শেষ ট্রেনের যাত্রী/ সমাপ্ত - অধ্যায় ৪

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-69009-post-5962856.html#pid5962856

🕰️ Posted on June 11, 2025 by ✍️ কালপুরুষ (Profile)

🏷️ Tags:
📖 2597 words / 12 min read

Parent
পর্ব ৪ ছোট্ট স্টেশনটার বাইরে পাকা রাস্তা শেষ হতে না হতেই একফালি মাটির পথ, যেন প্রকৃতির গোপন কোনো অভিসারে পৌঁছানোর আমন্ত্রণ। সেই পথ ধরে খানিকটা এগোলেই সামান্য উঁচু একটা ঢিবি—জমে থাকা ঘাসে ছাওয়া, বুনো ফুলে রাঙা। ঠিক সেখানেই বসে আছে মায়া, একা। সবুজের সমারোহে এক টুকরো লাল আভা, বসে আছে হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে তার ওপরে চিবুক ঠেকিয়ে। চারপাশে কিছু মানুষের আনাগোনা থাকলেও, তার কাছে কেউ নেই। যেন নিস্তব্ধতা এসে আশ্রয় নিয়েছে তার পাশে। আরিশ একটু ভয় পেয়েছিল প্রথমটায়। খাবারের ব্যবস্থা করে ফিরে যখন দেখলো বন্দিনী উদ্ধাও– তবে যাই হোক,সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। পায়ের শব্দ মাটি শুষে নিলো, যেন মায়ার নির্জনতাকে ভাঙতে চায় না প্রকৃতি। আরিশ চুপচাপ বসে পড়লো মায়ার থেকে একটু দূরে। কিছু না বলে, কিছু না জিজ্ঞেস করে।  মায়ার চোখ স্থির, দূরের গাছপালার দিকে। লাল শাড়ির আঁচল হাওয়ায় উড়ছে —এই সবুজ প্রকৃতির মাঝে যেন আগুনের রেখা টেনে দিয়েছে কেউ।  আরিশ কিছু একটা বলতে গিয়েও সামলে নিল। এখান থেকে স্টেশনটা দেখা যায়, যদিও অনেকটা দূরে– তবুও স্পষ্ট। স্টেশনটাও বিশেষ বড় কিছু নয়। কয়েকটি ঘর ও দোকান নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে শুধু মাত্র পরিচয় টুকু দিতে। তবে চারপাশের পরিবেশ মনোরম, গাছপালায় ভরা। তাদের ঠিক পাশেই একটা জাম গাছ। ঘাসের ওপরে পাকা জাম,পাতা ও কিছু ভাঙ্গা ডাল ছড়িয়ে আছে। চারপাশে দৃষ্টি ফেলতেই টিলার নিচ থেকে দুটি ছেলেমেয়ে কে উঠে আসতে দেখে ওপর দিকে। কাঁদা-মাখা পায়ে, রোদে পোড়া মুখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস। তাদের হাতে ধরা লাল জবা ফুল, সদ্য ছেঁড়া, স্নিগ্ধতায় ভরা। আরিশ হঠাৎ বাচ্চা দুটিকে ডাকলো, –“এই শুন, একটু এদিকে আয়!” ওরা দৌড়ে এলো, কৌতূহল নিয়ে তাকালো তার দিকে। আরিশ মুচকি হেসে বললো, — “এই ফুলগুলো কি আমাকে দিবি?” ছেলেটা মাথা নাড়লো, মেয়েটি বললো,  — “ মা পুজো দেবে…” আরিশ ছেলেটাকে কাছে টেনে কানে কানে কি যেন বলে। মায়া আড়চোখে তাকায় সেদিকে। আরিশ ছেলেটা কে ছাড়তেই সে ছুটে এসে মেয়েটার কানে কানে সেই কথাই বলে বোধহয়। পরক্ষণেই মেয়েটা মায়ার দিকে তাকায়। তারপর চুপচাপ এগিয়ে আসে মায়ার সামনে। দুজনে দুটি লাল টকটকে জবা এগিয়ে দেয় মায়ার দিকে। মায়া সেই ফুল দুটি হাতে নিতেই শোনে আরিশের গলা, – “জবা কুসুম সঙ্কাশং রক্তবর্ণং মহাবলম্। চণ্ডিকাং চণ্ডরূপাং তাং নমামি জগদম্বিকাম্॥” নাও! আমারও পুজো দেওয়া হয়ে গেল,এবার যদি দেবীর অভিমান ভাঙ্গে? মায়া কেমন ঘোর লাগা চোখে দেখলো আরিশকে, তারপর চোখ নামিয়ে ফুলটার দিকে তাকালো। ফুল সে অনেক পেয়েছে। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বিছানায় তার সুন্দর নগ্ন দেহটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে না জানি কত বার। কিন্তু এই স্পর্শ এক অন্য মাত্রার স্পর্শ, এক অদৃশ্য কোমলতা ছুঁয়ে গেল তাকে। সে মুখ তুলে তাকালো আরিশের দিকে। কপালের ভাঁজে একটুকরো প্রশ্রয়—মৃদু, অচেনা, কিন্তু স্পষ্ট। আরিশ উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে এসে বসলো মায়ার পাশে। বাহুতে বাহুতে হালকা স্পর্শ লাগতেই কেমন এক তীব্র অনুভূতিতে চোখ বুঝলো মায়া। ছেলেমেয়ে দুটি তখুনি হাত পাতলো আরিশের কাছে। তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আরিশ বললো, – “ খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে,তবে দুর্ভাগ্য বশত তারা হেঁটে হেঁটে পথ চিনে এখানে আসতে অক্ষম।”  মায়া পাশ ফিয়ে চোখ মেলে তাকায়‌। আরিশের মুখে আগের মতোই হাসি,সেই হাসি সংক্রমণিত হয়ে ছড়ালো এবার মায়ার মুখেও। আরিশ উঠে দাড়ালো। মায়া হাত বাড়িয়ে ধরলো তার হাত,কোমল কন্ঠে বললো, – “ একটু বসলে কি খুব ক্ষতি হবে?” – “ হুমম...লাইন ক্লিয়ার হতে হতে দুপুর পেরুবে–না! ক্ষতি বোধহয় হবে না।” – “তবে একটু বসবে?”  আরিশ বসলো। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মায়া বললো, – “এই জায়গাটা যেন সব ভুলিয়ে দেয়, তাই না?” মায়ার কণ্ঠে শীতলতা নেই, আবার উষ্ণতাও না—একধরনের ক্লান্ত মুগ্ধতা। আরিশ চুপ থাকে। মায়া এবার নিজেই বলে ওঠে, – “আরিশ… তুমি জানো আমি কে?” আরিশ ঘাড় নাড়ে,– “জানি। তোমাকে চিনি বলেই আমি এখানে এসেছি সব জেনে।” মায়া একটু হেসে ফেলে, কিন্তু সেই হাসিতে বিদ্রুপ নেই, শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস লুকানো। – “তুমি যে পাগল সে কথা তুমি জানো?” আরিশ চোখে কৌতুক খেলে যায়,মুখে হাসি রেখে সে উত্তর করে–“ হ্যাঁ,তাও জানি! একটা মেয়ে আগে বলতো আমায়,এমনকি মা মাঝে মাঝেই বলেন এখনো।” কিছুক্ষণ যেন সব থেমে থাকে। নিস্তব্ধতা ভাঙে দূর থেকে ভেবে আসা গিটারের টুংটাং। সুরের ফাঁকে মায়ার গলা কাঁপে না— দুই চোখ  বুজে দীর্ঘ নিঃশ্বাস গ্রহণের পর সব যেন ঝরঝরে হয়ে আসে, – “আমি কাজ করতাম ‘তাদের’ জন্যে—যাদের নাম নিয়েই সাধারণ মানুষ কাঁপে। অস্ত্র কেনাবেচা, তথ্য পাচার, সাথে ধনী লোকেদের কামনার জালে ফেলে ব্ল্যাকমেইল। খুব নিখুঁতভাবে করি। আমাকে সবাই 'দ্য ক্লিনার' বলে ডাকে—কারণ আমি প্রমাণ রাখি না। কেউ জানত না—তুমি জানলে, তাও বলো না কে বলেছে... আমি জানতে চাই না।” একটু বিরতি... – “তবে আমি ক্লান্ত আরিশ। শরীর নয়—মন ক্লান্ত। আমার শরীরের  উত্তেজনা আমি হারিয়েছিল অনেক আগেই– কিন্তু তুমি সব এলোমেলো করে দিয়েছো! আবারও একটু বিরতি...... —“ এই জগতটার প্রতি আমার কোন আসক্তি নেই আরিশ,যা করেছি শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে করেছি। আমি বাঁচতে চাই আরিশ, কিন্তু এভাবে নয়। তুমি জানো? আমি অনেক আগেই চাইছিলাম পালাতে... কিন্তু বেরোবার পথ জানতাম না। এবং... আমি কাউকে বিশ্বাস করতাম না। " আরিশ ধীরে হাত বাড়িয়ে রাখে মায়ার কাঁধে। — “আমাকে বিশ্বাস হয়, সত্যিই?” উষ্ণ হাতের স্পর্শে মায়া একটু কাঁপে,মায়া মাথা নাড়ে না, শুধু চোখ বুজে থাকে।  হালকা হাওয়া বইছে, ঢিবির নিচে ঘাসের মাঠে কখনো রোদ ও কখনো ছায়া পড়ছে। একটু দুরেই গিটার বাজছে ধীরে—“জীবন যে রঙিন... যদি মুছে দাও আঁধার..." মায়া হঠাৎ আরিশের দিকে ঘুরে বসে। তার চোখে জল নেই, কিন্তু পলকহীন দৃষ্টি। ঢঢ – “তুমি কেন থেকেছো? চলে যেতে পারতে। আমিতো নিছক একটা অপরাধী।” – “অপরাধী! আবার ওকথা কেন?” মায়া চুপচাপ মাথা নত করে।  – “তুমি কি নিজ হাতে কেউকে মেরেছো মায়া?” আরিশের মুখে আর হাসি নেই এখন। – “ মানে?” একটু যেন অবাকই হয় মায়া। – “ খুন মায়া খুন।” – “ না” আরিশ মুখ ফিরিয়ে তাকায় সামনে,– “আমি মেরেছি,এই দু হাতে!” তার গলা যেন বরফের মতো ঠান্ডা শোনায়।— “তুমি ছিলে একজন অপরাধী, এখন শুধু মায়া।” দুজনের মাঝে নীরবতা। যেন শব্দ প্রয়োজন নেই। খানিক পরেই আরিশ উঠে দাঁড়ায়। মায়া সেদিকে তাকিয়ে একটি হাসিখুশি যুবককে দেখে,যার সাথে তার পরিচয় গতকাল রাতেই–একটু আগে হঠাৎ পাল্টে যাওয়া মানুষটা এখন উধাও। – “ তাছাড়া আমি একজনের কাছে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ! তোমাকে ফিরতে হবে মায়া।” –“ হুঁ”  মায়া ঠিক বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। তবে আরিশ তাকে হাত ধরে টেনে দাড় করিয়েই হাটা লাগিয়েছে, –“ আর প্রশ্ন নয় মায়া,খুব খিদে পেয়েছে।” অগত্যা মায়া এবার হাটা লাগায় আরিশের পেছন পেছন,তবে এই মায়া নতুন কোন সত্তা,কানে তার রক্ত জবা,মুখ শান্ত শুভ্র, ঠোঁটে একচিলতে হাসি। সে একটি বিশ্বাসযোগ্য আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, এখনো কেউ আছে তার ফিরে যাবার অপেক্ষায়... কিন্তু কে সে? সে কি ওই চশমা পড়া লম্বাটে ছেলেটা? ভাবতেই মায়ার সর্বাঙ্গে শিরশির অনুভুতিতে কেমন করে ওঠে যেন! স্টেশনে ফিরে আসতেই যেন প্রকৃতি চুপিচুপি সংকেত দিলো ঠান্ডা হাওয়াতে ভর করে। পশ্চিম আকাশে কালো মেঘ জমে গাঢ় হয়ে উঠছে, আলো ক্রমশ ম্লান। বাতাসে অদ্ভুত একটা ভার। যেন কিছু ঘটবে—খুব শিগগিরই। স্টেশনের এক প্রান্তে একটি চায়ের দোকানের সামনে গাছতলায় পাত পেতে খাবার দেওয়া হয়েছে—সাদামাটা কিছু, কিন্তু গন্ধে চমৎকার। স্টেশনের আশেপাশের মানুষজনও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। মায়া গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে, চোখে অদ্ভুত জেদ। আরিশ খাবারের পাত তুলে তার পাশে এসে বসলো, — “চলো, খাওয়া যাক।” মায়া মাথা নাড়লো। — “না, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।” — “জ্বরের পর খালি পেটে থাকা ঠিক না। শরীর ভেঙে পড়বে।” — “তবু না... তুমি খাও।” আরিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর থালা হাতে সরে এলো পাশে। এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে আলুর দম নিয়ে মায়ার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে বললো, — “খেয়ে নাও মায়া,ভোর রাতে বমি করে পেটে নিশ্চয়ই নেই কিছু এখন।" মায়া কিছু বললো না, শুধু দৃষ্টি সরিয়ে নেয় লজ্জায়। এখন সে বোঝে তাকে আরিশ ট্রেনের বাইরে এনেছে কেন। ছেলেটাকে তবে যন্ত্রণা সে কম দেয়নি। আরিশ আবারও  তার মুখের এনে ধরলো রুটির টুকরো। প্রথমে ঠোঁট একটু কুঁচকে এলো মায়ার, তারপর সে মাথা হেলে হ্যাঁ করে মুখে তুলে নিলো। এক গালভরা খাবার, মুখে কিছুটা বিস্ময়—কিন্তু অদ্ভুত তৃপ্তি। খাওয়াতে খাওয়াতে আরিশ বললো, – “তুমি আমায় পাগল বলতে, এখন দেখো কে পাগলামী করছে?” মায়া মুখে খাবার রেখেই হাসলো।— “তোমার সাথে একটু পাগলামি করতে ইচ্ছে করছিল খুব।” আরিশ থমকে গেল। তার চোখে এক মুহূর্তের জন্য অস্থিরতা, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার খাওয়ানো শুরু করলো। আরিশের আঙুল মাঝে মাঝে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার ঠোঁট, তার গাল, তার চিবুক। মায়ার শরীর নিঃশব্দে প্রতিক্রিয়া জানায়—একটা হালকা শ্বাস, এক চিলতে কাঁপুনি। আরিশ বুঝতে পেরে গলার স্বর একটু গম্ভীর করে ফেললো। — “তুমি জানো, আমি তোমাকে ঠকাতে আসিনি, নিয়ে যেতে এসেছি, আমার প্রতি মায়া বাড়িয়ে আমায় বিপদে ফেলছো তুমি।” — “আমি তোমায় মায়ায় ফেলছি! তাই বুঝি জোর করে খাইয়ে দিচ্ছো?” — “না খেলে শরীর আরো দুর্বল হয়ে পরবে....... আরিশ বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে,তবে মায়া আপাতত বাস্তবতা ছাড়িয়ে কল্পনায় নানা দৃশ্য এঁকে চলেছে,তার হাবভাব কেমন যেন লাগছে আরিশের,একটু যেন ছন্নছাড়া। এই সবের মাঝে খাওয়া শেষ হতেই আকাশ চিরে একফালি বিদ্যুৎ দেখা দিলো। মুহূর্তেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। লোকজন ট্রেনের দিকে ছোটে, ছাতা মাথায় দু একজন চায়ের দোকান থেকে বের হয়, কেউ চায়ের দোকানের টিনের চালায় আশ্রয় নেয়। মায়া উঠে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে। তারপর দুহাত ছড়িয়ে দেয়, যেন জল তার রক্তের সব গ্লানি ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরিশ দৌড়ে ট্রেনে উঠেছিল,এবার পেছন ফিরে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। — “তুমি পাগল? জ্বর তো সবে সেরেছে!”  জোর গলায় বলে আরিশ। মায়া যেন শোনে না। মাথা ঘুরিয়ে চুল ছুঁড়ে দেয় বাতাসে।  — “মালটা একদম কড়া।" — “কোমরটা দেখেছিস উফ্.......” দরজার পাশে বসা সিটে দুজনের গলা শোনে আরিশ। স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে আরিশের কড়া দৃষ্টি চোখে পরতেই লোক দুটি থমকে যায়। ওদিকে বৃষ্টির ধারায় মায়ার শাড়ির আঁচল গা থেকে পিছলে যাচ্ছে,আরিশ আর সহ্য করতে পারে না। সে এগিয়ে যায়, মায়ার দিকে হাত বাড়ায়।  — “এসো।” মায়া হেসে বলে, — “না। এত তাড়াতাড়ি আবার ট্রেনে ঢুকবো কেন?” লোকজন ট্রেনে উঠে পড়ছে একে একে। প্ল্যাটফর্ম এখন ফাঁকা। আরিশ এবার সত্যিই রেগে যায়। মায়ার দিকে এগিয়ে এসে, হঠাৎই তাকে তুলে নেয় কোলে। — “যদি না শোনো, তবে আমাকে এমন করেই শোনাতে হবে, মিস দ্য ক্লিনার।” মায়া প্রথমে চমকে যায়, তারপর থেমে থাকা সেই অদ্ভুত হাসিটা আবার ফিরে আসে ঠোঁটে। তার মুখ ঘুরে আরিশের গাল ছুঁয়ে যায় আলতো করে—একটা দীর্ঘ স্পর্শ। তারপর দুহাতে আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে আরিশের গলা। ট্রেনে উঠে আরিশ দরজা বন্ধ করে দেয়। ভেজা মায়া দাঁড়িয়ে, ঠাণ্ডায় কাঁপছে। আরিশ প্রথম মায়ার ব্যাগ দেখে, যদিও  সে জানে কোন কাপড় নেই তাতে, তবে একটা বোতল ছিল ব্যাগে। চ্যাপ্টা গোছের বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে নাকের সামনে ধরে সে। তারপর সেটি রেখে দিয়ে নিজের ব্যাগ তুলে নেয় হাতে। ব্যাগ খুলে প্যান্ট ও একটি টিশার্ট বের করে মায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, — “এগুলো পরে নাও, ভিজে শাড়িতে ঠান্ডা লাগবে।” — “আমি এটা পরবো না।” আরিশ এবার চুপচাপ এগিয়ে এসে চেপে ধরে মায়ার কব্জি। টেনে নিয়ে যায় তাকে ট্রেনের বাথরুমে। নিজের নীল চাদরটা দিয়ে মায়ার চুল মুছে দিতে থাকে। মুখ তার থমথমে। তারপর ধীরে বলে— — “এটা কোনো খেলা না মায়া। এখন যা বলছি, সেটাই করো।” মায়া একটু কুঁচকে তাকায়, তবে আর আপত্তি করে না। পেছন ঘুরে কাপড় ছাড়তে থাকে। আরিশও দরজা টেনে ফিরে আসে সিটের দিকে। সিট খালি আছে অনেকগুলি। সে একটা পছন্দ করে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে। মায়ার ব্যাগ থেকে বোতলটা বেরকরে ছুরে ফেলে দূরে। স্টেশনের এই দিকটা খোলামেলা। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ভেজা মাঠ দেখা যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত। খানিকক্ষণ পরেই ভেজা চুলে নীল চাদরটা জড়িয়ে মায়া এসে বসে তার মুখমুখি । তার গায়ে এখন জিন্স প্যান্ট এন্ড কালো টি শার্ট। মুখে স্নিগ্ধ হাসি। অনেকে তাকাচ্ছে মায়ার দিকে, মেয়েটা যেন হঠাৎ তাদের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। শুধু আরিশ তাকিয়ে জানালার বাইরে বৃষ্টি ভেজা দূর দিগন্তে। এবার মায়াও আরিশের দৃষ্টি অনুসরণ করে। দূরের মাঠের আল পথ দিয়ে কলা পাতায় বৃষ্টি আটকে ছুটে যাচ্ছে দুটি ছেলে মেয়ে....... বিকেলে আবহাওয়া শান্ত হয়ে এসেছে। আর ঘন্টা খানেক পরেই তাদের যাত্রা শুরু। এই শুনে সবাই ঘোরাফেরা করছে স্টেশনের ভেতরেই । আরিশেরও বেরুবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মায়া আর একবার সেই ঢিবির কাছে যেতে জেদ ধরেছে। অগত্যা তাকে খুশী করতে তারা বেরিয়ে এলো স্টেশনের বাইরে। আজ মায়াকে রহস্যময়ী নয় বরং আর কটা সাধারণ  নারীদের মতো অভিমানী ও প্রাণবন্ত লাগছে। সরু পথ ধরে মায়া আগে আগে ও আরিশ পেছন পেছন চারপাশে দৃষ্টি রেখে এগুচ্ছে। চারপাশটা যেন নিঃশব্দে কাঁপছে,অল্প রোদ উঠেছে ,পাতার ফাঁক দিয়ে সেই আলো পড়ছে মায়ার চুলে, আরিশ মাঝে মাঝে তাকে চুপচাপ দেখছে— মায়ার ডান হাতে সেই রুমালটা বাধা,বাম কানে দুটি লাল রক্ত জবা। চলতে চলতে মায়া হঠাৎ দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে। আরিশ সামনে এগিয়ে এলে আলতোভাবে বুকে হাত ঠেকিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। তারপর দুহাতে আলতোভাবে খুলে নেয় আরিশের চশমাটা। লাগায় নিজের চোখে। আরিশ কিছু না বলে ধীরে ধীরে চলে আসে ঢিলার সম্মুখে।  উঁচুনিচু জমিটার জায়গায় জায়গায় জল জমেছে ঘাসের মাঠে। ওপরে উঠে মায়া আরিশের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলে, —“ কেমন যেন লাগছে চোখে।” –“ এই চশমা তোমার জন্যে নয় মায়া,খুলে ফেলো।” মায়া যেন কথাটা শোনেনি। সে আগের মতোই মৃদু স্বরে বলে, –“ আমি তোমাকে চিনতে চাই আরিশ! তুমি কে তা জানতে চাই” –“ আমি তোমায় পুরোপুরি মিথ্যে বলিনি মায়া,তবে তুমি ভুলে গেছো! অবশ্য অনেকেই এখন আমায় চিনতে হিমশিম খায়,তবে আমি ভেবে ছিলাম তুমি চিনবে।” মায়া চমকে মুখ তুলে তাকায়। ভালো মতো দেখে আরিশের মুখখানি। তবে তার চেনা হয়ে ওঠে না,হঠাৎই তাদের পেছনে "ঝুপ" "ঝুপ" পায়ের আওয়াজ। ফিরে তাকাতেই দেখে তাদের ফিরতি পথ আটকে দাঁড়িয়েছে তিনজন পুরুষ। মায়া তাদের দেখা মাত্রই আতংকে আঁকড়ে ধরে আরিশের বাহু।  — “খামটা আমাদের দিয়ে দে লক্ষ্মী ছেলের মতো। আর মেয়েটাকেও।” মায়া আঁতকে উঠে আরিশের দিকে আরো সরে দাড়ায়। আরিশ শান্ত ভাবে মুখে হাসি রেখে বের করে আনে খামটি। একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়ানো সেটি। এতক্ষণে আরেকজন কোমর থেকে পিস্তল বের করেছে। আরিশ তাকিয়ে থাকে...শান্ত... স্থির তার দৃষ্টি। লোক গুলো একে অপরের দিকে তাকায়। তারা যেন কিছুটা বিভ্রান্ত। খানিক বাদেই অবশ্য সামলে নিয়ে দৃঢ় স্বরে বলে, –“ কোন রকম চালাকি করলে এখানেই পুতে দেব... মেয়েটার হাতে দে ওটা.. জলদি। মায়া ভীতু নয়নে তাকায় আরিশের দিকে। আরিশের চোখ আগের মতোই, কিছুই খুঁজে পায় না সে। আরিশ দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ার হাতে তুলে দেয় প্যাকেটে মোড়ানো খামটা। মায়ার চোখে জল, কিছুই যেন বিশ্বাস হয় না তার। সবই ঠিক মতো চলছিল, না জানি কোন আবেশে এতটা সময় তার অতীত ভুলে ছিল মায়া। এখন হঠাৎ সেই অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে মায়া যেন মুক্তির পথ পায় না খুঁজে। তারপর কানের কাছে মৃদু স্বরে কে যেন বলে, –“ ভয় পেও না মায়া,আমি আছি তো!” মায়া মুখ তুলে তাকায় আরিশের দিকে,আরিশ আলতো ভাবে সামনে ঠেলে দেয় মায়াকে। আরিশের দৃষ্টি এখনো স্থির নিচের দিকে।  – “ নেমে আয় জলদি,আয় বলছি!” লোকটা জোরে ধমক লাগায় এবার। কিন্তু মায়ার পা ভাড়ি হয়ে আসে, মুখে শত কথার ঢেউ যেন চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সে আর ফিরতে চায় না তার অতীতে– মাঝ পথেই থমকে দাঁড়ায় মায়া। নিচে থাকা তিন জনের দৃষ্টি তখন মায়ায় দিকে,মুখে তাদের সাফল্যের হাসি। – “ আবে.. দাঁড়িয়ে দেখছিস কি! ধরে নামিয়ে আন শালিকে...” ধমকে কেঁপে ওঠে মায়া। খামটা আঁকড়ে ধরে শেষ বারের মতো তাকায় ঢিবির ওপরে আরিশের পানে। এবারও বিষ্ময়ে আঁতকে ওঠে সে– আরিশের হাতে দ্রুত বেগে উঠে এসেছে একটি পিস্তল! তৎক্ষণাৎ তীব্র কান ফাটানো শব্দ! মায়া দুই হাতে কান চেপে বসে পড়ে ভেজা ঘাসের ওপরে। পিস্তল ধারি লোকটি আর্তনাদ করে বসে পরে হাত চেপে। পাশের একজন ক্ষিপ্র হাতে একটি ছুরি ছুড়ে মাড়ে আরিশের দিকে। আর একজন এগিয়ে এসেছে মায়ার প্রায় কাছে।  ছুরি লেগেছে আরিশে হাতে, পিস্তল ছিটকে পড়েছে একটু দূরে ।তবে আরিশ সময় নষ্ট না করে সামনে থাকা ছুরিটা তুলেই ছুড়ে দেয়। লোকটার গায়ে ছুরি না লাগলে আঘাত এড়িয়ে যেতে গিয়ে সে আঁছড়ে পড়ে মাটিতে। অন্য জন তখন পৌঁছে গেছে আরিশের কাছে। শুরু হয়েছে ধস্তাধস্তি। লোকটি সাবলীল,তবে আরিশকে সামলাতে যেন হিমসিম খাচ্ছে।  নিচ থেকে কি যেন বলে ওঠে আহত লোকটা। বোঝা যায় না,তবে মুখ ফেরাতেই পরিষ্কার হয় সবটা। ধস্তাধস্তির সুযোগে  মাটিতে পরে যাওয়া লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে যাচ্ছে পিস্তল তুলে নিতে। পরিস্থিতি দেখে মায়ার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। আতংকিত মায়া এবার  খাম ফেলে উঠে দাড়ায়–গাছের একটা মোটা ডাল পড়ে ছিল মাটিতে। দুহাতে সেটা তুলে সে ছুটে যায় সেদিকে। তারপর এক ঝটকায়  পেছন থেকে  আঘাত করে লোকটার পিঠে। পিস্তল ছিটকে যায়, লোকটাও ধপাস করে শুয়ে পরে সেখানেই মায়া তবুও থামে না! ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে চিৎকার করতে করতে।  এক সময় কেউ তাকে টেনে নেয় পেছনের দিকে, মায়া এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়ে  দুহাতে সামনে উঁচিয়ে ধরে ডালটা। তবে পেছনে আরিশ। তার ঠোঁটের বা পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্ত,ডান হাতের কিছুটা বোধ হয় কেটেছে ছুরির আঁছড়ে। মায়ার হাত থেকে পরে যায় ডাল। সে সজোরে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আরিশকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মায়ার দেহটা যেন লতার মতো আরিশের গলা জড়িয়ে উঠে আসতে থাকে ওপরে দিকে– আরিশের বুকে একজোড়া ব্রা বিহীন নরম স্তন চেপে বসে, ঠোঁটে লাগে কোমল ঠোঁটের স্পর্শ। আরিশের তাজা রক্তের নোনতা স্বাদ ঠেকে মায়ার জিভে।  কতগুলো লোকের সম্মিলিত কোলাহল ভেসে আসছে দূর থেকে। আরিশের চোখ বিস্ফারিত, ঠোঁট জোড়া মায়ার ঠোঁটের আলিঙ্গনে আবদ্ধ।
Parent