সুলতানার ডায়েরি - অধ্যায় ৬
তিন রাউন্ডে খেলা হবে, রিং এ আসাদ ভাই যখন ঢুকলেন, চারিদিকে চিৎকারে ভেসে উঠেছে, কেজের শিকল ঝাঁকিয়ে আসাদ ভাইও দর্শকদের উত্তেজিত করছেন। চিৎকার আর হইহট্টোগোলের মাঝে ভাইয়া আমার পাশে এসে বসলেন খেয়াল করিনি। যখন বললেন "আজ ছোকরা শেষ" তখনই চমকে উঠলাম। রিং এর দিকে চোখ পড়তেই ছিপছিপে তরুনকে রিং এ ঢুকতে দেখা গেল। আদিনাথের বডিটা পাতলা হলেও বেশ শক্ত, রোগা না, পেশিবহুলও নয় তবে দূর্বলও বলা যাবে না। যদিও পেশিবহুল দীর্ঘদেহী আসাদ ভাইয়ের সামনে তাকে নেহাত শিশু মনে হচ্ছে। রেফারি দুজনের সাথে করমর্দন করতেই ঘন্টা বেজে উঠল। আসাদ ভাই কোনো কিছুর সুযোগ না দিয়েই একদম নকআউট পাঞ্চ চালালেন। গত বছর ব্রাজেলিয়ান লোকটার সাথেও আসাদ ভাই সেম করেছিলেন, বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে সোজা অ্যাটাক, ব্রাজেলিয়ান আর উঠতেই পারেনি। সেখানে এই ছেলের তো সুযোগই নেই। বাকিদের ফাস্ট রিফ্লেক্স থাকলেও তারা এই পাঞ্চ থেকে বাঁচতে পারে না। আদিনাথের রিফ্লেক্স সম্পর্কে আমি পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলাম যে এইও চেষ্টাও করতে পারবে না। ঘটনাটা ঘটনা সেকেন্ডের মধ্যে সজোরে চালানো পাঞ্চটা আদিনাথ ডচ্ করার কোনো লক্ষনই দেখলাম না সজরে তার থুতনি আঘাত করল। আমি নিশ্চিত এরপরই সে লুটিয়ে পড়বে। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে আদিনাথ বডিটাকে বক্সিং কায়দায় নাচাতে লাগল। ভাইয়া সমেত দর্শকও অবাক। কোলাহল একদম থেমে নিশ্চুপ তারপরই চিৎকার শুরু হল পূর্ন দমে। আসাদ ভাই একটু হকচকিয়ে গেছেন, এমনভাবে এই ছেলেটা তার অ্যাটাকটাকে হজম করে নেবে তিনি ভাবতেই পারেননি। আসাদ ভাই দ্রুত মুভ করছেন আর ক্রমাগত ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছেন। আদিনাথ কখনও সেভ করছে কখনও পারছে না। তবে কোথাও যেন মনে হচ্ছে ও সবকটাকে ডচ্ না করলেও কিছু যায় আসবে না, আঘাতে ওর শরীরে কোন প্রভাব পড়ছে বলে মনে হয় না। আসাদ ভাই হাপিয়ে যাচ্ছেন। তবুও আদিনাথের দম শেষ হয় না অন্যকেউ হলে এতোক্ষণে শিওর উল্টে পড়ত। আদিনাথ চঞ্চল না স্থির অনেকটা হৃৎস্পন্দনের মতো একটা নির্দিষ্ট ছন্দে নেচে চলেছে রাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই আদিনাথের গালের উপর সজোরে একটা ঘুষি আছড়ে পড়ল, সকলে ভাবল এতোক্ষণে আদিনাথের শক্তি শেষ আমিও ভাবলাম আদিনাথ পড়ে যাবে। কয়েক সেকেন্ড আদিনাথ স্থির তাকালো তারপর আবার সেই একই ভঙ্গি। লোকজনের চিৎকারে কান পাতা দায়। ঘন্টা বাজল, আসাদ ভাই হাপিয়ে গেছে। আদিনাথকে দেখে বিচলিত মনেই হলো, ও একদমই আহতও মনে হলো না। শান্ত ভাবে কর্নারে দাঁড়িয়ে রইল। ভাইয়া আসাদের কাছে গিয়ে বলল, "কি রে এই ছেলেটাকে এতো সময় কি করে লাগছে। "
"জানিনা ভাই, নকআউট পাঞ্চটা সাইভাইভ করে গেল কি করে?"
তখনই বেল বেজে উঠল।
আবার দ্বিতীয় রাউন্ড শুরু হল।
আসাদ ভাই দ্রুত পাঞ্চিং শুরু করলেন রিকভার করার সুযোগ দিতেই চাইছেন না, আদিনাথকে।
আদিনাথ অবশ্য একই রকমভাবে ডচ্ করছে, দুটো একটা পাঞ্চ ইচ্ছে করেই একসেপ্ট করছে। একটা কথা বেশ ভাববার আদিনাথ শুধুই ডিফেন্স করে চলেছে। তাকে একবারও অ্যাটাক করতে দেখা যাচ্ছে না। যেন সে শুধু ডিফেন্স করতেই এসেছে অ্যাটাক করা তার উদ্দেশ্যই না।
এইসবের মাঝে সে আমার দিকেও তাকাচ্ছে। তার চোখের দিকে তাকালেই মনটা কেমন উদাস হয়ে উঠছে। ছেলেটাকে নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠছে মন। হঠাৎ সজোরে, একটা জ্যাব আদির মুখে এসে লাগল, আমি আর তাকাতে পারলাম না। চোখ খুলে দেখলাম আদিনাথ আবারও সেই একই স্পন্দনে নড়ে চলেছে, ওর সাথে চোখাচোখি হতেই সে যেন চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিল কিছুই হয়নি, চিন্তা করো না। আবারও ডিফেন্স আর অ্যাটাক চলল। মিনিট কয়েক পর ঘন্টআ বাজল। দ্বিতীয় রাউন্ড শেষ।
ভাইয়া আসাদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে কি সব বলতে লাগল। আদিনাথ অপর কর্নারে স্থির, তাকে দেখে বোঝার কোনো উপাই নেই, সে এতোগুলো সলিড পাঞ্চ আর জ্যাব যাস্ট হজম করে নিয়েছে। তৃতীয় রাউন্ড শুরু হতেই আদিনাথের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। যে বিদ্ধংসী ডিফেন্স করছে তার মুখের উপর ঘুষি ছোঁয়ানোর ক্ষমতা আসাদ ভাই কেন মহম্মদ আলিরও হবে না। আদিনাথ অ্যাটাক করছে না সে চাইলে বেপরোয়া আসাদ ভাইকে পাঞ্চব্যাক করতেই পারে। রাউন্ড শেষ হয়ে আসছে। তিন মিনিটের আদিনাথ পঁয়তাল্লিশ মিনিট টিকে রয়েছে। একটুও ক্লান্তি ওকে ছুঁতে পারিনি। বেল বআজার কয়েক মুহূর্ত আগে আদিনাথ হঠাৎ আমার দিকে চাইল, তার অফগার্ড অবস্থা লক্ষ্য করে আসাদ ভাই সজোরে পাঞ্চ করলেন।আদিনাথের মুখে সজোরে ঘুষি লাগতেই আমি চোখ বুজে ফেললাম। চোখ খুলে আমার চোক্ষুচড়কগাছ। একি! আদিনাথ স্থির ঘুষি মুখে লাগলেও আদিনাথের চেহারা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই তার একটুও লেগেছে। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে আদিনাথ স্থির। বেল বাজতেই আদিনাথ হালকা হাসলেন। আসাদ ভাই ভীষণ অবাক। পয়েন্টে আসাদ ভাই জিতলেন। দর্শকের কোলাহল কমে এসেছে। দুজনের হাত মিলিয়ে রিং থেকে নামলেন।
ফাঁকা চেঞ্জিং রুমে আমি আর ভাইয়া এলাম আদিনাথ জল খাচ্ছে। আসাদ ভাই তাকে কি বলছে বোঝা গেল না। সে শুধু মাথা হেলাচ্ছে। আমাদের আসতে দেখেই আসাদ ভাই বললেন, "এ ছেলেতো কামাল প্লিয়ার আছে। "
ভাইয়া কিছু না বলে ফাইলটা আদিনাথের দিকে এগিয়ে দিল।
আসাদ ভাই আমাদের দুজনকে চেঞ্জ রুম থেকে বাইরে নিয়ে এসে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেল। ভাইয়া আমাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভাইয়ার ফোন এলো ভাইয়া বলল। গাড়ি আছে তুই ড্রাইভ করে চলে যা আমি একটু পর আসছি। রাতে একা ড্রাইভ করা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না। তাই রাজি হয়ে গেলাম। ভাইয়া চলে যেতেই মনে হলো আদিনাথকে বাইরে বেরতে দেখলাম না। হয়তো তার চোট লেগেছে, তখন সামলে নিলেও এখন হয়তো .....আজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল, দ্রুত চেঞ্জ রুমের দিকে পা বাড়ালাম।