থপর হয়ে গেলেন আপনি। আসলে আমারই ভুল,বারবার মানুষ চিনতে ভুল করেছি আমি।
কথাটা শেষ করে আহান অবন্তীকে ছেরে দিয়ে ঘরথেকে বেরিয়ে গেল। অবন্তী সেখানেই মেঝেতে ধুপ করে বসে পরলো। সব ঠিক ছিল, হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল! আহান এতটা রেগে যাবে সে কল্পনায় করনি।এমন শান্ত একটা ছেলে কিভাবে এক মূহুর্তে এমন বদলে যেতে পরে। আহানের এই রুপ তার কাছে একদম অচেনা। ভাবনার মাঝে অবন্তীর হটাৎ মনে হলো আহানের দুহাত দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে।এমন রাগের সময় মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। আহান হয়তো..আর ভাবতে পারলোনা অবন্তী,উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে।
কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে অবন্তী দেখলো আহান বেরিয়ে গেছে। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে অবন্তী সেখানেই সোফায় বসে পড়লো। সে এতোদিন জেনেছে প্রতিটি মানুষের সুখ- দুঃখের সাথী হয় তার পরম বন্ধু। যার সাথে নির্দ্বিধায় মনের কথাগুলো ভাগ করে নেয়া যায়। রাত্রি তার ছোটবেলার বান্ধবী হয়ে তার সাথে এমন কিছু করবে সে ভাবতেও পারেনি। ভাবতে ভাবতে অবন্তী তার পায়ে হঠাৎই যন্ত্রণা অনূভব করলো। দেখার জন্যে পায়ের দিকে তাকাতেই সে দেখলো, টাইলস করা সাদা মেঝেতে তার রক্ত মাখা পায়ের ছাপ! তার পা কখন কেটেছে সে খেয়ালি করেনি.......
*********
(((???)))
– তো আইরিন হু!!
আহান ব্যাগে তার পোশাক গুলো ভরছিল ।রাজু তার সামনেই বসে আছে।আহানের থাকার জায়গা নিশ্চিত হয়েছে,তার জন্যই গোজগাছ চলছে।রাজুর কথায় আহান বললো,“জায়গাটা সুন্দর,একটু দূরে তবে কোন সমস্যা হবে না।তাছাড়া ওখানে আমি একা নোই আরো অনেকে আছে”
– অবশ্যই ওখানে আইরিন আছে আর কি চাই!
– রাজু এবার থাম প্লিজ।
– ঠিক আছে থামলাম, কিন্তু এই আইরিন নামোক প্রাণীটিকে আমার ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না।
– তোর সবকিছু তেই সন্দেহ হয়,এটা নতুন নয়।
– এটা ভিন্ন, কেন যেন মনে হচ্ছে মেয়েটার মাঝে একটা রহস্য আছে।ভবে দেখ,একা একটা মেয়ে তোকে এমন একটা গ্রুপের হাত থেকে বাঁচালো কিভাবে? আর তার পর অচেনা এক লোককে সোজা বাড়িতে ....
– ও একা ছিল না,সাথে পুলিশ ছিল। আমি নিজেও অনেক গুলো গাড়ির হর্ন শুনেছি। তাছাড়া আমি ভাড়া দিয়ে থাকবো,এখানে রহস্যজনক কি আছে?
এতোখনে আহান সব গুছিয়ে নিয়ে কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে,ডান হাতে গিটারটা তুলে নিয়ে বললো,“তাছাড়া এখানে থেকে আমি শুধু তোর ক্ষতি করছি। এই পর্যন্ত দুটো দামি গাড়ি ভাঙলো আমার কারণে, তাই...” আহানকে থামিয়ে দিয়ে রাজু বললো,“এনিয়ে তোকে ভাবতে হবে না,তাছাড়া বেশী কিছু হয়নি।তুই শুধু সাবধানে থাকিস। সবচেয়ে ভালো হয় যদি বক্সটা ফেলে দিস তো।”
– না বক্সটা ফেলবো না।ওটা কারো জীবন মৃত্যুর ব্যাপার হতে পারে। আমি লোকটাকে খুঁজে বের করবো।
– যাই করিস না কেন আগে ম্যাক্সের সাথে দেখা করবি। এদিকে এলিনা তোর ওপরে ভয়ঙ্কর রেগে আছে।
– জেনি কোথায় জানিস?
– জেনির চিন্তা পরে হবে ,আগে এলিনাকে সামলা..
কথা বলতে বলতে দুই বন্ধু বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো অ্যামেলিয়া ও আইরিন কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করে হাসাহাসি করছে নিজেদের মধ্যে।
– ইউ নো, দা ল্য এন্ড অর্ডার সিচুয়েশন ইজ ওর্সেনিং ডেই বাই ডেই।
কাছে গিয়ে আহান শুধু এটুকুই শুনতে পেলো,তারপর বন্ধু কে বিদায় জানিয়ে আহান গাড়িতে উঠে বসলো।ড্রাইভিং সিটে আইরিন উঠে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বললো,“ হোয়ার ইজ ইওর গার্লফ্রেন্ড?”
– শী ইজ নট মাই গার্লফ্রেন্ড। এন্ড ড্রাইভ স্লোলি প্লিজ!
আহানের কথায় আইরিন গাড়ির গতি আরো বারিয়ে দিয়ে বললো,“আচ্ছা! আপনি কি মৃত্যুকে ভয় পান?” আহান মুখ ঘুরিয়ে আইরিনকে দেখলো। আইরিন আজকে একটা নীল রঙে ড্রেস পরেছে ,সেটা তার হাঁটুর একটু ওপরেই শেষ হয়েছে। আর ড্রেসটার ওপরে কালো রঙের একটা সর্ট জ্যাকেট। তার চুলগুলো খোলা,গাড়ি গতির সাথে কিছু চুল উরছে।আহান লক্ষ করল মেয়েটাকে দেখে তার কেন যেন ভালো লাগছে, কিন্তু কারণটা অজানা। মেয়েটি সম্পর্কে সে যথেষ্ট কৌতূহল অনুভব করছে মনের ভেতরে। মেয়েটার সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে তার্। আচ্ছা মেয়েটির বয়স কত হতে পারে? জানা হয়নি। আইরিনের গলার স্বর মিষ্টি। কিশোরীদের মতো কাঁচা।কিন্তু তাতে কিছু বোঝা যায় না।
– কি হলো এমন চুপ করে আছেন কেন?
আহানের ভাবনায় বাধা পেল আইরিনের প্রশ্নে। সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
- কোন!আপনি পান না বুঝি?....
~~~~~~~~~~~~~~~~|
*******
– এমনটা কেন করলি রাত্রি?
– ......
– কথা বলছিস না কেন!কিছু তো বল।
– ..কেন করলাম! সত্যিই অবন্তী এটা তোর প্রশ্ন! কেন করেছি তা তোর চেয়ে ভালো আর কে জানবে বল। তাছাড়া আমি তোকে বলেছিলাম,আমি ওকে চাই যেকোনো মূল্যে। তুই আমার ছোট বেলার বান্ধবী।আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনা, তাই তোকে আবারও বলছি আমার ও আহানের মাঝে থেকে সরে যা তুই। এটা শুধু একটা ওয়ার্নিং ছিল মাত্র। এর পরেও যদি তুই এই খেলা খেলতে চাস,তো মনে রাখিস। আমি আহানকে তোর থেকে অনেক বেশি জানি।ওর প্রতিটি দূর্বল জায়গা আমার চেনা।তাই খেলায় তোর হার নিশ্চিত।
এটুকু বলেই ফোনের ওপারে থেকে লাইন কেটে গেল।আর ঠিক এমন সময় রুমের দরজা ঠেলে মিস রাইহানা ঢুকলো রুমে।
– অবন্তী একি হাল করেছো ঘরের!
রুমে ঢুকেই মেঝেতে রক্তের ছাপ দেখে চমকালেন মিস রাইহানা। অবন্তী বিছানায় মলিন মুখে বসে আছে দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে বসলেন অবন্তীর পাশে।পাশে বসেই তিনি দেখলেন অবন্তীর বাঁ হাতের কব্জিতে রক্ত জমাট বেধে লালচে আকার ধারন করেছে। অবন্তী এমনিতেই খুব ফর্সা। যার কারনে খুব ভালোভাবে দাগটা দেখা যাচ্ছে। এটা দেখে উনি দুহাতে অবন্তীর মুখটা ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বললেন।,“বাড়ির লোকজন কোথায়! নিচে গেইট খোলা!কি হয়েছে একটু খুলে বলতো আমাকে....
********
আহান বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা মাজারের সামনে চলে আসতেই কেউ একজন পেছন থেকে তাকে ডাকলো। আহান পেছন ফিরে দেখলো একটা লোক বাম হাতের একটা প্যাকেট থেকে কিছু একটা নিয়ে ডান হাতে খেতে খেতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার চেহাড়ায় মাতাল মাতাল একটা ভাব বোঝা যাচ্ছে । আহান পেছন ফিরেছে দেখে লোক আহানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,“ ভাই কয়টা বাজে” আহান ঘড়ি পরে না তাই পকেটে হাতদিয়ে মোবাইলটা নিতে গিয়ে দেখলো মোবাইল টা বাসায় ফেলে এসেছে।তাই সে লোকটাকে না বলে যখন পেছন ফিরবে।ঠিক তখনই তার সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থামলো।
আহান এখন ওসি মনির সাহেবের গাড়িতে বসে আছে।গন্তব্য তার অজানা,তবে কারণটা আহানকে ভাবিয়ে তুলছে। তারা আহানের ভাই হাসানের গাড়ির খোঁজে যাচ্ছে। প্রথমে কথাটা আহান বুঝতে পারেনি।তারপরে জানলো হাসানের গাড়িটা তার মৃত্যু একদিন আগেই চুরি হয়েছে তার সাথে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট ও হাসানের ল্যাপটপ। আহান অবাক হচ্ছে এইভেবে যে অবন্তী বা বাড়ি কেউ তাকে কিছুই জানায়'নি এই বিষয়ে। এখন এসব জেনে অবন্তীর প্রতি রাগটা হটাৎ যেনে আরো বেরে যাচ্ছে তার।মনে মনে সে বললো,"কি ভাবে মেয়েটা নিজেকে!”।
ইতি মধ্যেই আহানের দুহাতে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। তারা যখন গন্তব্য স্থলে পৌঁছালো তখন সকালের আলো সম্পূর্ণ ভাবে ফুটেছে।গাড়ি থেকে নেমে আহান গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলো সামনে একটা দোতলা বাড়ি সাথে গাড়ি রাখার একটা গ্যারেজ।আর তার সামনে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।কাছে যেতেই গ্যারেজের সাটার খোলা হলো। ভেতরে ধূসর রঙের এসইউভি দাড়িয়ে আছে। গাড়িটি চিনতে তার অসুবিধা হলো না। তবে গাড়িটি ও বাড়িটি তল্লাশি করে হাসানের ল্যাপটপ বা অফিসে কোন কাগজপত্র পাওয়া গেল না।
ওসি মনির সাহেব আহানকে দোতলায় যেতে পললো। আহান বাড়িটা ঘুরতে ঘুরতে চলে এলো সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে একটা দরজা খোলা দেখে আহান এগিয়ে গেল সেদিকে।আহানের জন্যে ওপরে কেউ অপেক্ষা করছে, এমনটাই বলা হয়েছে তাকে। রুমে ঢুকে আহান দেখলো রুমটা খালি। রুমটাতে মাঝখানে একটা লাল চাদর বিছানো বড় একটা বেড। তার চারপাশে মেঝেতে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো প্রদীপ। প্রদীপগুলো নেভানো এবং একটু পুরনো মনে হচ্ছে।কয়েকটা প্রদীপ মেঝেতে উল্টো হয়ে পরে আছে। আহান এগিয়ে গেল দরজার সোজাসুজি পর্দা দিয়ে ঢাকা দেয়ালটার দিকে।সম্পূর্ণ দেয়ালটা পর্দা দিয়ে ঢাকা কেন সেটা বোঝার জন্যে।পর্দা সরিয়ে দেখলো সম্পূর্ণ দেয়ালটা কাঁচের। কাঁচের ওপারে বাড়ির পেছন দিক। সেখানে একটা ছোট্ট বাগানের মতো,তবে কেউ খেয়াল রাখেনি বলে তা অনেকটা জংলার মতো হয়ে আচ্ছে। হঠাৎ আহান তার পেছনে একটা পরিচিত গলার স্বর শুনতে পেলো। কেউ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইছে-
"ইয়ে জিসম হ্যায় তো কেয়া"
"ইয়ে রুহ কা লিবাস হ্যায়"
"ইয়ে দর্দ হ্যায় তো কেয়া"
"ইয়ে ইশক কি তালাশ হ্যায়"
"ফানা কিয়া মুঝে"
"ইয়ে চাহনে কি আস নে"
"তারাঃ তারাঃ শিকাস্ত হি হুয়া"
গানটা থামতেই আহান পেছন ফিরে দেখলো রাত্রি দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে,তার দিকেই তাকিয়ে আছে।আহান পেছন দিকে ফিরতেই রাত্রি হাসি হাসি মুখে বললো,“ওয়েলকাম টু দ্যি হাউন্টেড হাউস আহান,ওওয়েলকাম”....
*******
(((???)))
– আচ্ছা আহান! তোমার কি মনে হয়!কি থাকতে পারে এই বক্সে?
আইরিন বাড়ির বাইরে সিঁড়িতে আহানের কাধেঁ মাথা রেখে বসে আছে। তার হাতে সেই বক্সটা। এইবাড়িতে আহান এসেছে প্রায় তিনমাসের মতো হয়েছে। বাড়িটার পরিবেশ ও লোকজনের সাথে আহানের মিলমিশ এখন আইরিনের থেকেও বেশি।তবে এটা নিয়ে আইরিনের কোন মাথা ব্যথা নেই বললেই চলে।আইরিন বাড়িতে যখনি ফ্রি সময় পায় সে আহানের বক্সটা নিয়ে বসে পরে।আর মাঝে মাঝেই আহানকে বিভিন্ন ভাবে বক্সটা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। যেমন,এটার ভেতরে কি আছে?'এটা নিয়ে আহানের প্ল্যান কি? কে তাকে এটা দিয়েছে এবং সে এখন কোথায় বা তার সাথে আহানের কোন যোগাযোগ আছে কি? আর প্রতি বার আহানের উত্তর হয় না বা জানি না। তবে আহানের এই উত্তরে আইরিন খুব একটা দমে না।সে কিছু দিন পরে আবার একি প্রশ্ন করে। মেয়েটির এমন কৌতূহল দেখে আহান একবার বলেছিল,“চলো ভেঙে দেখি কি আছে এটার ভেতররে,কি বলো?”আহানকে অবাক করেদিয়ে এরপর থেকে আইরিনের প্রশ্ন ধিরে ধিরে কমে আসে।তবে এতোদিন তাদের দুজনের মনের অজান্তেই তারা যে একে অপরের কতটা কাছাকাছি এসে গেছে সেটা তারা হয়তো জানে না বা জেনেও বুঝতে চাইছে না।
আহান আইরিনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে আইরিনের দিকে একটা হাত বারিয়ে দিয়ে বললো,“ তোমাকে কিছু একটা দেখাবো এসো” আইরির আহানের হাত ধরলো। আর আহান তাকে টেনে তুলে এগিয়ে গেতে লাগলো গাড়ির দিকে।,“আহান আমরা কোথায় যাচ্ছি?” আহান কোন কথা বললো না।গাড়ির সামনে এসে একটা দরজা খুলে ধরলো।আইরিন একবার আহানের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো।মনে হয় কিছু বোঝার চেষ্টা করলো। তারপরে উঠে বসলো গাড়িতে।আহান গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো।দেখতে দেখতে গাড়িটা বাড়ির রাস্তা থেকে বেরিয়ে উঠলো বড় রাস্তায়।আইরিনের আহানের মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে বোঝার চেষ্টা করছে আহানের মনে কি চলছে।দুজনের মাঝে কোন কথা নেই।গাড়ির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ আসছে না তাদের কানে।প্রকৃতি যেনো নীরবতা পালন করছে। আর এরমাঝে আহান চোখ রাস্তায় আর আইরিনের আহানের দিকে।একসময় গাড়িটি ঘন গাছের সারি পার করে এগিয়ে চললো পাহাড়ি পথে।
বেশকিছুটা গিয়ে এক সময় আহান গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে এলো। গাড়ির দরজা খুলে আইরিনের দিকে ডান হাতটা বারিয়ে দিয়ে বললো,“প্লিজ ক্যাম উইথ মি” আইরিন এই প্রথম সংকোচে বোধ করলো আহানের হাত ধরতে। হয়তো এই অনূভুতিটা তার জন্যে প্রথম। কিন্তু কিসের অনুভূতি!
একসময় সংকোচ কাটিয়ে আইরিন হাত ধরলো আহানের।আহান আইরিনের হাতটা একটু শক্ত করে ধরলো,“আহান আস্তে!এই!আঃ” আচমকা একটান দিয়ে তাকে বের করে আললো গাড়ি থেকে। তারপর আহান তাকে টেনে নিয়ে হাটতে লাগলো।
কিছুদূর এগিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে টিলার উপর উঁচু একটা জায়গায় উঠে এলো তারা।এখান থেকে পাহাড়ী পথটা ডানে বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে, তারা সেদিকে এগিয়ে গেলো। আহান সামনে ও আইরিন তার পেছনে হাঁটছে। দেখতে দেখতে তারা দুজন চলে এলো একটা লেকের ধারে। আহান আইরিনের হাত ছাড়তেই,আইরিন কিছুটা এগিয়ে গেলো লেকের ধারের দিকে।বিশাল লেকের স্বচ্ছ জলরাশিতে ছোট ছোট ঢেউ খেলছে। দূরে একটা স্পিডবোট দেখা যাচ্ছে। তাতে একটা লোক ফিশিং লাইন নিয়ে বসে আছে আর তার পাশেই এক রমণী বসে।আইরিন লেকের একদম ধারছ দাঁড়িয়ে আছে।
লেকের বাতাস উচ্ছল করে তুলেছিল তাকে। দেখে ভাল লাগল আহানের। বেশ কয়েকদিন ধরে আইরিনকে ঠিক ভালো ঠেকছিল না তার। মেয়েটি সমসময় হাসিখুশি, কিন্তু মাসখানেক ধরে হঠাৎই কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সে। আহান বোঝার চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারেনি।তবে এটুকু বুঝেছিল প্রকৃতি এমন অবস্থায় মহৌষধির কাজ করবে আইরিনের জন্যে। এখন লেকের হাওয়ায় আইরিনের ড্রেসটা তার সামনের দিকে সেটে যাচ্ছে।বাতাসে সঙ্গে তাল মিলিয়ে এলোমেলো ভাবে উড়ছে তার খোলা চুলগুলো।হঠাৎ আইরিন বললো,“আমার খুব উড়তে ইচ্ছে করছে আজ।সাথে ওয়াইন এনেছো?,আইরিনের কথা শুনে আহানের মনে হলো যেন তার গলাতেও খেলছিল সেই এলোমেলো বাতাস। আহান বারবার লক্ষ্য করেছে মেয়েটা খোলা প্রকৃতির মাঝে এসে যেন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়।
আহান আইরিনের দিকে একবার দেখে নিয়ে নিচে কোন কথখ না বলে ঘাসের ওপরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো।তার দেখাদেখি আইরিনও এগিয়ে এসে শুয়ে পরলো তার পাশে। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ থাকার পরে হঠাৎ আহান বললো,“প্রেম মানুষকে কি করে বলতো?”আইরিন মুখে ঘুরিয়ে তাকালো আহানের দিকে।কিছু একটা বলতে গিয়ে তার কথা আটকে গেল মুখে বলা হলো না।এদিকে আইরিনের নীরবতায় আহান বলতে লাগলো,“আমি কিছু বলতে চাইলে ঘুরিয়ে বলতে পারিনা।....জানো আমি কখনোই ভালোবাসিনি,তোমাকে দেখার আগে কখনো বাসবো বলে মনেও হয়নি।তবুও বসবো না বাসবো না বলে মনকে বোঝাতে বোঝাতে আমি আজ ক্লান্ত। যে দিন সিদ্ধান্ত নিলাম এখানে আসার,তোমার সাথে থাকার। সেদিন মনে মনে বলেছিলাম ভালোবাসাটাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে আবার নিজের পথে ছুটবো আমি। কিন্তু আজ এই মূহুর্ত আমি তোমার কাছে বন্দী। আমার প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি রয়েছো আমার চেতনায়। আমি অবশ্য তোমাকে বলতে পারবো না তোমার কি কি দেখে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। তবে আমি জেনেগেছি যেই আবেগের ফাঁদে আমি পরেছি তার থেকে আমার ফিরে যাওয়ার সকল রাস্তাই এখন বন্ধ। তাই আজ তোমায় বলছি আইরিন আই লাভ ....” এটুকু বলেতেই আইরিন আহানের মুখ চেপে ধরলো। আইরিনের মুখটা এখন উঠে এসেছে আহানের মুখের কিছুটা ওপরে।তার লালচে চুলগুলো পরছে আহানের বাঁ পাশে গাল ছুয়ে সবুজ ঘাসের ওপরে। কিন্তু আহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আইরিনের চোখের দিকে।আইরিনের হাস্যজ্জল মুখ এখন বদলে গেছে। তার টানা টানা দুচোখ দিয়ে নেমে আসছে অশ্রু ফোটা।সেই ফোটাগুলো তার ফর্সা গাল দিয়ে নেমে চিবুক ছুয়ে পরছে আহানের চোয়ালে ও গলায়।
– আহান ডোন্ট ডু দ্যাট টু মি প্লিজ.
আহান তার বাঁ হাতটা ধিরে ধিরে আইরিনের গাল ছুয়ে ডুবিয়ে দিলো তার ঘন চুলে,মুখে একটু হাসি এনে ডান হাতে আইরিনের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বললো,“আমি অনেকের ভালোবাসা প্রত্যাখ্যান করেছি। তখন ভালোবাসা কি বুঝতে পারিনি। আজকের এই অনূভুতি টুকুও আমার বোঝার বাইরে।তবে তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান করো,তোমাকে দোষারোপ করবোনা আমি। বুঝবো এই শাস্তি আমার পাওনা ছিল।তবুও বলতে বাঁধা নে,আমার পক্ষে যতটুকু ভালোবাসা সম্ভব তার সবটুকুই দিতে মন চাইছে.....
আহানের কথা এখানে থেমে যায়। আইরিনের ঠোঁট জোড়া নেমে এসেছে আহানের ঠোঁটে ওপরে। গোধূলির আবিরে রাঙা অস্তায়মান লাল সূর্যের সাথে দুজনের ঠোঁট জোড়া মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । প্রকৃতিতে যেন নেমে আসে অন্যরকম এক প্রশান্তি। চুম্বন রত দুই নরনারীর ওপর দিয়ে একঝাঁক পাখি নীড়ে ফিরে যাচ্ছে সশব্দে । তারপরে যেন সর্বত্রই বিরাজ করে এক নৈসর্গিক নীরবতা। সূর্যের রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজিয়ে তুলছে।লেকের স্বচ্ছ জলে সূর্যাস্তের এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আলোড়ন করে যাচ্ছে। স্বর্গীয় আভায় রাঙ্গনো আকাশ। আর সেই আকাশের নিচে সবুজ ঘাসের চাদরে সবার অগোচরে হচ্ছে নতুন কোন এক অনূভুতির সূচনা। একি ভালোবাসার অনূভুতি!হতে পারে। তবে এখন দুজনের দেহ যেন মিশে যাচ্ছে একে অপরের সাথে। তাদের মাঝে প্রেম ছিলো, না আবেগ? কতটুকু জানতে চেয়েছিলে তারা। হতো সবটাই ভুল,হয়তো সবটাই মায়া।তবে আহান জানে তার জীবন নদীর তীরে প্রেম নামক জাহাজ এসেছে ভিরেছে....
~~~~~~~~~~~~~
********
– তো দীবা ফিরবে কখন?
মিস রাইহানা কফির কাপটা অবন্তী সামনে রেখে তিনি অবন্তীর মুখোমুখি বসলেন। তারা ছাদে বসার একটা টেবিলে বসে ছিল। অবন্তী চুপচাপ বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল,মিস রাইহানার প্রশ্নে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো,“ মা বাবার গতকাল সন্ধ্যায় ফেরার কথাছিল।কিন্তু রাতে ফোন করে বললো কয়েকদিন থাকবে সেখানে।” কথাটা শুনে উনি কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বললেন,“তাহলে তো ভালোই,পারিবারিক অশান্তিটা আর হবে না।”
– মানে!
– অবন্তী বোকার মত কথা বলোনা।তুমি যা বললে তা কি তোমার মনে হয় রাত্রি এখানেই থামবে!
অবন্তী চুপকরে গেল, কারণ সে জানে রাত্রি এখানেই থামবে না।
– এখন তোমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা,তুমি কি সরে যাবে! নাকি নিজেকে ওর পরবর্তী আঘাতের জন্যে প্রস্তুত করবে।
– আমি জানিনা আমার কি করা উচিৎ, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
– এটা বললে তো হবে না অবন্তী।আমি জানি ও তোমার বান্ধবী,তবে এই লড়াই টা ওর কাছে ভালোবাসার। আর ভালোবাসার লড়াইয়ে মানুষ কতটা বেপরোয়া করতে পারে, তা তুমি যতখনে কল্পনা করবে।ততখনে হয়তো রাত্রি দ্বিতীয় আঘাতটা দেওয়ার জন্যে তৈরী হয়ে যাবে।এমনো হতে পারে ইতিমধ্যে তা দিয়েও দিয়েছে। তাই জলদি সিদ্ধান্ত নাও তোমার মন কি চায়?
এটুকু বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।তারপর অবন্তীর কাছে এসে তার ডানহাত দিয়ে অবন্তীর চিবুক তুলে দেখলেন,অবন্তীর চোখের জল তার গাল বেয়ে নেমে আসছে। দুহাতে তা মুছে দিয়ে তিনি বললেন,“আমাদের জীবনে এমন বহু খারাপ সময় আসে যা ভুলে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।আসলে, পুরোনো স্মৃতি কেবল কষ্টই দেয় । চাইলেও নিজের অতীতকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয় অবন্তী । তাই দিনের পর দিন ফেলে আসা অতীতের কথা মনে করলে, নিজের বর্তমানের উপর খারাপ প্রভাব পরবে এবং বর্তমানে ঘটে যাওয়া সুন্দর মুহূর্তগুলি নষ্ট হবে । তবে চাইলেই পুরোনো স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভব। জীবনে এগিয়ে যেতে হলে অতীতকে ভুলতেই হবে। তুমি যদি সত্যিই চাও আহান সুস্থ হয়ে উঠুক।তাহলে আমি বলছি, রাত্রি আহান জন্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তুমি ডিভোর্স নিতেই পারো,তবে একটু ভেবে দেখো এই পরিবারের সদস্যরা তোমার এই সিদ্ধান্তে কতটুকু ব্যথা পেতে পারে। তারপর বাকিটা তোমার ইচ্ছে। এখন আমাকে উঠতে হবে ,যদিও তোমাকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না।তবে আমি দীবার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।এখন এতখ থাকতে হবে তা ভাবিনি। আমাকে আজ ঢাকার বাইরে যেতে হবে।তাই হয়তো আজ আর আসতে পারবো না।তবে আমার কথাটা ভেবে দেখো....
******
– আজ সকালেই যে তোমার সাথে দেখা হবে ভাবিনি।ঘটনা এমন হওয়ার কথা ছিল না। আমি ভাবিনি পুলিশকে ফোন করার সাথে সাথে তারা এসে হাজির হবে।আর সাথে বোনাস হিসাবে তুমি। যাই হো,ভালোই হলো তোমাকে কিছু দেখানোর আছে আহান।
আহান ও রাত্রি বাড়িটির বাইরে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহানের এই মূহুর্তে রাত্রির সাথে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না।তবুও তাকে থাকতে হচ্ছে কারণ তাকে বাড়ি ফিরতে হলে পুলিশের গাড়ি করেই ফিরতে হবে।তারা এখন ঢাকার বাইরে।আজ ভোরে অবন্তীর সাথে রাগ করে আহান ফোন ও ম্যানি ব্যাগ বাসায় ফেলে এসেছে। আহানকে চুপচাপ দেখে রাত্রি বললো,
– চলো কোন ক্যাফেতে বা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি, ওদের সময় লাগবে। তোমার নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি।অবশ্য এমন পরিস্থিতিতে খাওয়াদাওয়ার কথা মাথায় থাকে না।
– এমন পরিস্থিতি মানে!
– এমন ভাব করছো যেন কিছুই জানো না।
– রাত্রি প্লিজ হেয়ালি করোনা,যা বলতে চাও স্পষ্ট করে বলো।
– আজ ভোরে অবন্তীর সাথে যে ঝগড়া হলো সেটার কথা বলছি আমি। তবে তোমাদের সম্পর্কটা এমনিতেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বলা যায় না। যেখানে তোমার মধুচন্দ্রিমার বেশিরভাগই কেটেছে বাড়ির ছাদে,সেই সম্পর্ক আর যাইহোক স্বাভাবিক তো নয়।তাই আমার মনে হয় এবার তোমার উচিৎ এই মিথ্যে বাঁধন থেকে অবন্তীকে মুক্ত করা...
রাত্রি কথার কোন জবাব আহান খুঁজে পেল না।এই মুহূর্তে সে মানসিক ভাবে এমন কথা হজম করতে তৈরি ছিল না। রাত্রি অবন্তীর বান্ধবী তাই বলে তাদের পারিবারিক ব্যপারে এতো ও জানবে কেন। আহানের আর এক মুহূর্তও আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। তাই সে পেছন ফিরে চলে যেতে চাইলো।কিন্তু শেষ মুহুর্তে রাত্রি আহানের হাত ধরে বললো,“ কিছু না বলেই চলে যাবে!তোমার সাথে অনেক কথা ছিল আমার।” আহান এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,“ এই মূহুর্তে আমার কোন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”এটুকু বলেই আহান পেছন ফিরে চলে যেতে লাগলো।আহানকে চলে যেতে দেখে রাত্রি পেছন থেকে জোরগলায় বললো,“ আমি বলেছিলাম অবন্তী ও হাসানের মাঝে সমস্যা চলছে,জানতে চাও না কেন বলেছিলাম!?” এটুকু বলতেই আহান পেছন ফিরল। রাত্রি তার হান্ড ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে এগিয়ে এসে খামটা তার ডান হাতে চেপে ধরলো আহানের বুকে।তারপর বললো,“হয়তো সবটুকুই ভুল। হয়তো রাগের বশে তোমার অনেক বড় ক্ষতি আমি কেরেছিলাম। কিন্তু আহান এখন আমি পাল্টেছি,তবে আমার ভালোবাসা পাল্টে যায়নি। মনে রেখো আমি সবসময় তোমায় ভালোবেসেছি। যদি আমার প্রতি একটুখানিও বিশ্বাস হয়,তো ঠিকানা তোমার জানা চলে এসো, আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার।” কথাগুলো বলেই রাত্রি আহানকে পাশ কাটিয়ে চলেগেল আর খামটা খসে পড়লো আহান বুক থেকে মাটিতে। আহান একদৃষ্টিতে রাত্রির যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ছিল, যতখন তাকে দেখা গেল।অবশেষে মাটিতে পরে থাকা খামটা হাতে তুলে নিল সে। খামটা খুলেতেই কতগুলো ছবি বেরিয়ে এলো খামটা থেকে। ছবি গুলো রাতে কোন এক রেস্টুরেন্টে তোলা। ছবিতে অবন্তী ও ফারুক বসে আছে খাবার টেবিলে।তারা দুজনেই হাসছে.....
********
ডাইনিং টেবিলের এক কোনায় একটা চেয়ারে বসে আছে অবন্তী। মুখটা কাঠিন্যের মুখোশে আটকে ফেলেছে সে। এতে করে তার অসচেতন অনিচ্ছায় যা ঘটেছে, তা হলো তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বলতে গেলে পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। যদি সে এখন আয়নায় তার আচমকা বদলে যাওয়া মুখের আঁকাবাঁকা রেখাচিত্র দেখতে পেত, ঠিকঠিক সে নিজেই লজ্জা পেয়ে কাউকে কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে সামলে নিত। কিন্তু অবিবেচকের মতো সবটা না জেনে তাকে দোষ দেওয়াও বোধহয় ঠিক হবে না। হঠাৎ করে চরম অনাকাঙ্ক্ষিত, যাকে অন্যরা বলবে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অস্বাভাবিকতায়,আজকের ঘটনার মুখোমুখি হয়ে পড়ায় বেচারি বেশ কিছুটা হতচকিত। সে নিজেকে সহজে সহজ করে উঠতে পারেনি এখনো। এটা তার বসে থাকার ভঙ্গি থেকে শুধু অনুমান করা যেতে পারে। আরো যেটা অনুমান করা যাচ্ছে, তার চরিত্রের স্বভাবগত দৃঢ়তার কারণে সে এখনো নিজেকে শক্ত রাখাতে পেরেছে।
অবন্তী রান্না সেরে টেবিলে দুজনের খাবার নিয়ে বসে আছে সেই দূপুর থেকে। এখন প্রায় সন্ধ্যা আহান বাড়ি ফেরেনি এখনো। সে মনে মনে ভাবছে আহান কিছু খেয়েছে কিনা। তারপর হঠাৎই তার মনে পড়লো আহানের মানসিক অবস্থার করা। যদি হটাৎ কিছু একটা হয়ে যায় তখন! এখন কি করা উচিৎ তা অবন্তী ভেবে ভেবে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগেই বাড়ির কলিংবেল টি হঠাৎ বেঝে উঠলো। অবন্তী ব্যস্ত হবে এগিয়ে গেলে দরজার দিকে।দরজা খুলতেই আহান এগিয়ে এসে আবন্তীর দুই বাহুতে ধরে পাশের দেয়ালের সাথে ঠেসে ধরল তাকে।ঘটনার আকস্মিকতায় অবন্তী দুচোখ বন্ধ করে ফেলল.....
Continue.......