দাগ - অধ্যায় ১

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-66166-post-5814993.html#pid5814993

🕰️ Posted on November 26, 2024 by ✍️ শূন্যপুরাণ (Profile)

🏷️ Tags:
📖 1256 words / 6 min read

Parent
উচ্চ স্বরে মেয়েলি কণ্ঠের কান্না শোনা যাচ্ছে। মৃতের বাড়িতে যেমনটা শোনা যায়, সেরকম। এর মধ্যে যার সুর সবচেয়ে চওড়া তিনি সাজ্জাদের ছোট ফুফু। ভদ্রমহিলার বয়স সম্ভবত সাজ্জাদের মায়ের মতোই হবে। মজার ব্যাপার হলো আজকে তার কান্নাকাটি দেখে যে কারো মনে হতে পারে স্বজন হারানোর বেদনায় এই মহিলার বুঝি বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু আসল ঘটনা এর উল্টো।  সাজ্জাদেরা সমাজের যেই প্রান্তের অংশীদার, সেখানকার সম্পর্কগুলো এমনই। খালি চোখে এগুলোর প্রকৃতি নিরুপণ করা জটিল কাজ। বাইরের দিকটা যেমন চকচকে, ভেতরটা তেমনই ভিন্নরকম — ঘোলাটে, অস্বচ্ছ। ইংরেজিতে যাকে বলে Shady.  ছোটবেলা থেকে ধীরে ধীরে সাজ্জাদ মানব সম্পর্কের এইসব কানাগলি বুঝতে শিখেছে। আর যত বুঝেছে, ততই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজের আলাদা জগৎ গড়ে তুলেছে। এমনকি একই শহরে থেকেও ১ যুগের বেশি সময় ধরে নিজের পৈতৃক বাড়িতে আসেনি। ঢাকার অভিজাত এলাকায় কোটি টাকা মূল্যের বাড়িতে সাজ্জাদের বিধবা মা, ডাক্তার শায়লা, একাই বাস করছিলেন। তবে এখন আর তিনি এ বাড়িতে থাকেন না। এখন তিনি অতীত হয়ে গেছেন। গত রাতে আনুমানিক তিনটায় ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছেন শায়লা। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে এতো বছর পরে ওকে বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে। একদিকে সাজ্জাদের মায়ের কফিনের কাছে কান্নাকাটির আসর চলছে, অন্যদিকে সে বিব্রত মুখে নিজের বাপ মায়ের বেডরুমে রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে।। যদিও এই মুহূর্তে তারও উচিত ছিলো মায়ের কফিনের গায়ে উথাল পাথাল কান্নায় ভেঙে পড়া। সে তার বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান। সে না কাঁদলে কে কাঁদবে! কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ওর অভিব্যক্তিতে সুখ-দুঃখ কোন অনুভূতিরই ছাপ নেই। মায়ের মৃত্যুর দিনে একমাত্র ছেলে চোখ মুখ কুঁচকে করে বসে আছে এটা বাঙ্গালী সমাজের পক্ষে হজম করা কঠিন। তাই অন্যদের চক্ষুবাণ এড়াতে এই ঘরটিতে একরকম আত্মগোপনে আছে সাজ্জাদ। বাড়ি ভর্তি লোকজনের ভীড়ে একমাত্র এই ঘরটিই ফাঁকা পাওয়া গেছে। সিগারেট ধরাবে বলে অন্যমনস্কভাবে নিজের পকেটে হাত দিতেই বেডরুমের দরজার কাছে শব্দ টের পেলো।  দরজার মুখে সাজ্জাদের মেজচাচী দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার ঠিক পেছনেই এক তরুণীর ফর্সা মুখ দেখা যাচ্ছে। দোল খাওয়া বন্ধ করে কৃত্রিম সৌজন্যতা দেখিয়ে বললো, "আসুন চাচী। ভেতরে আসুন।''  ''এখানে একা একা মন খারাপ করে বসে আছো কেন বাবা?" মেজচাচী একটু দূরে খাটের উপর বসতে বসতে বললেন। সাজ্জাদ ভালো করেই জানে ওর চেহারায় মন খারাপের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। কিন্তু তারপরেও এই মেকি বক্তব্যটা শুনতে হলো।  কারণ এটাই এই সমাজের অভ্যাস — আসল কথা বলার আগে কিছু মেকি ভূমিকার অবতারণা করা। সাজ্জাদ মেজচাচীর প্রশ্নের জবাব দিলো না। ''সবাইকেই তো দুনিয়া ছাড়তে হবে বাবা। বাপ মা চিরকাল কারো থাকে না। অন্তত এইটা শুকরিয়া করো যে তোমার বাবা তোমার মায়ের নামে যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলো তা দিয়ে তোমার মা কম্ফোর্টেবলি জীবনটা পার করতে পেরেছিলেন৷ শেষ বয়সে চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে আফসোস ছিলো না। আফসোসের ভিতরে একটা আফসোসই ভাবী করতো। সেটা তোমাকে নিয়ে। একমাত্র ছেলে থাকা সত্ত্বেও তাকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে। তোমাকে কাছে পায়নি। এটাই বড় দুঃখ তার।" নিশ্চুপ সাজ্জাদ মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো। ''সে যাই হোক। আমি যে জন্য এসেছি বাবা। এই মেয়েটিকে তুমি হয়তো চেনো না। ওর নাম জেরিন।'' ''স্লামালাইকুম।'' জেরিন নামের মেয়েটি মিষ্টি কন্ঠে সালাম দিলো সাজ্জাদকে। সালামের শব্দে এই প্রথম সাজ্জাদের নজর পড়লো মেয়েটির উপর। আসলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও মেজচাচীর উপস্থিতির কারণে সেভাবে লক্ষ করেনি মেয়েটিকে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। এমন দিনেও জেরিনের অপরূপ সৌন্দর্য সাজ্জাদের নজর এড়ালো না। বয়স আর কতই বা হবে! ১৮ থেকে ২১ এর ভেতরে কিছু একটা। উচ্চতা গড় বাঙালি মেয়েদের তুলনায় কিছুটা বেশি। গায়ে সাদা রঙের সালোয়ার কামিজ। পাতলা ওড়না মাথার উপরে অর্ধেক তুলে দেওয়া। পান পাতার মতো মুখের দুপাশ দিয়ে ঘন কালো দু গোছা চুল  ঝুলে পড়েছে। মেয়েটির হলুদ ফর্সা গায়ের রঙ থেকে যেন আলো ঠিকরে বের হচ্ছে।  "ওয়ালাইকুম আসলাম।" বিমোহিত সাজ্জাদ সালামের উত্তর দিলো। "জেরিন তোমার রাসেল মামার একমাত্র মেয়ে। রাসেলকে তো মনে আছে নিশ্চয়ই।"  হঠাৎ সাজ্জাদের পেটের ভিতরটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। স্মৃতির অতল অন্ধকারে কোথাও একটা আন্দোলন তৈরি হলো। মনের আন্ধারলোকে লুকিয়ে রাখা কোন বদ্ধ কুঠুরির পাল্লায় প্রবল ধাক্কা দিলো এই নামটি —  রাসেল! রাসেল!   অদ্ভুত এক অনুভূতি! অনুভূতিটা জট পাকিয়ে পোক্ত হওয়ার আগেই মেজচাচীর একঘেয়েমি গলার স্বর পুনরায় তাকে বর্তমানে টেনে আনলো। ''জেরিনের মা ও জেরিন গতকালই আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছিলো। তোমার মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে আজকে দেখতে এসেছে।''  সাজ্জাদ বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে শুকনো মুখে কেবল বললো, "আচ্ছা।"  ওকে চুপ থাকতে দেখে জেরিন বললো, "ভাইয়া আপনি মন খারাপ করবে না। She will be in heaven for sure."  সাজ্জাদ মুচকি হেসে কাঁধ ঝাঁকালো।  কেউ একজন এসে দরজায় নক করে জানালো সাজ্জাদের মাকে এখন দাফনের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হবে। ওকে ডাকা হচ্ছে খাটিয়া তোলার জন্য। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সাজ্জাদ।  *** সাজ্জাদের বাবা, আইজুদ্দিন নিম্নবিত্ত সংসার থেকে উঠে এসেছিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নামসর্বস্ব একটি বিষয়ে অনার্স পাশ করেন। মাস্টার্স করার সুযোগ পাননি। তার পরিবর্তে নিজের ভাইবোনদের ভবিষ্যত গড়ার ও বাপ মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে নেমে পড়েছিলেন জীবন যুদ্ধে।  বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ওনার যে ধরণের পারিবারিক ও একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো তা দিয়ে তৃতীয় বা দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরি ছাড়া বিকল্প কোন ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারতো কি না সন্দেহ। কিন্তু আইজুদ্দিন ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের মানুষ। তার ভিতরে এমন অসাধারণ ২টি গুণ ছিলো যেগুলো আশেপাশের সবার চেয়ে তাকে এগিয়ে রেখেছিলো। একটি হলো উচ্চ স্বপ্ন দেখা, অন্যটি হলো হাল না ছাড়া। সাজ্জাদের বাবা জানতেন যে একদিন তিনি অনেক বড় হবেন। তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সব করতে রাজি ছিলেন তিনি। কথায় আছে, পরিশ্রমের ফল কখনো বৃথা যায় না। সাজ্জাদের বাবাও তার ফল পেয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে যখন রেডিমেড গার্মেন্টসের উত্থান ঘটছিলো, ঠিক সেই সময়ে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে একান্ত নিষ্ঠা ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিজের লভ্যাংশ থেকে দেশের বিখ্যাত সব কোম্পানিতে অর্থ লগ্নী করে ধীরে ধীরে ব্যবসার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করতে থাকেন। নিজের পরিবারকে গ্রামের অজপাড়া গা থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন গুলশানের অভিজাত সমাজে।  জীবনের আরেকটি ক্ষেত্রে মোড় পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আইজুদ্দিন। ব্যবসাকে দাঁড় করাতে গিয়ে জীবনের অনেকটা সময় পার করে ফেলেছিলেন বলে অন্যকিছু ভাবার সুযোগ পাননি। বয়স যখন চল্লিশের কোঠায় তখন তার হুঁশ হলো — আরে বিয়েটাই করা হয়নি! তবে ব্যবসার যে কোন মোক্ষম চুক্তির মতো এই ক্ষেত্রেও আইজুদ্দিন তাড়াহুড়ো করলেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন কেবল কেবল সমাজ রক্ষার্থে তিনি বিয়ে করবেন না। বরং এই বিয়েটাকেও নিজের স্বপ্ন পূরণের কাজে ব্যবহার করবেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই সমাজে এলিটদের সমমর্যাদা পেতে এটা দারুণ সুযোগ হতে পারে। নানান খোঁজ খবর করে শেষমেষ শায়লা চৌধুরীকে বিয়ে করেন আইজুদ্দিন৷ এবং এই  বিয়ের মাধ্যমে তার পরিকল্পনা সফল হয়েছিলো। শায়লার পিতা, অর্থাৎ সাজ্জাদের নানা ছিলেন গুলশানের আদি ধনী বাসিন্দাদের একজন, গুলশান হান্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। তাদের পরিবারটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবারগুলোর অন্যতম। এমন পরিবারের মেয়েজামাই হওয়ার মাধ্যমে সাজ্জাদের বাবার সামনে বহু সম্ভাবনার পথ অবারিত হয়ে যায়। তার সামাজিক অবস্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটে।  অন্যদিকে সাজ্জাদের মা, শায়লা চৌধুরী, আইজুদ্দিনের সঙ্গে বিয়ের সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। একদিকে যেমন স্মার্ট ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী৷ ঐ সময়ে ঢাকার রাস্তায় নিজের প্রাইভেট গাড়ি ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়াতেন। পরতেন বলিউডের নায়িকাদের মতো স্কার্ট আর টপস। শাড়ি পরলেও বাঙ্গালির নারীদের চিরায়ত জড়তা বা রক্ষণশীলতা তার ভিতরে ছিলো না। শায়লার একটু হাসি দেখার জন্য অগুনতি যুবক   চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতো। ওকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নে কতশত পুরুষ নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তার হিসেব কে রেখেছে! এমনকি ঢাকাই সিনেমায় অভিনয়ের অফারও না কি পেয়েছিলেন। কিন্তু শায়লা রাজি হননি। তার স্বপ্ন ছিলো ডাক্তারি পাশ করে তার মতোই কোন স্মার্ট সুপুরুষকে বিয়ে করে এদেশ ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু শায়লার সমস্ত স্বপ্নকে চুরমার করে দিয়ে আগমন ঘটে আইজুদ্দিনের।  শায়লার মতো মেয়েকে কীভাবে আইজুদ্দিনের মতো ছেলে বিয়ে করলো, তাও আবার পারিবারিকভাবে, সেটা তখনকার সময়ে একটা মশলাদার গসিপের অংশ ছিলো। বোঝার মতো বয়স হওয়ার পরে সেসব মুখরোচক গসিপ সাজ্জাদের কানেও এসেছিলো। এত বছর পরে মায়ের ফটো এলবামের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সাজ্জাদের মনে সেসব টুকরো টুকরো ভেসে আসছে। যদিও ওর মনোযোগ ছবিগুলোর দিকেই বেশি। অসংখ্য ছবি আছে এই এলবামে। বিয়ের সময়কার ছবি। বিয়ের আগের ছবি। বিয়ের পরে আইজুদ্দিন তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে দেশ বিদেশে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেখানকার একক ও যুগলবন্দী ছবিও আছে এলবামে। হঠাৎ একটি ছবিতে ওর চোখ আটকে যায়। মাথার পেছনে ঝন ঝন করে ওঠে। (চলবে)
Parent