তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ২৩
(২৩)
আমার সত্য মিথ্যা সকলি
দীর্ঘ সময় ধরে চিঠিটা পড়ে অবশেষে থামল ঈশিতার মেজদি। তার পর কাগজগুলো টেবিলে রেখে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল। ওর কান্না দেখে ঈশিতার মা এবং বড়দিও ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ওঁরা সকলেই বুঝতে পেরেছেন, বড় দুই জামাইয়ের তুলনায় তাকে যে কিছুটা অবহেলা করা হত, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি সৌমাভর। বিশেষ করে ঈশিতার মা। লজ্জায় মাথা মাটিতে মিশিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তিনি বারবার। তার পরেই মেয়ের দিকে চোখ গেল তাঁর! পাথরের মতো বসে আছে ঈশিতা। চোখে শূন্য দৃষ্টি! ঠোঁটদুটো কাঁপছে! ওকে নাড়া দিয়ে একবার ডাকতেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ঈশিতা।
ঈশিতার জ্ঞান এল অনেক রাতে। তখন প্রায় ১১টা। চোখ মেলতেই দেখল, দুই দিদি পাশে বসে নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ও উঠে বসতে যেতেই দেখল, মাথাটা টলছে। সত্যি বলতে, সেই সকালে সৌমাভর বানিয়ে দেওয়া চিনেবাদাম-কাজু-কিসমিস-কারিপাতা মেশানো বড় একবাটি চিড়ের পোলাও বাদ দিলে সারাদিনে একগ্লাস নুন-চিনির জল এবং কয়েক ঢোক এমনি জল ছাড়া কিছুই পেটে ঢোকেনি। তার উপরে দুঘন্টা ধরে ওই উদ্দাম চোদনের ক্লান্তি এবং সবকিছু ছাপিয়ে সৌমাভ, কুট্টি-মুট্টিদের হারানোর শূন্যতা। ঈশিতার সারা শরীর ওই ভাবে টলে গেল দেখে আবার তাকে খানিকটা জোর করেই নুন-চিনির জল খাওয়ানো হল। কিন্তু ওর মা কোথায়? মেজদির দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে প্রশ্নটা করে জানতে পারল, কিছুক্ষণ আগে গুঞ্জাকে সঙ্গে করে এ বাড়িতে এসে বড় জামাইবাবু মাকে ও বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। দুই দিদিই ওকে যথেষ্ট শান্ত ভাবে অল্প কিছু হলেও মুখে দিতে বলল। ও গোটা কয়েক বিস্কুট আর জল ছাড়া কিছুই খেল না। ওকে সামান্য ধাতস্ত হতে দেখে মেজদি বলল, ‘‘এ বার সব ঘটনা খুলে বল। সব মানে সব। আন্দামান থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত। তবে তুই কিছু বলার আগে তোকে কয়েকটা কথা বলি। তুই তখন অজ্ঞান হয়ে ছিলি। তোর সারা শরীর জুড়ে নখ আর দাঁতের দাগেও স্পষ্ট, তুই কী করেছিস। তা ছাড়া ওই ক্যাসেটটা চালিয়ে তোর কীর্তিকলাপ আমি আর দিদি শুনেছি। ওটা তোরই গলা, কোনও সন্দেহ নেই। ওটায় প্রায় একঘন্টা রেকর্ড হয়েছে এবং সেখানে এটা স্পষ্ট, সৌমাভ চিঠিতে একটা কথা, একটা শব্দও মিথ্যে বলেনি। ও যে নিজেকে কেন ‘নকল বর’ এবং রাহুলকে তোর ‘আসল স্বামী’ বলেছে, সেটাও স্পষ্ট সব কিছুতে। এমনকি তুই ওই সময় কী কী শব্দ ব্যবহার করেছিস, যেগুলো সৌমাভ লিখেছে অনেক রেখেঢেকে, সেগুলোও শুনেছি। এটা মাথায় রেখে যদি সব সত্যি কথা বলিস, তা হলে তোর পাশে থেকে সৌমাভকে যে করেই হোক আর যেখান থেকেই হোক, আমরা খুঁজে আনার চেষ্টা করব। তুতান-পাতানকেও। তার পরে কী করে তুই তাদের কাছে যেতে পারবি বা কাছে টানতে পারবি, সংসার করতে পারবি কি না, সেসব তোর ব্যাপার। আর যদি রাহুলকে বিয়ে করার চিন্তা করিস, তা হলে এ সবের কোনও দরকারই হবে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের আর তুই দিদি বলবি না। জেনে রাখবি, তোর দুই দিদিই মরে গেছে। সব ঠান্ডা মাথায় ভেবে বল। এখন যা বলবি, সবটাই সত্যি বলিস। সৌমাভকে আন্দামানে যেমন মিথ্যে বলেছিলি, ঠকিয়েছিলি ইচ্ছে করে, সেটা এখন আর করিস না। তোর সব মিথ্যে, চিটিংবাজি, নোংরা চরিত্র, নোংরামি— সব ধরা পড়ে গেছে। তোর ছেঁড়া ম্যাক্সি, বিছানার দাগ, চাদর, গায়ের দাগ— বাড়ির সর্বত্র জুড়ে তোর নোংরামির চিহ্ন ছড়িয়ে আছে।’’ মেজদির কথায় ও বুঝতে পারল, ওর সারা শরীরের, ঘরের এবং ক্যাসেট শুনে ওর কীর্তিকলাপের ময়নাতদন্ত করে ফেলেছে দুই দিদি। ও কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে উঠে আর একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে এসে বসল। তার পর মুখ খুলল।
কলেজ লাইব্রেরির ঘটনারও আগে থেকে কলেজে টুয়েলভে ওঠার পর থেকেই রাহুলকে নিয়ে ওর এবং আরও অনেক মেয়ের ক্রাশ থেকে শুরু করে রাহুল কী করে বেড়াত, আজ সকালে সৌমাভ বেরিয়ে যাওয়ার পরে কী হয়েছে এমনকি রাহুল কী ভাবে ওকে খুঁজে পেয়েছে, রাহুল আসার পরে ওরা কী করেছে, কতবার করেছে, সে সময় ও কী কী বলেছিল, যাওয়ার আগে রাহুল কী বলে গেছে— সব স্বীকার করল। একটুও বাদ দিল না। এমনকি সৌমাভর সঙ্গে প্রথম শারীরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে প্রথমদিন কাঁকুরগাছির বাড়িতে রাতের বিছানায় ওর শীতলতা দেখে সৌমাভর ওর উপর থেকে উঠে যাওয়া, রাতে ছাদে একা একা গান গাওয়ার ঘটনা, পেটে সন্তান এসেছে জেনে সৌমাভর কান্না, এ বছর পরীক্ষা দিতে মানা করায় ও কী বলেছিল এবং বেলেঘাটা থেকে কাঁকুরগাছিতে যাওয়ার পর থেকে ও কী রকম ব্যবহার করেছে এবং সৌমাভ কী ভাবে দূরে দূরে সরে গেছে, এবং আরও যা যা হয়েছে বলে ও মনে করেছে বা বুঝেছে, এমনকি কাল রাতে বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতির কথা— কিচ্ছু লুকোল না। সৌমাভর গানের প্রতি ভালবাসা, গান নিয়ে পড়াশোনা, সৌমাভর অতীত, ছোটবেলা সবই বলল। দুই বড় দিদির কাছে এ ভাবে কথাগুলো বলতে একটুও লজ্জা পেল না ও। কারণ ওর এই সব অনুভূতিগুলো বিকেল থেকেই ভোঁতা হতে হতে এখন আর নেই। এমনকি প্রথম বিবাহবার্ষিকী তো বটেই, জন্মদিন ভুলে যাওয়ার ঘটনাও লুকোল না। টানা প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে দিয়ে তুলে আনল মণিমুক্তো, পাঁক-কাদা সবই।
মাথা নিচু করে টানা আড়াই ঘন্টা একমনে শুনে গেল দুই দিদি। তার পর ফের মুখ খুলল মেজদি। ‘‘তুই এই একটা বছর, আন্দামানে থাকতে থাকতে তো বটেই, কলকাতায় ফেরার পরে আরও বেশি করে সৌমাভকে ঠকিয়েছিস। ওর থেকে দূরে থাকবি বলেই পরীক্ষার ছুতোটা অমন আঁকড়ে ধরেছিলি আর সেই থেকে টানা ও বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলি। এমনকি ওকে নিয়ে প্রথম দিন একঘরে শোওয়ার সময় কি করেছিস, সেটাও তুই নিজে জানিস। স্বীকার করা না করা তোর ব্যাপার। এটা চিটিংবাজি শুধু না চূড়ান্ত নোংরামি। এবং সৌমাভ ঠিকই বলেছে, তুই ওকে আসলে কোনওদিনই ভালবাসিসনি। তুই ওকে ঠকিয়েছিলি রাহুলের সঙ্গে শুবি বলে, এই নোংরামিটা করবি বলেই। তোর মনের ভিতরে রাহুলের সঙ্গে শোয়ার ইচ্ছেটা এতই বেশি ছিল যে ওকে ফাঁকা বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দিয়েছিস! তা-ও এমন একটা দিনে, যে দিন সৌমাভর জন্মদিন এবং নিজেদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী ভুলে যাওয়াটা ধামাচাপা দিয়ে নিজেকে সতীসাবিত্রি প্রমাণ করতে সবাইকে ডেকে একটা অনুষ্ঠানের নাটক করেছিস। এত ভাল নাটক যে, সৌমাভকে দিয়ে সব কিনিয়েওছিস। তার পর রাহুলের সঙ্গে সৌমাভর বিছানাতেই শুয়ে দু’ঘন্টা ধরে....ছিঃ। আজ সৌমাভ বিষয়টা জানতে না পারলে এবং এটা না করলে তুই রাহুলের সঙ্গে আরও অনেক দিন এই ভাবেই নোংরামিটা করে যেতিস। সৌমাভ অফিস চলে গেলে রাহুলকে ফোন করে ডেকে সৌমাভর ঘরে, সৌমাভরই বিছানায় শুতিস, এই সব নোংরামি করে বেড়াতিস বাজারের বেশ্যাদের মতো।’’ ঈশিতা বুঝতে পারছে, মেজদি শুধু ওর শরীরের নখের দাগ বা কামড়ই খেয়াল করেনি, ওকে এখনও পুরো উলঙ্গ করে ফেলছে। যদিও ও সৌমাভকে প্রথমে সত্যিটা বলেনি ঠিকই, কিন্তু রাহুলের সঙ্গে বেশ্যাদের মতো শোবে বলে ওকে ঠকিয়েছে এবং আগামী দিনেও ওই সব করত— মেজদির এই কথাটা কিছুতেই মানতে চাইল না। মুখে না বললেও ঈশিতা নিজে জানে, ও সৌমাভর সঙ্গে অনেক অন্যায়, উপেক্ষা বা দোষ করলেও কখনওই সৌমাভর বদলে রাহুলকে পেতে চায়নি। ও সৌমাভকে কোনও দিনই ঠকাতে চায়নি। সুযোগ পেলে তার প্রমাণও দেবেই। কিন্তু এখন ওর এ সব কথা কেউই বিশ্বাস করবে না, কারণ ও সবার চোখে ধরা পড়ে গেছে। এবং সেটাও খুব নোংরা ও নগ্ন ভাবে।
এই বার মুখ খুলে বড়দি বলল, ‘‘অন্য যে কোনও সে রকম মেয়ে হলে, যার মধ্যে সংসার-স্বামী-সন্তানের প্রতি মিনিমাম ভালবাসা-শ্রদ্ধা থাকে, মিনিমাম সততা থাকে, যে চরিত্রের দিক থেকে বেশ্যা নয়, সে ওকে দরজা থেকেই লাথি মেরে তাড়িয়ে দিত। কিন্তু তুই ওকে বাধা তো দিসইনি, ওর সঙ্গে তালে তাল মিলিয়েছিস, এবং যে সব কথা ওই সময় বলেছিস, সেগুলো আমরা এত বছর বিয়ের পরেও বলতে লজ্জা পাই। সেসবই টেপে রেকর্ড হয়ে গেছে। সুতরাং তুই যদি দাবি করিস, গলাবাজি করে বলিস যে তুই সৌমাভকে ভালবেসেছিলি বা ভালবাসিস, সেটা ডাঁহা মিথ্যে কথা। সৌমাভ সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। আজ নিজে দেখেশুনে তোকে বরাবরের মতো মুক্ত করে দিয়ে গেছে। তবু বলছি, ও এ দেশেরই কোথাও না কোথাও তো চাকরি করবেই। ছেলেমেয়েকে ও কতটা ভালবাসে, তার প্রমাণ বহুবার মিলেছে। ওই জায়গাতেও ও তোর মতো নোংরা মন নিয়ে ওদের ঠকায়নি। তুই ছেলেমেয়েকে ঘর থেকে বাইরের ঘরে কটে শুইয়ে ভিতরে ওই সব নোংরামি করেছিস, এমনকি মা হয়েও ওই দুটো দুধের শিশুর জন্য রাখা বুকের দুধটাও নোংরামি করার সময় খাইয়ে দিয়েছিস! সৌমাভ এমন তো করতই না, করার কথাও যে ভাবত না, সেটা তুই নিজেই জানিস। তোর পেটে হলেও তুতান-পাতান ওর প্রাণ ছিল, তোর নয়। বাড়িশুদ্ধু সবার, এমনকি তোর কোলে উঠে টানা কাঁদলেও সৌমাভ এলেই কিন্তু ওরা শান্ত হয়ে যেত, ওর বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ত, এটা বহু বার তুই নিজেও দেখেছিস। কিন্তু তার পরেও নিজের ছেলেমেয়েকে বুকে জড়িয়ে ঘুমনোর থেকে রাহুলের নীচে শোয়া তোর বেশি প্রয়োজন ছিল, ইচ্ছা তো ছিলই। ওই দুই ছেলেমেয়ের জন্যই ওকে চাকরিটা করে যেতে হবে। তোর জামাইবাবুর অনেক চেনাজানা। মেজোরও কম লোক চেনা নয়। সারা দেশের বহু ট্রাভেল গাইড এবং এজেন্টকেও পার্সোনালি চেনে। ফলে দেশের যে কোনেই থাক, সৌমাভকে আজ না হোক কাল না হোক পরশু না হোক, একবছর পরে হলেও ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। সৌমাভর কয়েকটা ছবি তো ও বাড়ির অ্যালবামে আছে, সেখান থেকেই কপি করিয়ে দু-চার দিনের মধ্যে খোঁজ শুরু করতে হবে। কিন্তু এখন এ সব থাক। তুই আজ রাতেই এ বাড়িতে তালা দিয়ে ও বাড়িতে চল। তোর সব জিনিস গুছিয়ে নে। ওখানে কদিন ঠিকমতো খা, রেস্ট নে। শরীরটা ঠিক কর। কারণ খোঁজার কাজটায় তোকে বেশি খাটতে হবে, আমরা খবর দিয়ে, টাকা দিয়ে এমনকী সঙ্গে গিয়ে হেল্প করতে পারি, তার বেশি কিছু পারব না। আপাতত কলেজে যাওয়া, রাহুলের সঙ্গে বেশ্যাদের মতো শোয়া এ সব যদি পারিস, বন্ধ রাখ। তার পরে দেখি কী করা যায়।’’
ঈশিতা বুঝতে পারছে, সৌমাভর ওই চিঠি এবং ক্যাসেটে রাখা ওর কথাবার্তা একধাক্কায় ওকে স্রেফ মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে তাই নয়, নিজের দুই বড় দিদির কাছেও ওকে একটা সস্তার বেশ্যা বানিয়ে দিয়ে গেছে। অবশ্য ও নিজে বুঝতে পেরেছে, আজ ওর আচরণ বেশ্যাদের মতোই ছিল। সৌমাভকে ও ভালবাসে, ওর মুখ থেকে এই কথা এই মুহূর্তে তো বটেই, আগামী বহু বছরেও কেউ আর বিশ্বাসই করবে না। সকলের চোখে ও আজ থেকে একটা দেহস্বর্বস্ব মেয়ে ছাড়া আর কিছু নয়। তবু দুই দিদি যে ভাবে সবটুকু দিয়ে সৌমাভ এবং দুই ছেলেমেয়েকে খোঁজার আশ্বাস দিয়েছে, তাতে ওকে দাঁতে দাঁত চেপে এখন সব সহ্য করে যেতেই হবে। না হলে ওর একার পক্ষে এই ৮০-৮৫ কোটি লোকের দেশে ওদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। ও মাথা নিচু করে সব শুনল। তার পর ব্যাগের মধ্যে অল্প কয়েকটা কাপড়জামা আর বইপত্র নিয়ে নিল। তার পর দুই দিদির পা জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদল। তার পরে বলল, ‘‘তোমরা শুধু ওদের তিনজনকে এনে দাও, তোমরা যা বলবে আমি শুনব। আমার ছেলেমেয়ের দিব্যি দিচ্ছি।’’
এর পর মেজদি যেটা বলল, সেটা ওর ভিতর পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিল। মেজদি বলল, ‘‘বুঝলাম, এখন তুই সব, স-অব করতে রাজি। না হলে গোটা পরিবার, পরিজন, চেনাশোনা সবার কাছে তোর কী পরিচয় হবে, সেটা তুই বুঝে গেছিস। তবে তুই আরও একটা মিথ্যে বললি এবং সেটাও ছেলেমেয়ের দিব্যি দিয়ে, ভাব একবার! আসলে সৌমাভকে তো বটেই, তুই নিজের পেটের ছেলেমেয়েকেও ভালবাসিসনি কোনওদিন। না হলে ওদের খাবারটা নোংরামি করতে গিয়ে অন্যকে খাওয়াতে পারতিস না। ফালতু ফালতু এই মিথ্যে কথাটা না বললেই ভাল করতিস।’’ ঈশিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফের নিজের হয়ে সাফাই গাইতে গেলেই ওকে ঠাস করে একটা চড় মেরে থামিয়ে মেজদি বলল, ‘‘যাক, যেটা বলছিলাম, তোর আর একটা শাস্তি বাকি আছে। সেটা আমি দেব। সেটা হল, রাহুলের সঙ্গে তোর কুকীর্তির ফসলকে তোকেই পেটে ধরতে হবে, কিন্তু তার জন্ম তুই দিতে পারবি না। তার তিন-চার মাস হলে তুই নিজে গিয়ে অ্যাবরশন করাবি। মানে তোর নোংরামিতে জন্ম নেওয়া শিশুটাকে মা হিসেবে তুই নিজেই খুন করবি। আর ফর্ম ফিলাপ করবি স্বামীর জায়গায় রাহুলের নাম দিয়ে। ওটাই তোর নোংরামির প্রমাণ হয়ে থেকে যাবে চিরকাল। আমরা তোর সঙ্গে সে দিন যাব, কিন্তু তোর নোংরামি আর পাপের ওই ফলকে তুই নিজে মা হিসেবে খুন করবি, এটাই তোর শাস্তি। কোনও চালাকি করে ওটা আগে নষ্ট করার চেষ্টা করলে তোকে আমরা ছেড়ে তো দেবই না, কোনও হেল্পও করব না কোনও দিন। এমনকি সৌমাভর খোঁজ পেলেও তোকে জানাব না, এটা আমি আমার সন্তান, শাঁখা-সিঁদুরের দিব্যি দিয়ে বলে দিলাম তোকে!’’ কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মেজদি। পিছনে পিছনে গেল বড়দিও। নিজের দিদির মুখে এমন ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা শুনে গা শিউড়ে উঠল ঈশিতার। ও একটা খুনী হবে শেষ পর্যন্ত?
সে দিন বেশি রাতে দুই জামাইবাবু একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলেন। এগারো মাস আগে, এই বছরের জানুয়ারিতেই অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে উঠে এসেছিল এই ভাড়ার ফ্ল্যাটটায়। দু’জনে মিলে তাকে সাজিয়ে তুলেছিল প্রথম তিন-চার দিনের মধ্যে। কত কিছু কিনেছিল দু’জনে। কত শখের জিনিস! সৌমাভকে দেখিয়ে বেডশিট থেকে বেডকভার, জানলার পর্দা— সব ঈশিতা কিনত। সেই ঘর, সেই সংসার ছেড়ে মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঈশিতা রায়চৌধুরী, কয়েক ঘন্টা আগেও যার পরিচয় ছিল সিনিয়র ফরেস্ট সার্ভে অফিসার সৌমাভ সরকারের স্ত্রী এবং সৌমাভর দুই যমজ সন্তানের মা।