সৃষ্টি (সমাপ্ত) - অধ্যায় ১২
প্রথমে মেঘ পরে রৌদ্র
লেখা :- বুম্বা
প্রচ্ছদ :- আমার মায়ের সৃষ্টি
রাখীর বন্ধন হলো, চাওয়া পাওয়ার আবদার,
রাখীর বন্ধন হলো, ভাই-বোনের ভালোবাসার।
রাখীর বন্ধন হলো, অনেক দুস্টুমির পর,
কুছ মিঠা তো জরুর চাই ..
রাখীর বন্ধন হলো,
আমার মতো তোকে কে ভালোবাসবে ভাই!!
আগামী ইংরেজি মাসের ২২ তারিখ রাখী-বন্ধন উৎসব পালিত হবে সারা দেশ জুড়ে। গতবছর দেখেছিলাম করোনার আবহাওয়ায় রাখীর বাজারের বিক্রি-বাট্টা অন্যবারের তুলনায় অনেকটাই কম .. তবুও তার মধ্যে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ছিলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির জনসাধারণকে রাখী পরানো নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা।
ওইদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক জায়গায় শুনতে পেলাম একজন তৃণমূল সমর্থক এক বি.জে.পি সমর্থক কে খুব গর্বের সঙ্গে বলছে "তোরা সাড়ে পাঁচশো'টা পরিয়েছিস? আমরা দেড় হাজারের উপর .." বলতে এসেছিলাম এক কথা এখন দেখছি উল্টোপাল্টা বকে আমি বোধহয় অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি। যাই হোক এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আজ আমার ছোটবেলার একটা রাখীবন্ধনের দিনের ঘটনা তোমাদের কে বলবো ..
ছোটবেলায় এই দিন'টা আমার কাছে খুব স্পেশাল ছিল। রাখী উৎসবের জন্য নয় .. কারণ আমার নিজের কোনো বোন বা দিদি নেই, কাজিন সিস্টার যারা আছেন তারা অনেক দূরে দূরে থাকতেন, তাই তাদের কাছ থেকে রাখী পরার সৌভাগ্য আমার কোনোদিনই হয়েনি। তবে সেই অভাব টা পূরণ করে দিতেন আমার মা আর ঠাকুমা। ওরাই প্রতিবছর আমাকে রাখী পরাতেন। এছাড়াও আর একটা কারণে দিনটি'র গুরুত্ব আমার কাছে বেশী ছিলো, ওইদিন ছিলো আমার ঠাকুমা'র জন্মদিন।
আগেকার দিনের মানুষের বিশেষ করে বাড়ির মহিলাদের নিজের জন্মদিনের তারিখ মনে থাকতো না বা হয়তো তারা মনে রাখার চেষ্টাই করতো না। তাই নির্দিষ্ট তারিখ স্মরণে না থাকলেও যেহেতু উনি এই বিশেষ দিনটিতে জন্মেছিলেন তাই প্রতিবছর রাখীবন্ধন উৎসবের দিনেই উনার জন্মদিন পালিত হতো .. আর জন্মদিন মানেই তো বাড়িতে ভালোভালো খাওয়াদাওয়া।
সেবার আমার দাদু'র প্রস্টেট গ্ল্যান্ডে ক্যান্সার ধরা পড়লো। লাস্ট স্টেজ .. ডাক্তার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। সেই সময় তো এখনকার মতো চিকিৎসা ব্যবস্থার এত উন্নতি হয়নি, তাই কেমোথেরাপি দিয়ে যতদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় আর কি .. সবার খুব মন খারাপ। দুর্ভাগ্যক্রমে রাখীর দিনই দাদুর কেমোথেরাপির ডেট পড়লো। তাই ঠিক হলো সেইবছর ওইদিন আর আমার দিদা'র (ঠাকুমা) জন্মদিন পালন হবে না।
আগেরদিন রাতে দাদু কে নিয়ে আমার বাবা গাড়ি করে কলকাতা চলে গেলো। তারপর থেকে শুরু হলো বাড়ির সকলের টেনশন। তখন তো মোবাইল ফোন আবিষ্কার হয়েনি। আমাদের বাড়িতে সেই সময় ল্যান্ডফোনও আসেনি। রাখীর দিন দুপুরে শুধু আলুসিদ্ধ আর ভাত রান্না হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।
বিকেলের দিকে বাবার অফিসের বিশ্বাস কাকু খবর নিয়ে আসলেন বাবা অফিসে ফোন করে জানিয়েছে দাদু ভালো আছে, ওরা কলকাতা থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে, সন্ধ্যের মধ্যেই ঢুকে যাবে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো মা আর ঠাকুমা এইভেবে যে অন্তত এই যাত্রায় তো উদ্ধার পাওয়া গেলো!
বাবা সন্ধ্যাবেলা দাদু কে নিয়ে ফিরলো। আমি তখন খুবই ছোটো .. ৫ - ৬ বছর বয়স হবে হয়তো। তাই রাখী উৎসবের দিনে একটাও রাখী না পাওয়া বা বাড়িতে সেইভাবে কোনো মুখরোচক রান্না না হওয়ার জন্য খুবই মুষড়ে পরেছিলাম।
কিন্তু দাদুকে দেখার পর মনে একটা অদ্ভুতরকমের আনন্দ অনুভব করতে লাগলাম। দাদু কে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করলাম। তারপর নালিশ করলাম মা আর দিদা'র নামে এই বলে যে, আমাকে সারাদিন একটুও ভালোমন্দ কিছু খেতে দেয়নি এরা।
দাদু আসাতে বাড়িতে খুশীর পরিবেশ ফিরে এলো।
রাতে দিদা পায়েস আর গোকুল-পিঠে বানিয়েছিলেন। সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে আমার।
বাবা, মা, ঠাকুরদা, ঠাকুমা.... আজ আর কেউই নেই। কোথায় যে হারিয়ে গেলো সেই সব সোনালি দিন কে জানে!! তোমরা যেখানেই থাকো ভালো থেকো গো।