তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ১৯

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-68445-post-5939304.html#pid5939304

🕰️ Posted on May 5, 2025 by ✍️ Choton (Profile)

🏷️ Tags:
📖 1801 words / 8 min read

Parent
(১৯) ভাঙল মিলনমেলা এমনিতেই সকালে উঠে জয়ন্তর খবরটা পেয়ে মনটা খারাপ ছিল। তার উপর আজ বেরোতে দেরি হয়েছে বলে একটু অস্বস্তিই হচ্ছিল সৌমাভর। বেলেঘাটা পেরিয়ে শিয়ালদা টপকে খেয়াল হল, সর্বনাশ! আসল দুটো ফাইলই তো স্টাডির টেবিলে ফেলে এসেছে! এখন কী হবে? দ্রুত ড্রাইভারকে গাড়ি ঘোরাতে বলল। যদিও ১টার মধ্যে ফাইল জমা দিলেই হবে, তবু ওর অভ্যাস একবার শেষ মুহূর্তে চোখ বোলানো। এ দিকে শালা জ্যাম। বিরক্ত লাগতে লাগল সৌমাভর। আজই শালা যত ঝামেলা! ঘড়িতে দেখল পৌনে এগারোটা। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে জ্যাম ঠেলে যখন বাড়ির নীচে নামল, তখন ১১টা। দ্রুত উপরে উঠে গেল ও। উপরে উঠে একটু দম নিয়ে চিন্তা করল। ঈশিতাকে ডাকবে? থাক, হয়তো ঘরের কাজ করছে বা রেস্ট নিচ্ছে ছেলেমেয়েকে নিয়ে। ওকে দেখে কেমন চমকে ওঠে ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে ইয়েল লকে চাবি ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকেই একটা কেমন অস্বস্তি লাগল যেন সৌমাভর। ফুলগুলো সেই খাবার টেবিলেই, বাচ্চাদুটো বাইরের ঘরে কটে শোনানো। কী হল! বেডরুমের দিকে এগোতে গিয়ে একটা ফিসফিসে গুঞ্জনের মতো আওয়াজে পা যেন জমে গেল সৌমাভর। ঘরে কেউ এসেছে। কে? একপা দুপা করে দরজার কাছে যেতেই ঈশিতার গলার ফিসফিসে কয়েকটা কথায় ওর শরীর কেঁপে উঠল। কে এসেছে? কী করছে ওরা ঘরের মধ্যে, যার আওয়ার বসার ঘরেও চুঁইয়ে আসছে? স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ইশিতার শীৎকার মেশানো কাকুতিমিনতি শুনল, ‘‘প্লিজ ওদুটোতে মুখ দিও না। আমার বাচ্চারা এখনও বুকের দুধ খায়। ওরা দুধ পাবে না।’’ একটা অস্পষ্ট পুরুষ গলা কী যেন বলল, তার পরে ফের ঈশিতার গলা পেল ও, ‘‘ও মাগো, অত জোরে টেনো না প্লিজ রাহুল, উফফফ, লাগছে তো! ইসসস এ ভাবে কেউ দুধ খায়? বোঁটায় দাগ ফেলে দিও না প্লিজ। বাবারে বাবা, যেন ডাকাত! এই, বুকে দাগ করে দিও না প্লিজ। আজ এ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে, রাতে আমার বরের চোখে পড়লে খুব লজ্জায় পড়ে যাব গো, প্লিজ এই কথাটা শোনো। আবার ওই নোংরা জায়গায় মুখ দিচ্ছ কেন, ওমাগো মরে গেলাম গো, ইশশশশ। কী করছে দেখো!’’ আর তার পরেই ‘‘আরে, ম্যাক্সিটা ছিঁড়লে কেন? এটা একদম নতুন। আমার বর এবারই পুজোয় এটা কিনে দিয়েছে। ইস, এবার কী বলব জিজ্ঞাসা করলে? আরে কী করছ?’’ ঈশিতার শীৎকার আর গোঙ্গানি মেশানো স্বরে বলা কথাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে একবার রাহুল কথাটা কানে আসতেই সম্বিত ফিরল সৌমাভর। দেখল ওর পায়ের কাছে এসে পড়েছে ঈশিতার একটা ম্যাক্সি, যেটা এবারই পুজোর সময় একদিন ঈশিতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়ে ও কিনে দিয়েছিল। সেটা যে গা থেকে টেনেছিঁড়ে খোলা হয়েছে, সেটা ও কয়েক মুহূর্ত আগের একটা ফড়ফড় আওয়াজে বুঝেছিল। এখন সেটা ওর পায়ের কাছে! এই তাহলে ঈশিতার সেই রাহুল! কথার ভঙ্গিতে বোঝাই যাচ্ছে, ওর পুরনো প্রেমিক শুধু না, আরও অনেক কিছু! বরাবরই দ্রুত চিন্তা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ওস্তাদ সৌমাভ এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ও ঘর থেকে ঈশিতার গোঙানি আর শীৎকার তখন গোটা বাড়িতে যেন ছড়িয়ে পড়ছে। দ্রুত স্টাডিতে ঢুকে প্রথমেই দিল্লি থেকে কেনা সোনির সেই টেপ রেকর্ডারটায় একটা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট ঢুকিয়ে সেটা অন করে শোওয়ার ঘরের দরজার আড়ালে বসিয়ে দিল। ওটা কিনেছিল ছেলেমেয়ের ছোটবেলার আদোআদো কথাগুলো রেকর্ড করবে বলে। সে সব তো হবে না, এখন বরং ভিতরের লীলাখেলার আওয়াজ রেকর্ড হোক! ও ততক্ষণে কাজ গোছাবে। স্টাডিতে ঢুকে সব ফাইল এমনকি কাল রাতে গোছানো কাগজপত্র, ছবির অ্যালবাম, ড্রয়ার থেকে চেকবুক, ড্রয়ারে আজকের সন্ধ্যার অনুষ্ঠান এবং আরও নানা কারণে রাখা ব্যাঙ্ক থেকে তোলা নগদ হাজার দশেক টাকা— সব বের করে দ্রুত দুটো বড় বড় ট্রাভেল ব্যাগে ভরে নিল। তার পরে বাড়ির ফোনের তারটা কেটে দিল। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, বড় পাত্রে কুট্টি-মুট্টিদের দুধ করাই আছে। তার মানে আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল ওর! কিছু না ভেবে একটা বড় বোতলে পুরো দুধটা ভরে নিল। তার পর নিঃশব্দে বাইরে এসে বোতলটা ও ব্যাগদুটো নামিয়েই ফের বসার ঘরে ঢুকল। ভিতরের শোওয়ার ঘর থেকে তখনও ঈশিতার শীৎকার-গোঙ্গানি, আদুরে গলায় বলা কথা ভেসে আসছে নাগাড়ে। ওর কানে এল ঈশিতা বলছে, ‘‘আমি উপরে উঠে ঠাপাতে পারব না, উফফফ জেদ করছ কেন? আচ্ছা বাবা উঠছি। ইসসস, লাগছে তো’’ তার পরেই থ্যাপথ্যাপ শব্দ শুনে বুঝল, আন্দামানের দিনগুলো এখন এই ঘরে ফিরেছে। শুধু একটা চরিত্র বদলে সেখানে অন্য চরিত্র ঢুকে পড়েছে! তখন ফের ঈশিতার শীৎকার কানে এল ওর, ‘‘এত করে বললাম, সেই তুমি ভিতরে ফেললে? এ বার আমি কী করব? ঈস...না আমি জানি না কি ওষুধ খেতে হয়, ধুর বাবা। এ বার তো ছাড়ো, উফফ, আবার কী শুরু করলে, ও মাগো....’’। চোখে জল এসে গেল সৌমাভর! এত প্রতারণা! একবার ভাবল, বসে থেকে অপেক্ষা করে। লীলাখেলা সেরে বাইরে এলে না হয় হাতেনাতে ধরা যাবে। আর তখনই চোখে পড়ল, কুট্টি-মুট্টিদের কটের পাশেই সেই বড় বড় পুতুল দুটো না? মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদলাল। সোফায় পড়ে থাকা কুট্টি-মুট্টিদের দুটো জামা পুতুলদুটোর গায়ে পরিয়ে ওদের বুকে তুলে পুতুলদুটোকে একই ভঙ্গিতে কটে শুইয়ে দিয়ে, খাবার টেবিলের উপর থেকে বড় প্যাকেটে ভরা ফুলগুলো আর রান্নাঘর থেকে মাছগুলো ওই ফুলের প্যাকেটেই ভরে বেড়ালের পায়ে বাইরে এসে নিঃশব্দে দরজাটা টেনে দিতেই সেটা মৃদু দুটো কট কট আওয়াজ করে লক হয়ে গেল। দ্রুত পায়ে নীচে নেমে প্রথমেই তিনতলায় সিঁড়িতে একপাশে এমন ভাবে প্যাকেটগুলো রাখল, যাতে তা সকলের চোখে পড়ে। বিশেষ করে একই প্যাকেটের মধ্যে মাছ এবং ফুল দেখলে সবারই চোখে পড়বে, ও নিশ্চিত। তার পরে একতলার ওষুধের দোকানে গিয়ে পরের মাসের বাসাভাড়াটা খামে ভরে বাড়িওয়ালাকে আজই দিয়ে দিতে অনুরোধ করল। অত্যন্ত ভদ্র, শিক্ষিত এই তরুণকে বিলক্ষণ চেনে ওষুধের দোকানের ছেলেগুলো। তবে ওরা ঈশিতাকে চেনে না। দেখেইনি সে ভাবে। তার পর ওদের ফ্ল্যাটটার কয়েকটা বাড়ির পরে একটা নতুন ছোট চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে বিকেলের জন্য একগাদা খাবার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেওয়ার অর্ডার দিয়ে টাকা মিটিয়ে অফিসের গাড়িতে উঠে বসল সৌমভ। ও জানে, ঈশিতা এবং তার বাড়ির সকলেই, বিশেষ করে গুঞ্জা চিনা খাবার খেতে খুব ভালবাসে। সে কথা ভেবেই অর্ডারটা দিল ও। সৌমাভ জানে, আজ বিকেল থেকে কী হবে ওই ফ্ল্যাটে। বারবার ওর দু’চোখ ভরে উঠছে জলে। এ দিকে ওর কোলে দু’কাঁধে মাথা রেখে কুট্টি-মুট্টি তখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওরা জানেও না, ওদের বেডরুম থেকে বাইরের ঘরে এনে কটে শুইয়ে ওদের মা ভিতরের ঘরে কী করছিল। ও মনে মনে হিসাব করে নিল, ও বেড়িয়েছে ১০টায়। সম্ভবত তার ১০/১৫ মিনিট পরেই পুরনো প্রেমিককে ঘরে ঢুকিয়ে লীলাখেলায় মেতে উঠেছে ঈশিতা। দ্রুত অফিসের ফাইলগুলো একসঙ্গে করে বাঁধল। তার পরে ড্রাইভারকে বলল, ওকে উল্টোডাঙ্গায় নামিয়ে অফিসে গিয়ে বড়বাবুর হাতে ফাইলগুলো দিতে। ও পরে ফোন করে নেবে। ততক্ষণে ও ঠিক করে নিয়েছে, বেলুড়ে থাকাকালীন একটি পরিবারের সঙ্গে ওর খুব ঘনিষ্ঠতা চিল। তাঁদের ছেলেটি ওরই বয়সী প্রায়। ওঁরা এখন উল্টোডাঙ্গায় থাকেন। তাঁদের বাড়িতেই কুট্টি-মুট্টিকে কয়েক ঘন্টা রেখে কোনও একটা কারন দেখিয়ে ও নিজের কাজগুলো সারবে। সেই মতো দ্রুত উল্টোডাঙ্গা গিয়ে সেই বাড়িতে ঢুকে অনুরোধ করল, একজন গুরুতর অসুস্থ আত্মীয়ের জন্য ওদের বাড়ির সবাই আজ হাসপাতালে ব্যস্ত, সে কারণেই বাচ্চাদুটোকে যদি কয়েক ঘণ্টা দেখেন ওঁরা। অত্যন্ত খুশি মনে রাজি হলেন কর্তা-গিন্নি। ও এবার অফিসের গাড়ি ছেড়ে ড্রাইভারকে সব বুঝিয়ে কাছেই একটা এসটিডি বুথে ঢুকল। তখন প্রায় পৌনে বারোটা বাজে। সৌমাভ প্রথম ফোনটা করল প্রমোদস্যারকে। দ্রুত কিছু কথা বলে একঘণ্টার মধ্যে সব কাগজ প্রসেস করার জন্য অনুরোধ করল বিশেষ করে। প্রমোদবাবু বুঝলেন, এমন কিছু হয়েছে, যাতে আজই কলকাতা ছাড়তে মরিয়া সৌমাভ। উনি আশ্বাস দিলেন, ওর কথা মতো সব কাজ হবে এবং এক ঘণ্টার আগেই। যা বাকি থাকবে পরে ও যেন জয়রাজন স্যারকে ফোন করে করিয়ে দেয়। তবে উনি যতটা সম্ভব কাজ সেরে দেবেন রিটায়ারমেন্টের আগেই। এর পরে হাজরার অফিসে ফোন করে বড়বাবুকে জানিয়ে দিল, ফাইল ড্রাইভার পৌঁছে দেবে। দ্রুত বেরিয়ে আরও কয়েকটা জায়গায় ফোন করল। তার পর ব্যাঙ্কে গিয়ে আলাদা দুটো উইথড্রয়াল ফর্ম ফিলাপ করে সব মিলিয়ে পঞ্চাশহাজার টাকা তুলে নিল। আরও কিছু ফর্ম ফিলাপ করে কয়েকটা কাজ সেরে নিল। এ সব সারতে সারতে দেখল পৌনে একটা বাজে। এ বার দিল্লিতে ফের এসটিডি করতেই সুখবরটা পেয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। কুট্টি-মুট্টিদের জন্য বেবিফুড, বেশ কিছু জামাকাপড়, খেলনা, নিজের কিছু জামাপ্যান্ট, জুতো, টুকটাক ওষুধ কিনে একজন ট্রাভেল এজেন্টকে বেশি টাকা অফার করে প্লেনের টিকিট কেটে নিল। সাড়ে তিনটেয় ভুবনেশ্বরের প্লেন। উল্টোডাঙ্গা থেকে বেশিক্ষণ লাগবেও না দমদম যেতে। প্রমোদস্যারকে বলে ও নিজের পোস্টিং করিয়েছে বেশ ঘুরপথে। প্রথমে যাবে ওড়িশার বারিপদায়, জয়ন্ত পন্ডার বাড়িতে। ওর বহুদিনের বন্ধু এবং তিন বছর একসঙ্গে দিল্লিতে কাটিয়েছে ওরা। সেখানে দিন কয়েক থেকে কর্নাটকের ভদ্রায়। সেখানে একটা জায়গাকে রিজার্ভ ফরেস্ট করার জন্য সরকারি স্তরে কথা চলছে। কর্নাটক সরকার এবং কেন্দ্র দু’পক্ষই জায়গাটা নিয়ে এগোতে চাইছে। ও সেখানে বছরখানেক থাকবে, বাস্তব পরিস্থিতিটা খতিয়ে দেখে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাবে দিল্লিতে। তার পরে চলে আসবে নতুন তৈরি হওয়া তড়োবা বলে মহারাষ্ট্রের একটা ফরেস্টে। সেখানেই অন্তত বছর পাঁচেক থাকার ইচ্ছে ওর। তার মধ্যে ছেলেমেয়ে একটু বড় হবে, ওদের কলেজের ব্যাপারটাও দেখতে হবে। নিজের কাজের জায়গা এতটা ঘোরানোর একটাই কারণ, যাতে কোনও ভাবেই ওকে ঈশিতাদের বাড়ির কেউ আর ট্রেস করতে না পারে। নিজের থেকেও এখন কুট্টি-মুট্টিকে হারানোর ভয় ওর বেশি। একটা নাগাদ সেই ভদ্রলোকের বাড়িতে গেল। দেখল বাচ্চাদুটো জেগে উঠে কাঁদছে। নতুন লোক দেখে ভয় পেয়ে গেছে দু’জনেই। ওকে দেখেই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের খাওয়াল, নিজেও সামান্য খেল। ওর খিদেটাই যেন চলে গেছে। তার পরে সব মালপত্র, ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে একটা ট্যাক্সি চেপে বেড়িয়ে পড়ল। তার আগে অফিসে ফোন করে ওর জিম্মায় থাকা অফিসের জিনিসপত্র বিকেলে ফেরত আনার কথা জানিয়ে দিল। জানিয়ে দিল, ফোনের কানেকশন যেন আজই কেটে দেওয়া হয়, ও ওই বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে সামনের মাসেই। উল্টোডাঙ্গার বাড়ি থেকে বেরনোর আগে ওঁদের প্রণাম করল, একই সঙ্গে একটা মিথ্যেও বলল, বাধ্য হয়েই। জানাল, ও দিল্লিতে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছে। বউকে পরে নিয়ে আসবে। তা ছাড়া ওখানে ওর শালী থাকেন, ফলে সমস্যা হবে না। সব সেরে ও যখন বেরোল, তখন ১টা বেজে ১০। ট্যাক্সিতে চেপে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না বরাবরের শান্ত, মুখচোরা, জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আসা সৌমাভ। তবে নিজের দায়িত্ববোধ ভুলল না। বাগুইহাটির কাছে ট্যাক্সি থামিয়ে পরপর তিনটে ফোন করল। প্রথমটা ঈশিতার বাপের বাড়িতে। ঈশিতার মাকে তাড়াতাড়ি বেলেঘাটা যাওয়ার অনুরোধ করেই পরের ফোনটা করল ঈশিতার মেজদিকে এবং বড়দিকে। তাঁদেরও একই অনুরোধ করল। সকলেই জানালেন, খুব বেশি হলে ঘন্টাখানের মধ্যে তাঁরা পৌঁছে যাবেন বেলেঘাটার বাসায়। কয়েক মিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে ঢুকে কুট্টি-মুট্টিকে একটা বেঞ্চে শুইয়ে ওদের পাশে বসে অফিসের প্যাডের মাথাটা ছিঁড়ে চিঠি লিখতে বসল। এক ঘন্টা ধরে দীর্ঘ একটা চিঠিতে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় মনের অনেক কথা ঈশিতাকে শেষবারের মতো জানিয়ে দিল। কিছুক্ষণ আগে শোনা কথাগুলো তখনও ওর কানে গরম সিসের মতো লাগছে! সেই সঙ্গে মনে পড়ছে, আজ যেগুলো ও নিজে কানে শুনেছে, সেগুলোই ঈশিতার মুখ থেকে শোনা যেত আন্দামানে থাকার সময়। লিখল সবই। চিঠিটা শেষ করে সেটা খামে ভরে এয়ারপোর্টের পোস্ট অফিসের ডাকবাক্সে ফেলতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল, ওদের পাড়ারই এক পরিচিত মুখ এয়ারপোর্টের গেট থেকে বেড়িয়ে আসছেন। এই লোকটিকে ও চেনে, মাঝারি মাপের ব্যবসায়ী। পাড়ার দুর্গাপুজোয় মাতব্বড় হন এবং মোটা টাকা চাঁদা দেন। তবে সব সময়েই হাসিমুখে থাকেন। এঁকে দেখে ফের প্ল্যান বদলাল। ডাকবাক্সে ফেলার বদলে কুট্টি-মুট্টিকে আড়াল করে ওঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কোন বাড়িতে থাকে বলতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আপনাকে খুব ভাল করে চিনি। আপনি ফরেস্টে কাজ করেন না?’’ সৌমাভ হ্যাঁ বলে তাঁকে অনুরোধ করল, উনি যেন ফিরেই আগে ওদের বাড়িতে গিয়ে এই চিঠিটা ঈশিতার হাতে দেন। খুব দরকারি চিঠি এটা। প্রায় এক বছর ধরে পাড়ায় ভাড়াটে হিসেবে থাকা এই তরুণ ছেলেটির ব্যবহারে পাড়ায় মুখচেনা লোকেরা শুধু না, আরও অনেকেই ওকে পছন্দ করত। পরিচিত লোকটিও তার ব্যতিক্রম নন। উনি আশ্বাস দিলেন, আগে এই চিঠি ওদের বাড়িতে দিয়ে তবে নিজের বাড়িতে ফিরবেন। এর মধ্যেই প্লেনের ঘোষণা হয়ে গেল। ও বেশি টাকা দিয়ে এক সঙ্গে তিনটে টিকিট কেটেছিল, যাতে কুট্টি-মুট্টিকে নিয়ে বসতে অসুবিধা না হয়। যতই একঘন্টার জার্নি হোক, তবু ওদের যেন কষ্ট না হয়। প্লেনে উঠে জানলার ধারে গুছিয়ে বসল, পাশে নিল কুট্টি-মুট্টিকে। এয়ার হোস্টেসকে অনুরোধ করল, একটা পাতলা চাদর দিতে। একটু পরেই প্লেন ছাড়ল। দুচোখে জল নিয়ে শেষ বারের মতো এই শহরকে বিদায় জানাল সৌমাভ। পাশে দুটো সিটে তখন নিশ্চিন্তে চাদর গায়ে ঘুমোচ্ছে চার মাসের কুট্টি-মুট্টি, ওর নিজের রক্ত।
Parent