জীবন যে রকম ( সম্পূর্ণ ধারাবাহিক উপন্যাস) By Lekhak - অধ্যায় ৫৪
শুভেন্দু বলল, ‘এবারেই তো ক্লাইম্যক্সে আসছি গুরু। একটু ধৈর্য ধরো।’
বলতে বলতেই মা আবার ঢুকেছে ঘরে। যেন পুরোনো ঘটনাটা মা’ও জানে। আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে মা’ বলল, ‘দেব ছোটতালা হলে যে কোন তালা খুলে দেবে। এটা ও কিভাবে শিখেছে জানি না। তবে ঘরেও একবার একটা ছোট তালার চাবি হারিয়ে গিয়েছিল, দেব ওটা খুলে দিয়েছিল, চাবি ছাড়াই।’
শুক্লা বেশ অবাক হয়ে মা’কে বলল, ‘তাই নাকি? তারপর?’
মা হেসে চলে গেল। বলল, ‘বাকীটা শুভেন্দু বলবে।’
ঘরের মধ্যে বেশ একটা কৌতূহলময় পরিবেশ। শুভেন্দু এমন ভাবে উপস্থাপন করেছে,এখন বিদিশারও কৌতূহল বেড়ে গেছে। কারণ আমি তো জানি, শেষমেষটা বিদিশাও জানে না।
শুভেন্দু বলে চলল, ‘দেব’ কলেজের ছাদে উঠেছে, তালা খুলে। এদিকে আমি জানি ও হয়তো বিদিশার জন্য মন খারাপ করে বাড়ী চলে গেছে। কিন্তু বাবু যে ছাদে উঠে বসে আছেন, সেটা আর কে জানবে? আমি ভাবলাম, যাই, একবার দেবের বাড়ী চলে যাই, ও যখন কলেজ ছেড়ে চলেই গেল। তখন বলে গেল না কেন? অন্তত বুঝতে পারতাম সমস্যাটা কি। ছুটতে ছুটতে এ বাড়ী চলে এলাম। দোতলায় উঠে কলিংবেল টিপলাম। মাসীমা দরজা খুললেন। আমাকে বললেন, ও শুভেন্দু? কি ব্যাপার?’ আমি বললাম, মাসীমা দেব কি বাড়ী চলে এসেছে?’ মাসীমা বললেন, ‘কই না তো? আমি বললাম, কলেজেও দেখছি নেই। সকাল বেলা গিয়ে দেখলাম মুখ ভার করে বসেছিল, তারপরেই গায়েব। তাহলে কি ও বিদিশার বাড়ী চলে গেল নাকি?’ মাসীমা বললেন, তুমি ঠিক দেখেছো? ও কলেজে নেই?
শুভেন্দু বলল, ঠিক তখন আমিও বুঝতে পারছি না। দেব কি তাহলে সত্যিই বিদিশাদের বাড়ী চলে গেল? মুখটা ভার করে আমিও ফিরে চলে গেলাম। মাসীমাকে যাবার আগে বলে গেলাম। আচ্ছা ‘দেব’ বাড়ীতে ফিরলে, বলবেন, আমি এসেছিলাম।’
শুক্লা বলল, ‘তুই কি তারপর আবার কলেজে ফিরে গেলি? আর ছাদে গিয়ে দেখলি ‘দেব’ ওখানে বসে আছে। আর সাথে বুঝি বিদিশা?’
শুভেন্দু বলল, ‘এই তো সব চটকে দিলি। পুরোটা শুনবি, তবে তো মজা পাবি।’
শুক্লা, শুভেন্দুর ধ্যাতানি খেয়ে চুপ করে গেল। শুভেন্দু আবার বলতে শুরু করল, ‘আমার কি মনে হল, আমি কলেজেই আবার ফিরে গেলাম। ভাবলাম, ‘দেব’ মনে হয় এদিক ওদিক গেছে, কলেজে যথাসময় ফিরে আসবে। তাছাড়া ওকেও আমি বলেছিলাম, তোর সাথে কিছু দরকারী কথা আছে। আমার সঙ্গে দরকারী কথাটা না সেরে ‘দেব’ ও কলেজ ছেড়ে কোথাও যাবে না। তবে ‘দেব’ আমাকে বলেছিল, বিদিশার জন্য ওর নাকি মুখ গম্ভীর নয়। তাহলে বিদিশার বাড়ীই বা ও গেল কেন? আর যদি ওখানেও না গিয়ে থাকে, তাহলে কোথায়?’
শুক্লা হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন ছাদে? তুই তো একটু আগে বললি।’
শুভেন্দু বলল, হ্যাঁ। তবে ছাদে ও একা নয়। সাথে বিদিশাও।’
শুক্লা বলল, ‘বিদিশা কলেজে চলে এসেছিল? কখন এলো? তুই এ বাড়ীতে দেবের খোঁজে আসার পরে?’
শুভেন্দু বলল, ‘বিদিশা কলেজেই ছিল। ‘দেব’ ওটা আমার কাছে চেপে যায়। আগের দিনই এরা দুজনে মিলে আগের দিন প্ল্যান প্রোগ্রাম করে। বিদিশা দেবকে অনুরোধ করে, এই আমাকে একবার ছাদে নিয়ে যাবে? নিরিবিলিতে আমরা প্রেম করব। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে।
দেব ওকে বলে, এমন সময় আমরা দুজনে মিলে ছাদে উঠব। যাতে কেউ টের না পায়। দুপুরবেলার দিকেই ওটা করতে হবে। দুটো ক্লাস অ্যাটেন করার পরই দেব ছাদে চলে যায়। তালা খোলে ঢোকে। তারপর বিদিশাও ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসে। পা টিপে টিপে ছাদে চলে যায়। দিব্যি দুজনে বসে প্রেম করতে থাকে। তাছাড়া নিরিবিলিতে ছাদে বসে, আরো কত কি করেছে। তুই কি দেখেছিস? না আমি দেখেছি?’
শুক্লা হাসতে শুরু করেছে। একবার আমার আর বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওফ কি প্রেম।’
বিদিশা লজ্জ্বা কাটিয়ে উঠে শুভেন্দুকে এক ধমক দিয়ে বলল, ‘এই বাজে কথা বলবি না। আর কি করেছি আমরা? শুধু তো প্রেম।’
শুভেন্দু বলল, ‘শুধু প্রেম? দাঁড়া দাঁড়া আসল কথাটা বলতে দে। তারপর সব পরিষ্কার হবে।’
শুক্লা বলল, ‘তুই টের পেলি কি করে শুভেন্দু? যে ওরা দুজনে ছাদে রয়েছে।’
শুভেন্দু বলল, ‘সারা কলেজেই টের পেল না। আর আমি কি করে টের পাবো?’
শুক্লা বলল, তারপর?
শুভেন্দু বলল, ‘এরা দুজনে ওখানে কি করেছে জানি না। পরে ‘দেব’ আমাকে বলেছিল, ও আর বিদিশা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিল।
শুক্লা বলল, ঘুমিয়ে পড়েছিল? সে কি? তারপর?
শুভেন্দু বলল, ‘তারপর আর কি? কলেজ তো একটু পরেই ছুটি। যে যার বাড়ী ফিরে যাচ্ছে। অথচ ‘দেব’ কে আর পেলামই না। আমিও বাড়ী ফিরে গেছি। ঠিক তখন বাজে রাত্রি আটটা। কি মনে হল, দেবের বাড়ীতে একটা ফোন লাগালাম। মাসীমা ফোনটা ধরলেন, জিজ্ঞাসা করলাম, মাসীমা ‘দেব’ কোথায়?
মাসীমা বেশ চিন্তাগ্রস্থ। আমাকেও চিন্তায় ফেলে দিয়ে বললেন, দেব এখনও ফেরেনি শুভেন্দু। কি জানি কোথায় গেল? আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে।
এদিকে আমি পড়েছি মহা ফাঁপড়ে। মালটা গেল কোথায়? বিদিশাকে নিয়ে কি হাওয়া হয়ে গেল নাকি?
শুক্লা হাসতে হাসতে বলল, তারপর?
শুভেন্দু বলল, তারপরেরটা শুনবি? তোর পেটে কিন্তু খিল ধরে যাবে।
শুক্লা হাসতে হাসতেই বলল, ‘পেটে তো আমার আগেই খিল ধরে গেছে। শেষটুকু বল। তবে তো মজাটা আরো পাবো।’
শুভেন্দু এবার বেশ গম্ভীর। শুক্লাকে বলল, ‘আমি তখনও বুঝতে পারছি না কি করব? কারণ মাসীমা আমাকে অনেক করে বলেছেন, দেবের একটু খোঁজ নিতে। এদিকে আমার কাছে বিদিশার বাড়ীর ফোন নম্বরও নেই। যে ওকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করব, দেব ওদের বাড়ী গেছে কিনা? চিন্তায় আমিও পাগল হচ্ছি। ঠিক সেই সময় রনিকে একটা ফোন করলাম। ব্যাপারটা খুলে বললাম। রনি বলল, প্রেম যারা করে, তাদের অত সময় জ্ঞান থাকে না। দেখ, ও হয়তো বিদিশাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে গেছে। তুই এত উতলা কেন হচ্ছিস? আমি তাও ছটফট করছি। কিছু একটা করতে হবে। দেবকে খুঁজে বার করতে হবে। কোথায় ও গেল?
আমি শুয়ে শুয়ে বললাম, সত্যি সেদিন যদি শুভেন্দু উদ্যোগটা না নিত। আমাকে আর বিদিশাকে সারা রাত কলেজের ছাদেই কাটাতে হত। প্রিন্সিপাল পরের দিন আমাকে রাস্টিকেট করতেন। বিদিশাকেও তাই।’
শুক্লা বলল, কি হল তারপর?
শুভেন্দু বলল, বাড়ীতে মেজদাকে বলে গাড়ীটা চেয়ে নিলাম। অত রাত্রে বিদিশাদের বাড়ী যাব। রনিকেও ডেকে নিলাম। গাড়ী চালিয়ে সোজা বিদিশার বাড়ীতে। ভাবছি ওখানেও যদি গিয়ে দেবকে না দেখি, তাহলে ধরে নেবো, ওরা নির্ঘাত সিনেমা টিনেমা কোথাও গেছে। বিদিশাদের বাড়ীতে গিয়ে এমন ভাব করতে হবে। যাতে ওর বাবা মা’ও কিছু বুঝতে না পারে। কিন্তু গাড়ীতে যেতে যেতে এটাও ভাবছি, দেবের মুখ থেকেই শুনেছি, ও কোথাও গেলে মাসীমাকে নাকি বলে যায়। সেক্ষেত্রে এখন রাত দশটা বাজে। মাসীমা চিন্তা করছেন অথচ দেব ওনাকে বলে আসেনি।
শুক্লা বলল, ‘শেষটুকু এবার বল। আর তর সইছে না।’
শুভেন্দু বলল, আমি আর রনি, বিদিশাদের বাড়ী যেতেই বিদিশার মা বললেন, বিদিশা তো কলেজে গেছে সেই সাতসকালে। এখনও ফেরেনি। কোথায় সে? আর তোমরাই বা এত রাত্রে কেন এসেছ?’
শুভেন্দু বলছে, চিন্তা কর, আমার কি অবস্থা। ঢোঁক গিলতে পারছি না, কথা বলতে পারছি না। হতভম্বের মত ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আর ভাবছি, এটা কি করে হল? বিদিশার মা বলছেন, বিদিশা কলেজে গেছে। আর আমি বিদিশাকে দেখিনি। আর দেবও ভ্যানিশ। তাহলে দুজনে মিলে গেল কোথায়? ভীষন রাগ হল আমার দেবের ওপরে। ভাবলাম, থাক তোরা তোদের প্রেম নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাতে আসবো না। গাড়ী নিয়ে যখন ফিরছি রনি বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে দেব কোনো বিপদে পড়েছে। আমি অবাক ওর কথা শুনে। রনিকে বললাম, কিসের বিপদ? রনি বলল, নিশ্চই ও বিদিশাকে নিয়ে কোথাও গেছে। সেখান থেকে ফিরতেই ওর দেরী হচ্ছে। চল আমরা কিছু একটা করি।’
কিন্তু কি যে করব? কোথায় দেব আর বিদিশাকে খুঁজবো? মাথামুন্ডু তখন কিছুই বুঝতে পারছি না। রনি ঠিক সেইসময় আমাকে বলল, এক কাজ করি, চল আমরা কলেজে যাই। দেবের খোঁজ করি গিয়ে।
রনিকে বললাম, এত রাতে কলেজে যাব? কি হবে ওখানে গিয়ে? বোকার মতন কথা বলছিস।’
রনি বলল, ‘যা বলছি, ঠিকই বলছি। তুই একটা জিনিষ চিন্তা কর। দেব আর বিদিশা দুজনেই বাড়ীতে কিছু বলে যাইনি। ফিরতে ওদের দুজনের দেরী হবে। বলে গেলে তবু একটা কথা ছিল। এখনও ওরা দুজনের কেউই ফেরেনি। তারমানে কোথাও আটকা পড়ে গেছে। আমাদের কলেজে গিয়েই রহস্যটা উদ্ধার করতে হবে। নিশ্চই ওরা কোথাও ফেসেছে দুজনে।’
তবু আমি ভাবছি, কলেজে গিয়ে কি হবে? কে ওদের সন্ধান দেবে? কেউ কি বিদিশা আর দেবকে দুজনকে একসাথে দেখেছে? আমার তো মনে হয় না। তবুও রনির কথা মেনে গাড়ী নিয়ে গেলাম। ঠিক তখন বাজে রাত সাড়ে দশটা। কলেজের গেটের সামনে গিয়ে দেখি। গেট বন্ধ। বড় একটা তালা ঝুলছে। আমি আর রনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ঠিক সেইসময় ছাদের দিকে আমার চোখ পড়ল। দেখলাম অন্ধকারে একটা মুখ। সাথে আর একটা মুখ। আমাদের দুজনকে দেখে উঁকি ঝুঁকি মারছে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। এদিকে চ্যাঁচাতেও পারছি না। আশে পাশের লোক জড় হলে মুশকিল। এবার ওপর থেকে ‘দেব’ চাঁপা গলায় বলছে, ‘এই শুভেন্দু আমি এখানে। তাকা তাকা ওপরে তাকা।’