তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ১৩

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-68445-post-5937197.html#pid5937197

🕰️ Posted on May 2, 2025 by ✍️ Choton (Profile)

🏷️ Tags:
📖 1233 words / 6 min read

Parent
ধেয়ানে আলোকরেখা এই সময়টায় সৌমাভর আরও একটা রূপ দেখল সকলে। ঈশিতা ভর্তির দিন থেকে প্রতিদিন সকালে স্নান করে একেবারে রেডি হয়ে নার্সিংহোমে ঢুঁ মেরেই অফিস চলে যেত। সেখানেই লাঞ্চ সারত। সন্ধ্যায় নার্সিংহোমে ঢুকে সব খবর নিয়ে বাসায় ফিরে কিছু খেয়ে ফের নার্সিংহোমে চলে আসত। সারা রাত থেকে ভোরের দিকে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে আবার অফিস। ডেলিভারির আগে-পরে মিলিয়ে টানা পাঁচ দিন ছুটি নিয়েছিল ও। সেই ক’দিনও নানা ছুতোয় বাইরে গিয়ে খেয়ে আসত দুপুরে এবং রাতে। দুই ছেলেমেয়েকে দেখে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল ৩০ বছরের তরুণ। এতদিন ওর নিজের বলতে কেউ ছিল না। আজ ওর নিজের রক্তের সম্পর্কের এক নয়, দু’দুজন মানুষ এসেছে পৃথিবীতে। নিজের ছেলেমেয়ের প্রথম নামকরণ ও নিজেই করল— ছেলের নাম কুট্টি, আর মেয়ের নাম দিল মুট্টি। ঈশিতার দুই দিদি এবং গুঞ্জা নাম দিল তুতান-পাতান। ছেলে তুতান, মেয়ে পাতান। ঈশিতার মা-বাবা এবং দুই দিদি বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিয়ে ভাল নাম রাখার সিদ্ধান্ত কার্যত একতরফা ভাবেই নিল— ছেলের সৌমদীপ এবং মেয়ের ঈশিকা। একটা জিনিস সবাই দেখল— দুই ভাইবোনেরই পিঠে একই আকারের দুটো ছোট্ট জরুল এবং একই জায়গায়। মেরুদণ্ডের মাঝামাঝি। ডাক্তার বললেন, যেহেতু যমজ, তাই একজনের থাকলে অন্য জনেরও থাকবে, এটা প্রায় স্বাভাবিক। যদিও বহু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও দেখা গেছে। ঈশিতা নার্সিংহোম থেকে ফিরলে সৌমাভর রুটিনে একটাই বদল হল। নিজের বাসা ছেড়ে টানা দু’মাস রাতে শ্বশুরবাড়িতেই থেকে গেল ও। অফিস থেকেই ডিনার করে আসত আগের মতো। আর ঈশিতার সঙ্গে একই ঘরে থাকলেও ওর বিছানা ছুঁতও না। আলাদা করে সোফায় শুত। ঈশিতা বিষয়টা প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে খেয়াল করে একদিন ওকে খাটে শুতে বলায় সৌমাভ মুচকি হেসে বলেছিল, ‘‘তোমার বিছানায় তুমি আরাম করে শোও। আমার অসুবিধা হবে না।’’ ওর বলার ভঙ্গি দেখে আর এ নিয়ে কথা বাড়ানোর সাহস হয়নি ঈশিতার। ও জানত, সৌমাভ ওই মুচকি হাসি দিয়েই অনেক কথা বলে দিয়েছে। বিশেষ করে ওর এ বাড়িতে প্রথম আসার দিনে ওই বিছানার তিক্ত অভিজ্ঞতা ও যে ভোলেনি, সেটা স্পষ্ট। তাই ‘‘তোমার বিছানায় তুমি আরাম করে শোও’’ কথাটা ওকে মনে করিয়ে দিল। ঈশিতা মাথা নামিয়ে নিল। সৌমাভর চোখে চোখ রাখার সাহসও হল না। কারণ ও জানে, সে রাতে ও সৌমাভকে ঠকিয়েছিল রাহুলের কথা ভাবতে গিয়ে। হাসপাতাল থেকে ফেরা অবধি ওর দিদিদের কথায় বাচ্চা দুটোকে রাখা হত বিছানার পাশেই একটা বড় মাপের কটে। রাতে বাচ্চাদুটো একসঙ্গে বা আলাদা করে কেঁদে উঠলে ঈশিতা ওঠার আগেই তাদের দু’জনকে একসঙ্গে কোলে তুলে দোল দিয়ে থামানোর চেষ্টা করত সৌমাভ। কোনও কারণে বেশির ভাগ সময় ওর এই কৌশল কাজেও দিত। ঈশিতা প্রায় দিনই ঘুমোত নিশ্চিন্তে। এমনকি পাশের ঘরে থাকা ঈশিতার মা-ও বেশির ভাগ দিন টেরই পেতেন না। একদিন এ সব নিয়ে সবাই মিলে সৌমাভর পিছনে লাগছিল। তার মধ্যেই হঠাৎ ঈশিতার বড়দি প্রশ্নটা করে ফেললেন— সৌমাভ কেন রোজই দুপুরে ও রাতে বাইরে থেকে খেয়ে আসে? আচমকা এমন প্রশ্নে বাড়িতে একটু অস্বস্তির পরিবেশ তৈরি হলেও সৌমাভ চুপ করেই রইল। কিছুই বলল না। রাতে ঘরে ঢুকে ঈশিতাও ওকে এ নিয়ে বেশ কড়া করেই কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিল। সৌমাভ চুপ করেই রইল। সে দিনও রুটিন মেনেই দুটো ছানাকে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াতে খাওয়াতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজে সোফায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। সে দিন হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল ঈশিতার। উঠে বসে দেখে, পাশের কটে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দুটো। কিন্তু সৌমাভ তো ঘরে নেই! বাথরুম থেকে ঘুরে ঘরে ঢুকে বোতল থেকে জল খেতে গিয়ে বহু দিন পরে আবার কানে এল সৌমাভর গলা। ‘‘...যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা, নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা....’’ আবার সেই ভরাট গলায় কোথায় যেন মিশে একটা করুণ সুর! ঈশিতার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সেই সঙ্গেই মনে পড়ল, সৌমাভ আর ওর সামনে বা ওকে পাশে নিয়ে গান গায় না। আন্দামান থেকে ফেরার পরে এই নিয়ে দু’দিন ও সৌমাভর গান শুনল। দু’বারই রাতের বেলায়, এবং দু’বারই ছাদে একা একা গাইছে সে গান! দুচোখে জল নিয়েই সোফার দিকে পাশ ফিরে বালিশে মাথা রাখল ঈশিতা। ওই অবস্থাতেই টের পেল, একটু পরে নিঃশব্দ পায়ে ঘরে ঢুকে সোফায় এসে শুল সৌমাভ। ঈশিতার চোখে পড়ল, কপালের উপরে হাত রেখে চুপ করে শুয়ে আছে সৌমাভ। রাস্তা থেকে চুঁইয়ে আসা আলোয় ওর যেন একবার মনে হল, সৌমাভর চোখের কোল থেকে জল গড়িয়ে আসছে! সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়ল ঈশিতা। এর মধ্যে দুর্গাপুজো এসে গেল। ঈশিতা এখন অনেক সুস্থ। কলেজেও যেতে শুরু করেছে। গোবলুগাবলু দুটো জ্যান্ত পুতুল নিয়ে বাড়িতে সারাদিন হইহই লেগেই আছে। গুঞ্জা তো সময় পেলেই চটকে দেয় দুটোকে। মা হলেও ঈশিতার একটু যেন বেশি টান ছেলে অর্থাৎ কুট্টির উপরে। বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় আগে কুট্টিকে কোলে নেয় ও। যদিও ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমনোর অভ্যাসটা ওর তৈরিই হয়নি। তবে এখন দু’জনকে কখনও সখনও একসঙ্গে কোলে নিয়ে হাঁটতে ওর বিশেষ অসুবিধা হয় না। সৌমাভর তো কোনও দিনই হয়নি, সেটা ও দেখেছে খেয়াল করে। ওর সেলাই কাটা হয়েছে অগস্টের প্রথম সপ্তাহেই। তার পর থেকে টানা একাধিক মলম এবং ঘরোয়া টোটকায় পেটের দাগ অনেকটাই হাল্কা হয়েছে। এর দিন সাতেক পর থেকে ডাক্তারের পরামর্শে টানা হাল্কা ব্যায়াম আর নিয়মিত হাঁটার ফলে ডেলিভারির সময়কার বাড়তি মেদ প্রায় সবটাই ঝরে গেল। পাশাপাশি প্রথম কয়েক সপ্তাহ কামাই হলেও ও এখন কলেজেও প্রায় নিয়মিত যায়। নতুন ক্লাস, কলেজের কয়েক জন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে যোগ হল নতুন বন্ধুবান্ধবও। সব মিলিয়ে ও যেন পুরনো জীবন ফিরে পেল। অল্প দিনের মধ্যেই ওর কথা বলার ভঙ্গি, সুন্দর গানের গলা, ভাল রেজাল্ট এবং নিজের ব্যবহারের গুনে ক্লাসেও বেশ জনপ্রিয়তা পেল। এখনও নিয়ম মতোই রোজ রাতে সৌমাভ অফিস থেকে চলে আসত ওদের বাড়িতে। একটা জিনিস ঈশিতা এবং ওর বাড়ির লোকেরা লক্ষ্য করল। এমনিতে সারাদিন যতই কান্নাকাটি করুক, বাবাকে দেখলে বা বাবার কোলে উঠলে একদম শান্ত হয়ে যায় দুই ভাইবোনে। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে। ঈশিতার মা বুঝলেন, রাতের পর রাত একসঙ্গে দু’জনকে কোলে নিয়ে বা কাঁধে নিয়ে সৌমাভ যে ঘুরত, আদর করত, ঘুম পাড়াত, এ তারই ফল। মায়ের থেকেও বাবাকে বেশি চিনে গেছে শিশুদুটো। তিনি মেয়েকেও বললেন সে কথা। সব শুনে দিদিরা বলল, নিজের ছেলেমেয়েকে অন্তত কোলে নিয়ে শোয়ার অভ্যাসটা এ বার তৈরি কর আস্তে আস্তে। ওই রকম শান্তি খুব কম মেলে রে, এ সুযোগ হারাস না। পুজো এল চলেও গেল। পুজোয় শ্বশুরবাড়ির সবার জন্য কী কিনবে ভেবে না পেয়ে ঈশিতার হাতে একগোছা টাকা ধরিয়ে বলল, প্লিজ তুমি সবার পছন্দমতো কিনে দিও, আমি এ সব তো বুঝি না। তবু ঈশিতা জোর করায় একদিন গিয়ে ওর জন্য দু’টো ম্যাক্সি কিনল একগাদা টাকা দিয়ে! ওর কেনাকাটার বহর দেখে সবাই খুব হাসাহাসি করল। পুজোয় ঘোরার জন্য ঈশিতা আর গুঞ্জার হাতে আলাদা করে টাকাও দিল। পুজোয় দু’দিন ও বাড়িতে গিয়ে ঈশিতা, দুটো বাচ্চা এবং গুঞ্জাকে নিয়ে বেশ কয়েকটা প্যান্ডেলে ঘুরল। টুকটাক খেলও সবাই মিলে। বাড়ির লোকেদের জন্যও খাবার কিনে আনল ওই দু’দিন। কলকাতার পুজো সেই অর্থে ওর এবারই প্রথম দেখা। তার পর পুজো মিটতেই সৌমাভ ফিরল পুরনো রুটিনে। অনেক দিন অফিসের কাজে ফাঁকি পড়েছে, এ বারে সব সেরে ফেলতে হবে। না হলে কপালে দুর্ভোগ আছে। ছেলেমেয়ের বয়স এখন তিন মাস প্রায়। ঠিক করল আর মাসখানেক বাদে ওদের নিয়ে বেলেঘাটার বাড়িতে ফিরবে। এই সময়টুকু বাপের বাড়ি থেকে কলেজ করলে ঈশিতা আরও একটু সুস্থ হয়ে উঠবে। তা ছাড়া কুট্টি-মুট্টিও একটু বড় হবে। পুজোর সময় থেকে দুই ভাইবোনের প্রচুর ছবি তুলতে শুরু করেছিল সৌমাভ। ঈশিতারও বেশ কিছু মুহূর্তের ছবি তুলে রেখেছিল। বেলেঘাটার বাসায় ফিরে সব গোছগাছ করে নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গেল। অফিসের বকেয়া প্রায় সব কাজই সেরে ফেলল হপ্তাখানেকের মধ্যে। প্রচন্ড ঠান্ডা মাথা, দ্রুত চিন্তা করার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং একাগ্রতা— এই তিনটে গুণই ওকে এত অল্প বয়সে অন্যদের তুলনায় উঁচু পদে বসিয়েছে। সেটা ও নষ্ট হতে দেবে না কোনও ভাবেই। এই সময়ে ওর পাঠানো দুটো প্রোজেক্ট রিপোর্ট দিল্লিতেও প্রশংসা পেল। প্রমোদ স্যার এবং জয়রাজন স্যার, দু’জনেই আলাদা করে ফোন করে বিস্তর প্রশংসা করলেন। মাথুর স্যার বললেন, ‘‘ডিসেম্বরের শেষে আমার রিটায়ারমেন্ট। এটা দেখে শান্তি পাচ্ছি, তুই অনেক দূর যাবি।’’ ফোন রাখার আগে আবারও পইপই করে যে কোনও দরকারে ফোন করার হুকুম অবধি জারি করলেন প্রৌঢ় আমলা। বললেন, ‘‘মনে রাখিস এটা আমার অর্ডার। তোর রিকোয়েস্ট প্রসেস করতে আমার বড়জোড় একঘণ্টা লাগবে, এটা তোকে বলে দিলাম। ভুলিস না।’’
Parent