শেষ ট্রেনের যাত্রী/ সমাপ্ত - অধ্যায় ৩
পর্ব ৩
রাত গভীর। নীরব রেলপথ ধরে যান্ত্রিক শব্দ তুলে ট্রেনটা ছুটে চলছে উত্তরের দিকে। আরিশ জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়ার কপালে হাত রাখে। জ্বর তার শরীরজুড়ে। যদিও মায়া কিছুক্ষণ আগে বলেছিল, “আমি ঠিক আছি”—কিন্তু আরিশ বোঝে তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। শরীরটা যেন নরম হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। নিজেকে খানিকটা দোষী ভাবতে শুরু করেছে আরিশ,মেয়েটা এমন ভাবে রেস্পন্স করবে সে ভাবতে পারেনি– এতটা ভয় পাবে তাই বা কে জানতো।
ভাবনার মাঝে ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। সময় ৫:২৯। কোনও প্ল্যান অনুযায়ী স্টপ ছিল না। স্টেশনের নাম নেই, ইশতেহার নেই—শুধু অন্ধকারের মধ্যে একটি ছোট্ট চত্বর আর দূরে সিগনাল পোস্টে ঝাপসা আলো। কিছু যাত্রী ঘুমিয়ে, কেউ কেউ বিরক্ত। আরিশ প্রথমে ভেবেছিল হয়ত সিগনালের অপেক্ষা। কিন্তু মিনিট পেরোতে লাগল। ১০... ২০... ৩০... ৪৫ মিনিট... তারপর এক ঘণ্টা। কেউ কিছু বলছে না। কোথাও ঘোষণা নেই।
মায়ার জ্বর বাড়ছিল, চোখ বন্ধ করে আরিশের বুকে নিজেকে সমর্পণ করেছে মেয়েটা। আরিশ বোতল থেকে পানি খাওয়াচ্ছে, সঙ্গে রাখা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়েছে, কিন্তু অবস্থার খুব একটা উন্নতি নেই। আরিশ তখন লক্ষ্য করে এক রেলওয়ে কর্মচারী, সম্ভবত টিকিট চেকার। তাকে দেখে আরিশ মায়াকে সাবধানে শুয়েই দিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি আরিশকে দরজার কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
— “দুর্ঘটনা হতে পারত মশাই, তাই আগেভাগে এই ছোট্ট স্টেশনে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যাত্রীদের বলা হয়নি যাতে আতঙ্ক না ছড়ায়…রাতের ট্রেন বুঝতেই তো পারছেন। জলদি মিমাংসা হয়ে গেল আর বলার প্রয়োজনই বা কি?”
– “বুঝলাম, তবে একজন যাত্রী খুবই অসুস্থ, ট্রেনে কোন ডাক্তার আছে?”
–“ উম..... একজন আছে অবশ্য... দাঁড়ান! দেখছি আমি কি করা যায়.....”
আরিশ আবার ফিরে এসে অপর পাশের সিটে বসে পড়লো। সামনের সিটে মেয়েটি। বোধহয় গভীর ঘুমে। আরিশ জানে উচিত নয়– তবুও অবাধ্য চোখদুটো পড়লো মায়ার পাতলা ঠোঁট জোড়ার ওপড়ে.... মৃদুমন্দ কাঁপছে যেন..... আরিশ ও দুটি ছুঁয়ে দেখার এক তীব্র ইচ্ছে অনুভব করে মনে... দৃষ্টি নেমে যায় ওই ফর্যা ত্বক বেয়ে বুকের দিকে। নীল চাদরটা সরে গিয়ে যেন লাল গোলাপের শোভা ফুটে উঠেছে। নিঃশ্বাসের সাথে সাথে কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। আরিশ হাত বাড়ায়। চাদরের নিচে আবারও চাপা পরে নারী দেহের ঐশ্বর্য। কিন্তু অনুভূতি? আরিশ চোখ বুঝতেই অনুভূতি গুলো যেন নড়েচড়ে ওঠে। মনে পরে হাতের তালুতে কোমল এক স্পর্শ...... নাকে খুব কাছে একটা সুঘ্রাণ.... না, পারফিউম নয়– নারী দেহের কি নিজস্ব কোন ঘ্রাণ আছে? যা এতটা আকর্ষণীয়! ভাবনাটা বড়ই জটিল মনে হয় আরিশের কাছে। মায়া তখন আধবোঝা চোখে তাকিয়ে আরিশের চোখের দিকে। আরিশ সিগারেট ধরিয়েছে। মায়া নিজের চেষ্টায় উঠে বসতে গেলে আরিশ ব্যস্ত হয়ে সিগারেট রেখে চেপে ধরলো তার বাহু যুগল।
–“ উঁহু্..... কি করছেন? শুয়ে থাকুন বলছি” – তার কন্ঠে দৃঢ়তা।
মায়া আরিশের ব্যস্ততা দেখে মিষ্টি হেসে আরিশের কাঁধে আঁকড়ে উঠে বসলো। হাতে তুলে নিল আরিশের টানা সিগারেটা। আরিশ হাত বাড়িয়ে আলতো করে ধরে মায়ার হাত। ডানহাতের দুই আঙ্গুলে সিগারেটা ছিনিয়ে নিতেই মায়া কাতর কন্ঠে বলে,
– “ একটু দাও, শুধু এক টান!”
আরিশের ঠোঁটের কোনে অল্প হাসির দেখা মেল। আধ খাওয়া সিগারেট দুই আঙ্গুলের এক ঝাকিতে ছিটকে যায় খোলা জানালার বাইরে।
–“ ডাক্তার আসবে বোধহয়, ততক্ষণ চুপ করে বসে থাকবেন,কোন কথা নয়।” মুখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় আরিশ।
মায়া করে তার অনুকরণ। মুখে কিছুই না বলে ঠোঁটে চেপে ধরে বাম হাতের তর্জনী। অন্য হাতের ইশারায় আরিশকে বুঝিয়ে দেয় তার পাশে বসতে। ভ্রু কুঁচকে যায় আরিশের। মেয়েটিকে বড় বেশী মায়াবী লাগছে এখন। কাজল পড়া চোখের দিকে আরিশ তাকায়, কিন্তু মায়ার দৃষ্টি এলোমেলো। একটু অস্বস্তি বোধ করলেও আরিশ আবারও বসে মায়ার পাশে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মায়া আরিশের বুকে এলিয়ে পরে। অবাধ্য চাদরটা যেন থাকতেই চাইছে না মায়ার দেহে। আরিশের বাহুতে আবার সেই নরম বুকের ছোঁয়া। আরিশ এটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও মায়া আরও ঘন হয়ে সরে আসে বুকের কাছে। এরপর মায়ার সময় কাটে যেন এক ঘোড়ের মধ্যে..... অচেনা কিছু মুখ.... আধো আধো কথা......আরিশ......রোদ.......ছায়া.. রুদ্র....
চেতনা ফিরতেই চোখে লাগে তীব্র আলো। উঠে বসে পরিস্থিতি বুঝতে চায় সে। ছোট্ট স্টেশন। সামনে তাদের ট্রেন দাঁড়িয়ে। লোকজন কেউ হাঁটছে ,কেউ কথা বলছে, দূরে আর একটি গাছের ছায়ায় কিছু তরুণ তরুণী গিটার ও তালি সহযোগে গান করছে। মায়া শুয়ে ছিল স্টেশনের একপাশে একটিবড় গাছের ছায়াতে। বট গাছ। চারধারে গোলকরে পাকা বাঁধানো। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে তার। হাতের কাছে পরে আছে ব্যাগটা। আরিশকে দেখা যাচ্ছে না। মায়া উঠে দাঁড়িয়ে একটু ঠিকঠাক হয়ে বসলো আবারও। তার আশ্চর্য লাগছে। হঠাৎ যেন সব চিন্তা ভাবনা লোপ পেয়েছে। ব্যাগটা আছে পাশেই, কিন্তু খামটি আছে কি না দেখতে ইচ্ছে করছে না,এমনকি সেটা নিয়ে তার আর কোন চিন্তাও হচ্ছে না। তার প্রয়োজনও নেই! অদূরে আরিশকে দেখা যাচ্ছে। তার হাতে দু কাপ চা।
সকাল ৭টার দিকে জানা গিয়েছে, সামনের কোন এক জায়গায় রেললাইন কয়েক ইঞ্চি সরে গেছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে ইতিমধ্যে। সাবোটাজ বা কাকতালীয়? নিশ্চিত নয় কেউ। তবে পঞ্চগড় এক্সপ্রেসকে তাৎক্ষণিক একটি লোকাল স্টেশনে থামিয়ে দেওয়া হয় নির্দেশে। স্টেশনটি রুটে নেই, কিন্তু জীবন বাঁচানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কীই বা হতে পারে?
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মায়া আকাশের দিকে তাকালো। দূর নীলিমায় একটি বড় মেঘ উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে কত অনায়াসে ঢেকে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। প্ল্যাটফর্মটি যেন হঠাৎ করেই ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে।
– “ তুমি সবটা প্রথম থেকেই জানতে, তাই না?”– মায়ার কন্ঠ শান্ত, উত্তাপ হীন।
– “ হুম, জানতাম।"
আরিশের মুখের হাসি হয়েছে চওড়া। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে মায়ার দিকে। মায়া চোখ বুঝে চায়ের কাপে দিচ্ছে চুমুক।
– “আপনার রাগ হচ্ছে না?” একটু কৌতূহল খেলে যায় আরিশের মুখে।
– “ হচ্ছে, কিন্তু খামটির জন্যে নয়! রাগ হচ্ছে কারণ আমি তোমায় বুঝতে পারছি না আরিশ.....
তুমি তো চাইলেই যেতে পারতে... একজন অপরাধীকে ট্রেনে ফেলে রেখে চলে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক হতো না!"
বলতে বলতে সে চায়ের কাপটি কোলের কাছে নামি ধরে দুই হাতে। ঘাড় ঘুরিয়ে মুখতুলে তাকায় আরিশের চোখে। কিন্তু ওই ঘন কালো চোখের গভীরে হাতরে কিছুই পায় না সে।
– “ শুধু মাত্র খামটির জন্যেই আমি এসেছি এমন ভাবছেন কেন?”
মায়া একটু হাসে–“ তবে কি ভেবে নেবো আমি তোমার বন্দিনী?”
– “ বন্দিনী!.... হুমম... হ্যাঁ এই বরং ভালো। টেনশন কম, ঝামেলা কম। এখন চুপচাপ বসে থাকুন, আমি দেখি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা যায় কি না।”
আরিশ উঠে চায়ের কাপ হাতে চলে গেল। মায়া চেয়ে রইল সেদিকে। আরিশ খামটা কখন সরিয়েছে সে জানে না,তবে অনুমান করতে পারে, সুযোগ সে অনেক পেয়েছে। কিন্তু খামের চিন্তা এখন তার আর নেই। অদূরের গাছ তলায় তরুণদের হৈচৈ দেখতে ভালো লাগছে, সালোয়ার কামিজ পড়া দুজন যুবতী নাচছে। বেশ ভালোই নাচছে। ওদের মনের আনন্দে উচ্ছাস যেন লেগেছে মায়ার মনেও। দীর্ঘদিন পর আজ এমন একটা দিন; যেদিনে মায়ার ভয় করছে না, অন্যায় কাজের জন্যে মনে অপরাধ বোধ জাগছে না। অদ্ভুত এক বিশ্বাস অনুভব করছে সে আরিশের প্রতি। কি হবে আর ভেবে? সে ধরা পরেছে! এখন একদিকে মৃত্যু অন্য দিকটা অজানা।