তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ১২
(১২)
সৌমাভ ফিরল ১৫ দিন নয়, পাক্কা তিন সপ্তাহ পরে। ওকে একটা ফিল্ড ট্রেনিংয়েও যেতে হয়েছিল। আর একটা অসাধারণ ব্যাপার হয়েছে ওর সঙ্গে। দিল্লিতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে সৌমাভর জয়েনিংয়ের সময় যিনি ওর বস ছিলেন, সেই প্রমোদ মাথুর প্রমোশন পেয়ে পেয়ে এখন দিল্লিতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অনেক উঁচু পদে রয়েছেন। কয়েক মাস পরে ফরেস্টের ডেপুটি চিফ সেক্রেটারিও হয়ে যাবেন। কিন্তু সেটা বেশি দিনের জন্য নয়। ডিসেম্বরের শেষে তাঁর রিটায়ারমেন্ট। বরাবরই এই মানুষটার খুব প্রিয়পাত্র ছিল সৌমাভ। আরও একটা খবর পেল, ওর আর এক বস, জয়রাজনও এখন দিল্লিতেই। প্রমোদের পরে তিনিই ওই পোস্টে পদে বসবেন। তবে তাঁর মেয়াদ থাকবে তিন বছর। দু’জনেই সৌমাভকে আলাদা করে ডেকে অনেক কথা বললেন। এমনকী জানালেন, কোনও অসুবিধা হলেই যেন সরাসরি তাঁদের জানায়। ওকে সব রকম ভাবে হেল্প করবেন তাঁরা। ও বিয়ে করছে শুনে খুব খুশি দুই প্রৌঢ় জোর করে কিছু উপহারও দিলেন।
এই গোটা সময়টায় চূড়ান্ত ব্যস্ত থাকলেও নিয়ম করে প্রতিদিনই রাতের দিকে ফোন করে কথা বলেছে ঈশিতা এবং ওর পরিবারের লোকেদের সঙ্গে। দিল্লি থেকে ঈশিতা এবং শ্বশুরবাড়ির সকলের জন্যই বিস্তর কেনাকাটা করেছিল ও। গুঞ্জার জন্যও আলাদা করে অনেক কিছু কিনেছিল। আর নিজের জন্য কিনেছিল একটা দামী টেপ রেকর্ডার। ওর ইচ্ছে, খুব ছোটবেলায় সন্তানরা কী রকম আদোআদো করে কথা বলে, সেগুলো রেকর্ড করে রাখবে। পরে অবসর সময়ে শুনবে। বড় হলে ওদেরও শোনাবে। তা ছাড়া সময় সুযোগ পেলে খালি গলায় নিজের গাওয়া কিছু গানও রেকর্ড করবে। এ সব ভেবেই একটু বেশি দাম দিয়ে জিনিসটা কিনেছিল। টাকা-পয়সা নিয়ে সে রকম ভাবনা ওর চাকরি পাওয়ার পর থেকেই ছিল না। ছ’বছরের বেশি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরিতে বেশির ভাগ সময়টাই মেসে অথবা অফিসের কোয়ার্টারে কাটিয়েছে। খাবারও খেত প্রায় দিনই অফিস ক্যান্টিনে। জামাকাপড় ইত্যাদির শখ-শৌখিনতাও বিশেষ ছিল না কোনও দিনই। ফলে মাইনের টাকার বড় অংশই জমা করত নানা স্কিমে। বিয়ের পরেও সেটা বিশেষ বদলায়নি। পাশাপাশি কয়েক মাস আগের পে কমিশনের বাড়তি টাকা এবং নতুন প্রোমোশনের দরুন মাইনে বাড়ায় সৌমাভর টাকার অভাব অন্তত ছিল না। ফলে ওই কটা টাকা গায়ে লাগেনি।
কলকাতায় ফিরে আগে নিজের বাসায় ঢুকল। নিজের মালপত্র, নিজের জন্য কেনা রেকর্ডার-সহ বেশ কিছু জিনিস গুছিয়ে রেখে ২১ দিনের ধুলো সাফ করে ঘরদোর একটু গুছিয়ে রান্না করে খেয়ে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়িতে গেল। এই তিন সপ্তাহে ঈশিতার অনেক বদল হয়েছে। পেট অনেকটাই উঁচু হয়েছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, সে মা হতে চলেছে। এখন হাঁটতে গেলে একটু অসুবিধা হচ্ছে। সৌমাভ দেখল, বাড়িতে শাড়ির বদলে এখন বিশাল ঢোলা জোব্বার মতো ম্যাক্সি পরিয়ে রাখা হচ্ছে তাকে। সবাইকে উপহার দিয়ে, গুঞ্জার জন্য আনা স্পেশ্যাল গিফ্টটা হাতে দিনে কানে কানে কী সব বলল, গুঞ্জা খিলখিল করে হেসে উঠল। তার পর চা-জলখাবার খেয়ে একবার ঈশিতার সঙ্গে ওর ঘরে গেল সৌমাভ। বহু মাস পরে বউয়ের পেটে আলতো করে হাত রেখে, তার পর ম্যাক্সির উপর দিয়েই পেটে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কিছু। তার পর দু’জনে মিলে কিছুক্ষণ গল্প করল। ইশিতা লক্ষ্য করল, সৌমাভর চোখেমুখে একটা প্রচন্ড ক্লান্তি, বিষন্নতা, চাপা কষ্ট যেন ছাপ ফেলেছে। দৃষ্টিতে যেন একটা শূন্যতা। আন্দামানের সেই ঝকঝকে ভাবটা একদম উধাও। শুধু তাই নয়, ওর সঙ্গে কথাও বলছে অনেক কম এবং সেটাও খুব মেপে মেপে। প্রশ্নগুলো মুখে এলেও করতে পারল না ঈশিতা, কারণ ও জানে, এ সবের জন্য ও নিজেই নব্বই ভাগ দায়ী। এই মানুষটাকে ফের একাকীত্বে ডুবিয়ে দিয়েছে ও নিজেই।
এর কয়েক দিন পরে ছিল ঈশিতার জন্মদিন। বিয়ের পরে প্রথম জন্মদিন, কিন্তু ওর শরীরের কথা ভেবে কতটা কী করা হবে, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন সকলে। কিন্তু সবাইকে এমনকি ঈশিতাকেও চমকে দিয়ে ওর জন্মদিনের দিন ভোরবেলা এসে ওকে ঘুম থেকে তুলে প্রথম উইশটা করল সৌমাভই। তার পরে হাতে হাজার তিনেক টাকা দিল। গুঞ্জাকেও অনেক আদর করল। তাকেও খামে করে বেশ কিছু টাকা দিল। এ নিয়ে সবাই আপত্তি করলেও সৌমাভ তাতে কানই দিল না। তার পরে বাড়িতে সবার সঙ্গে কথা বলে একটু জল-মিস্টি খেয়ে অফিসে চলে গেল। রাতে খাবার জন্য বাড়ির সকলে ওকে আসতে বললেও ও মুচকি হেসে জানাল, কাজের চাপ আছে, তাই আসতে পারবে না। ঈশিতা ফের বুঝল, নিজেকে অনেক গুটিয়ে নিয়েছে সৌমাভ। এ সেই আগের চেনা লোকটা নয়।
এর দিন কয়েক বাদে গুঞ্জার মাধ্যমিকে রেজাল্ট বেরোল। স্টার পেয়েছে শুধু না, কলেজেও ফার্স্ট হয়েছে! যে মেয়ে বরাবর সায়েন্স গ্রুপে দারুণ নম্বর পেত, এত ভাল রেজাল্টের পরেও সে বাড়ির লোকেদের অবাক করে দিয়ে জানাল, ও জিয়োগ্রাফি নিয়ে পড়বে এবং নিজের কলেজেই পড়বে। ও নিজের কলেজেই অ্যাডমিশন নিল। এরই মধ্যে আবার অসুস্থ হলেন ওদের দাদু। যমেমানুষে দিন কয়েক টানাটানি করে তিনি গত হলেন। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঈশিতার উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোল। ভাল ভাবেই পাশ করেছে ও। শোকের বাড়িতেও ওর রেজাল্টে বেশ আনন্দের হাওয়া বইল। শ্রাদ্ধশান্তি মেটার পরে ওর কলেজে ভর্তির বিষয়টা নিয়ে কথা হল। সেই সঙ্গে ঠিক হল, ঈশিতার ডেলিভারির পরে ওদের রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলা হবে। পরের কয়েক দিন ধরে ওর দিদিরা নানা কলেজ থেকে ফর্ম তুলে আনল। সে সব ফিলাপ করে জমাও দেওয়া হল। সৌমাভ এর মধ্যে ফোন না করায় ওকে কেউ এ সব জানালই না। এমনকি ঈশিতাও না। যদিও ঈশিতার কাছে সৌমাভর অফিসের নম্বর দেওয়া ছিল প্রথম থেকেই। সেখান থেকেই নম্বর নিয়ে ঈশিতার মেজদি টুইন বেবির বিষয়টা সৌমাভকে জানিয়েছিল। কিন্তু ঈশিতা ওই নম্বরে আজ অবধি ফোন করেনি কখনও। লিস্ট বেরোলে দেখা গেল, নিজের পছন্দের কলেজেই বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছে ও। একদিন দুই দিদিকে সঙ্গে নিয়ে ট্যাক্সি করে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে ভর্তিও হয়ে এল। সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরল। সে দিন রাতে সৌমাভ ফোন করলে ওকে জানাল কথাটা। একটু অবাক হলেও সৌমাভ মুখে শুধু বলল, ‘‘বাহ, খুব ভাল খবর। ভাল করে পড়াশোনা করো, কেমন’’ বলেই ফোনটা রেখে দিল। ঈশিতা বুঝল, সৌমাভকে আগে থেকে এ নিয়ে কিছু না জানানোটা ওরই অন্যায় হয়েছে। যার ফলে মেঘ জমেছে ঈশান কোণে।
জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহেই আচমকা জল ভাঙায় ঈশিতাকে ভর্তি করতে হল চেনা ডাক্তারের নার্সিংহোমে। সেখানেই সিজার করা হল। প্রথমে ছেলে, তার পরে বিস্তর ঝামেলা পুইয়ে বের করা হল মেয়েকে। দু’জনের বয়সের ফারাক হয়ে গেল আড়াই মিনিটের। মেয়েকে বের করতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে গিয়েছিলেন সার্জন। কাগজে-কলমে তখন ঈশিতার বয়স ১৮ বছর আট মাস কয়েক দিন। মা এবং দুই সন্তানের কিছু জটিলতা দেখা দেওয়ায় দুই শিশু-সহ ঈশিতাকে আরও কয়েক দিন থাকতে হল নার্সিংহোমেই। বাড়ি ফিরলেও হাঁটাচলা, সিঁড়িভাঙা-সহ একগুচ্ছ নিষেধ চেপে গেল ওর উপরে। ঈশিতার কাজ হল, শুধু সময় করে দুটো বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো, নিজে খাওয়া এবং ঘুমনো।