জীবনচক্র (নতুন আপডেট নং ৯) - অধ্যায় ২০
ঢাকার একটি অভিজাত রেস্টুরেন্টে একা বসে আছেন সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. ইমতিয়াজ খান। তিনি কখনো পেশাদারিত্বের বাহিরে গিয়ে কোনো রোগির অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন না। শুধু নুসরাতের কথায় রাজি হয়ে তার আন্টির সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছেন। উনি যে সময়ের কথা বলে দিয়েছেন তা আরো দশ মিনিট আগে পেরিয়ে গেলেও ভদ্রমহিলার দেখা মিলছে না।
আজ সারাদিন অবসর ইমতিয়াজ খানের। অনেক বছর আগে এই দিনে অনন্যার আম্মুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। বাসর রাতে কেক কেটে উদযাপন করেছিলেন অনন্যার দ্বিতীয় জন্মদিন। ওটাই শেষ, তারপর থেকে মেয়েকে নিয়ে এই দিনে একাই কেক কাটতে হয় ইমতিয়াজ খানের। সারাদিন অনন্যার সাথেই থাকতেন আজ, কিন্তু অনন্যা ওর বান্ধবী সাদিয়ার সাথে দেখা করতে গিয়েছে।
অনন্যা-সাদিয়ার কথা মনে পরতেই রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভর করে ইমতিয়াজ খানের। সাদিয়া তাকে পছন্দ করে। এই বয়সী মেয়েদের মাথায় অনেক কিছুই ভর করতে পারে। এরা ভবিষ্যৎ বা পারিপার্শ্বিক বিষয় গুলো নিজেদের ভাবনায় স্থান দিতে পারে না। সাদিয়া যেটা চায় সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না। সোসাইটির লোক না’'না কথা বলবে, সেটা অবশ্য বড় কোনো বাধা নয় ইমতিয়াজ খানের। কিন্তু মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করলে অনন্যাকে কটু কথা শুনতে হবে অনেক জায়গায়। ইমতিয়াজ খানের সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা টা হলো তিনি সাদিয়ার প্রতি যে টান অনুভব করেন সেটা কি ভালোবাসা নাকি অল্প বয়সী মেয়েকে নিজের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পাওয়ার লোভ? অনেকের অনেক প্রশ্নের জবাব থাকলেও নিজের এই প্রশ্নের উত্তর টাই তিনি বের করতে পারছেন না।
অনন্যা যে সাদিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কিছুটা আঁচ করতে পারে সেটাও বুঝে ইমতিয়াজ খান। কিন্তু সম্পর্ক টা পূর্নতা পেলে অনন্যা - সাদিয়ার মধ্যে টানা-পোড়ন তৈরি হলে সেই পরিস্থিতি সামাল দেয়া এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পরবে ইমতিয়াজ খানের জন্য।
হ্যালো, বসতে পারি…
ইমতিয়াজ খান তাকিয়ে দেখলেন আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা এক নারী টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দেরি হওয়ার জন্য কয়েকটা কটু কথা শোনানোর জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন ইমতিয়াজ খান। কিন্তু মহিলা কে দেখে সে ইচ্ছা থেকে সরে আসলেন তিনি। এমন রক্ষণশীল মহিলার সাথে আক্রমানত্বক হয়ে কথা বলা যায় না, আর মহিলার মুখ ঢাকা, শক্ত কথা শুনিয়ে শ্রোতার অপরাধী কাঁচুমাচু মুখ দেখতে না পারলে শুধু শুধু বকাবকি করে নিজের মুখ নষ্ট করার মানে হয় না।
জ্বি বসুন……
দেরি হওয়ার জন্য সরি…
আপনার নাম? কোনরকম সৌজন্যতার দিকে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ইমতিয়াজ খান।
জ্বি, বুশরা আমান…
নুসরাত বলেছিলো একটা পরামর্শ চান আমার কাছে, তাহলে বলুন কি বিষয়ে কি পরামর্শ চাচ্ছেন আপনি।
আসার পরই সরাসরি কাজের কথায় চলে যাওয়ায় কিছুটা অবাক হলেন বুশরা। ভালোই হয়েছে বেশি কথা বলা লাগবে না…
জ্বি, সমস্যা টা আমার হাসবেন্ড কে নিয়ে। আমাদের সন্তান দুইজন। এক ছেলে আর এক মেয়ে। একজনের বয়স ছয় আরেকজনের চার। মোটকথা বলতে পারেন আমাদের ফ্যামিলি সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত এক বছর আগে আমার হাসবেন্ড তার অফিসের কাজে ইউরোপে চলে যায়, তারপর থেকে তার মধ্যে অদ্ভুত সব পরিবর্তন আসতে থাকে।
এতটুকু বলে থামলেন বুশরা আমান। ইমতিয়াজ খান খেয়াল করলেন নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন বুশরা আমান, একবারো তার দিকে চোখ তুলে তাকান নি তিনি।
কেমন পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?
আসলে কিভাবে যে বলি…
দেখুন, পরামর্শ নিতে এসেছেন, সব কিছু না বললে তো আমার মতামত দেয়ার সুযোগ নেই।
আসলে, ও এখন আমাদের ইন্টারকোর্স এর সময় বিভিন্ন ফ্যান্টাসি ট্রাই করতে চায়, শুরুর দিকে মানা যেতো, কিন্তু এখন সেটা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে।
দেখুন, মানুষ এখন সেক্স নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট চালাতে চায়, এতে দোষের কিছু নেই। দু'জন দু'জনের মতামত নিয়ে একে অপরের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যতটুকু পারা যায় আপনি মানিয়ে নিন। বললেন ইমতিয়াজ খান।
আসলে দেখুন, যতদিন পর্যন্ত ওর ফ্যান্টাসি গুলো হালাল পর্যায়ে ছিল আমি সব মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন ও কাপল শেয়ারিং এর মত ঘৃন্য প্রস্তাব আমাকে দিচ্ছে। আর যেটা বললেন, আমার কোনো মতামত এর প্রতি আমার হাসবেন্ড এর এখন বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। ও যা বলবে তাই করতে হবে।
তো, আপনি এখন কি করতে চাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলেন ইমতিয়াজ খান।
আমার দুটো বাচ্চাই বাবার জন্য পাগল। আর আমাদের ফ্যামিলির সবাই জানে আমাদের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই। তবুও আমি ডিভোর্স নিতে চাচ্ছি। সবাই আমাকেই দোষী ভাববে জানি, কিন্তু আমি এসব করতে পারবো না।
আপনি শুধু আমায় এই নিশ্চয়তা দিন যে আমার সিদ্ধান্ত টা সঠিক।
আপনি তো নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, তাহলে শুধু শুধু আমার কাছে এসেছেন কেন? জিজ্ঞেস করলেন ইমতিয়াজ খান।
সব শুনে আপনার কি মনে হয়েছে আমার হাতে আর কোনো অপশন আছে? পালটা প্রশ্ন করলেন বুশরা আমান।
ইমতিয়াজ খান বুঝলেন এই মহিলা প্রচন্ড আত্ববিশ্বাসী এবং সাহসী। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন এমন রোগি না ইনি।
হয়তো শুধু নিজের সিদ্ধান্ত টা সঠিক এই মর্মে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর মতামত নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত টা নিজের জন্য সহজ করে নিতে চাইছেন।
আপনার সিদ্ধান্ত কে আমি সম্মান জানাই মিসেস বুশরা। দেখুন আজকাল অনেক দম্পতি নিজেদের মধ্যে বিস্তর সমস্যা থাকার পরেও শুধু সন্তানদের কথা চিন্তা করে আলাদা হয় না। এতে তেমন লাভ হয় না। বাবা - মা আলাদা থাকলে সন্তানদের উপর একটা মানসিক চাপ পরে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু বাবা-মার দাম্পত্য কলহ দেখা সন্তানদের জন্য আরো কষ্টদায়ক। নিজের মতামত জানিয়ে দিলেন ইমতিয়াজ খান।
ধন্যবাদ আপনাকে। আসলে আমি খুব মানসিক প্রেশার নিয়ে দিন যাপন করতেছি। আপনার মুল্যবান সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিছু খাবার অর্ডার করি? জিজ্ঞেস করলেন বুশরা আমান।
হুম, শিউর…
খাওয়ার জন্য মুখের নিকাবটা খুললেন বুশরা আমান। ঢেকে রাখা অথবা লুকায়িত যে কোন জিনিস যখন প্রকাশ্যে আনা হয় তখন দর্শকদের একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে সেই বস্তুর প্রতি। তাই যখন বুশরা আমান নিকাব খুলছিলেন তখন তার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন ইমতিয়াজ খান। বুশরা আমানের চেহারা দেখে একটা ঝটকা খেলেন ইমতিয়াজ খান। জীবনে অনেক নারী দেখেছেন, বিভিন্ন বয়সী, বিভিন্ন জাতের, সব মহাদেশ ঘুরে ফেলা ইমতিয়াজ খানও এমন নিখুঁত সুন্দরী কখনো দেখেন নি। শুধু সুন্দরী না, এমন আবেদনময়ী মুখ ও তিনি আগে দেখেন নি। চোখ গুলো টানা টানা, সবথেকে আকর্ষণীয় হচ্ছে বুশরা আমানের পুরুষ্ট ঠোঁট, এমন ফোলা ফোলা আবেদনময়ী ঠোঁট অন্য নারী রা সার্জারী করেও করতে পারবে না।
অনন্যার মা মারা যাওয়ার পর কোনো নারীই এভাবে নজর কাড়তে পারে নি ইমতিয়াজ খানের, কিন্তু বুশরা আমানের সৌন্দর্য থেকে চোখ সরাতে পারছেন না তিনি। বুশরা আমানও বুঝতে পারছেন তার সামনে থাকা মাঝবয়েসী হ্যান্ডসাম লোকটা তাকে একদৃষ্টিতে দেখেই চলেছেন।
জ্বি শুরু করুন প্লিজ..
বুশরা আমানের কথায় ধ্যান ভাঙে ইমতিয়াজ খানের। খাওয়ার সময়ও আড়চোখে অনেকবার সামনে বসে থাকা বুশরা আমানের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন ইমতিয়াজ খান। খাওয়া শেষ করে বুশরা আমান বললেন আমি আসি, আপনার মুল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই আবারো…
ইমতিয়াজ খান এর ইচ্ছে হয়েছিলো বুশরার কন্টাক্ট নাম্বার টা চেয়ে নিতে, কিন্তু এটা অভদ্রতা হয়ে যায় বলে আর চাইলেন না তিনি। বুশরা আমান চেয়ার থেকে উঠে রেস্টুরেন্টের গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত বোরখার উপর দিয়ে বুশরার ভারি পাছার দুলুনি দেখলেন ইমতিয়াজ খান নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে।
পাপা, সব রেডি, এখন বারোটা বাজলেই কেক কাটবো। ইমতিয়াজ খানকে উদ্দেশ্য করে বললো অনন্যা।
বারোটা বাজলে তোর বয়ফ্রেন্ড তোকে উইশ করবে না…
এহ, ও জানে নাকি আজকে আমার বার্থডে… কপাল কুঁচকে পাপাকে বলল অনন্যা।
বলিস নি কেন?
আরে পাপা, দুই দিন ও হয় নি আমাদের রিলেশনশিপের, এখনই এত কিছু জানা লাগবে না ওর….
ওর CGPA কত?
কার?
কার আবার, তোর বয়ফ্রেন্ড এর, তোর CG এর যে অবস্থা, তোর বয়ফ্রেন্ড এরও যদি এমন হয় তাহলে আর ভাত খেয়ে বাঁচা লাগবে না…..
উফ পাপা, ও আমাদের ক্লাস টপার… গর্ব করে বললো অনন্যা।
তাহলে তো ভালোই পছন্দ করেছিস…..
তাহলে তোমার সাথে একদিন দেখা করিয়ে দেই…
না, লাগবে না এখনই, পরে আবার ভাববে তাকে আমি মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছি…
মেনে নাও নি?
অফকোর্স নট…..
আচ্ছা, তোমার মানা লাগবে না, আর দুই মিনিট আছে, চলো কেক কাটি…
প্রতি বছর আগে অনন্যার জন্মদিনের কেক কাটা হয়, তারপর তাদের ম্যারেজ এনিভার্সারির কেক। এই সময় টা অনন্যা খুব আবেগপ্রবন হয়ে পরে। কিন্তু ইমতিয়াজ খান খেয়াল করলেন অন্য বছরের থেকে এবার অনন্যার মন বেশিই খারাপ।
অনন্যা, চল ব্যালকনির দোলনায় গিয়ে বসি…
দোলনায় বসে পাপার কাধে মাথা রেখে অনন্যা বললো –--- পাপা, আব্বু, আম্মু দু'জনই আমাকে রেখে চলে গেলো কেন?
কেউ ইচ্ছে করে যায় না মা, তোর আম্মুর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তার মুখে তোর নাম ছিল….
আম্মুর অনেক কষ্ট হচ্ছিলো তাই না পাপা…..
হুম্ম কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু ওর চোখে কষ্টের থেকে তোকে হারিয়ে ফেলার ভয় বেশি ছিলো…
জানো পাপা, নিজেকে মাঝে মাঝে খুব অপরাধী মনে হয় আমার, আব্বু আম্মু চলে গেলো, আর আমার জন্য তুমিও তোমার জীবনের সব সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে দিলে, নিজেকে অনেক বড় বোঝা মনে হয় আমার….
মা, আমি কিছুই বিসর্জন দেই নি, আমার সুখ-দুঃখ সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দু তুই… এমন কথা বললে মাইর দিবো কিন্তু…..
অনন্যা জানে তার পাপা তাকে মারবে না, এমন কি ধমক ও দিবে না। চোখের অশ্রু মুছতে মুছতে অনন্যা বললো, আচ্ছা পাপা, সাদিয়া কে তোমার কেমন লাগে?
নিজের মেয়ের কাছে এমন প্রশ্ন শুনে বিষম খেলেন ইমতিয়াজ খান।
কেমন লাগে মানে????
মানে, সাদিয়া তোমাকে পছন্দ করে, সেটা আমি জানি, তুমি বলো তুমি ওকে পছন্দ করো নাকি?
তোরা পাগল হয়েছিস দুই বান্ধবী! তোদের বয়স অনেক কম, এখন তোরা কিছু বুঝবি না।
সাদিয়া সব বুঝে পাপা, ও তো টিনেজার না, ২২ পার হচ্ছে, সবকিছু বুঝে শুনেই ও তোমাকে পছন্দ করে….
বাদ দে এখন, চল খেতে যাই, অনেক রাত হয়েছে…
হুম চলো, সাদিয়া তোমার জন্য চিংড়ি মাছ ভুনা করে পাঠিয়েছে….
পাগলী….
অনন্যা বুঝলো তার পাপার মনের কোনে সাদিয়ার জন্য একটু হলেও ভালো লাগা আছে, পাগলী একটা ভালোবাসার ডাক।