তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৩১
(৩১)
এবার বিদায়বেলার সুর
পরের দিন সকালে সৌমাভ উঠে দেখল, ওর কোলের মধ্যে দুটো খুদে! একটু অবাক হলেও দুটোকে জড়িয়ে মনে মনে অনেকটা আরাম পেল। ওদের জন্যই ওর সব কিছু। তার পর টুক করে বাথরুম ঘুরে একেবারে ফ্রেস হয়ে বাইরে এসে দুটোকে কোলে নিয়ে দেখল বাইরের ঘরে যেন দক্ষযজ্ঞ চলছে। ওকে দেখেই সুভদ্রা দৌড়ে গিয়ে চা নিয়ে এল, সঙ্গে পরোটা আর আলুভাজা। দুটো খুদেকে কোলে বসিয়ে খেতে খেতে নিজের মতো ভাবনায় ডুবে গেল ও। কাল রাতেই একসময় মনে এসেছিল ব্যাপারটা। দুই ছেলেমেয়ের নাম বদলের। ঈশিতাদের বাড়ির দেওয়া নাম না রেখে ও নিজের মতো নাম রাখবে। মনে মনে নামদুটোও ঠিক করে নিল— ছেলে অরণ্য এবং মেয়ে মৃত্তিকা। ডাকনাম জংলা এবং মাটি। এবং আর কারও সঙ্গে কথা না বলে নিজের মতো করে এই দুটো নামই ঠিক করে ফেলল। এ ব্যাপারে জয়তীকেও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পরে বেশ কয়েকটা ব্যাগ আর একটা বড় সুটকেস বেঁধেছেঁদে আরও দুকাপ চা নিয়ে সোফায় এসে বসে সৌমাভকে একটা কাপ ধরিয়ে জয়তী বলল, ‘‘আমি সুভদ্রাকে বলেছি। ও খুব খুশি। আর একটা কথা, ও পড়তে চায়, সেটা কি তুমি রাজি?’’ সৌমাভর কাছে ব্যাপারটা মেঘ না চাইতে জল। ও হিসেব করে দেখল, আপাতত তিন বছর দুই খুদে ঘরেই থাকবে। এই সময়টায় সুভদ্রাকে ও কিছুটা পড়াশোনা শিখিয়ে দিতে পারলে পরবর্তী কালে ও কাজে বেরোলেও সুভদ্রা ওদের পড়াশোনার ব্যাপারটা সামান্য হলেও হেল্প করতে পারবে। ও খুশি হয়েই বলল, ‘‘ও না বললেও ওকে আমি পড়াবই। আর ঠিকমতো না পারলে ওকে মারব, এটা বলে দিও।’’ বলে একবার একটু হেসেই গম্ভীর হয়ে গেল। জয়তী সেটা লক্ষ করে প্রশ্নটা করতেই খুব নিচু গলায় বলল, ‘‘উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারবে না জেনে খারাপ লেগেছিল, জানো। নিজের উদ্যোগে ঈশিতাকে কলকাতায় এনে সব ব্যবস্থা করেছিলাম। ভাবিনি পড়ার নাম করে আমাকে এভাবে ঠকাবে!’’ বলে চুপ করে গেল। জয়তীও আর ঘাঁটাল না ওর মন বুঝে। ও বুঝে গেছে, সৌমাভ যতই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, ঈশিতার নোংরামি আর ওকে ঠকানোটা মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না, পারবেও না কোনও দিন।
সেদিনটা ওদের গোছাগুছিতেই কেটে গেল। মাঝে সৌমাভকে সঙ্গে করে জয়তী ব্যাঙ্কে গিয়ে প্রায় সব টাকা তুলে নিল, সঙ্গে লকারের গয়নাও। টাকা কম নয়, জয়ন্তর মৃত্যুর পরে রাজ্য, কেন্দ্র এবং বিভিন্ন সংস্থার থেকে অনেক টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। প্লাস জয়ন্তর সঞ্চয়। বেশ কয়েক লাখ টাকা। জয়ন্ত ওখানেই ওকে বসিয়ে এমন ভাবে টাকাগুলো এমন ভাবে নানা পলিসিতে ফিক্সড করল, যাতে দেশের যে কোনও প্রান্ত থেকেই সেগুলো ভাঙানো যায়। আর হাজার পঞ্চাশ টাকা জয়তী হাতে রাখল। কখন কী কাজে লাগে। ও ঠিক করে নিয়েছে, কলকাতায় ফিরেই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে নেবে। লকারও নেবে। সব সারতে অনেক বেলা হয়ে গেল। খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েই বিকেলে সবাই মিলে বেরোল, বাজার করতে। অনেক কেনাকাটা করা হল। ওদিকে ট্রাভেলের অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ওরা অনেক কষ্টে একটা এসি ফার্স্টক্লাস পেয়েছে। টিকিটটা নিয়ে টাকা মিটিয়ে দিল। গাড়ির ব্যাপারেও কথা ফাইনাল করে টাকা মিটিয়ে দিল। তার পরে সবাই ঘরে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। সেই ফাঁকে সুভদ্রার সঙ্গে ভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে কিছু কথা বলল সৌমাভ। তার পর শুতে গেল।
পরদিন দুপুরে খেয়ে সব গুছিয়ে ওরা ভুবনেশ্বর বেরিয়ে গেল। এমনিই এখানে জয়তীর বিশেষ কেউ চেনাশোনা নেই, ফলে কাউকে সেভাবে বলার দরকার হল না। তবে তিন বছরের বাসা ছেড়ে যাওয়া, জয়ন্তর অপমৃত্যু, গত কয়েক দিনের আনন্দের রেশ— সব মিলিয়ে ওর মন খারাপ করে দিল। কিন্তু দ্রুত সামলে নিল। রাতে আটটার মধ্যে ভুবনেশ্বরে পৌঁছে গাড়িটা ছেড়ে দিল। তার পর একটা হোটেলে দুটো ঘর বুক করল। একটায় ও থাকবে, অন্যটায় জয়তী, সুভদ্রা এবং দুটো বাচ্চা। রাতে দেখা যাবে। হোটেলে আর কেউ ব্যাগ খোলাখুলি করল না। পরদিন ভোরে সৌমাভ বেরোবে পাঁচটায়, জয়তী সাড়ে পাঁচটায়। সৌমাভর ফ্লাইট সাতটায়, কিন্তু আগে গিয়ে অনেক হ্যাপা থাকে। জয়তী সোজা গিয়ে স্টেশনে উঠে ট্রেনে চেপে বসবে। সেই মতো রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল সবাই। বাচ্চাদুটোর জন্য গরম দুধ বানাতে হোটেলে অনুরোধ করলে ওরা রাজিও হল। সেই রাতে দুটো বাচ্চা আর সুভদ্রাকে নিয়ে জয়তী এক ঘরে শুল, অন্য ঘরে সৌমাভ।
ভোরে উঠে সবাই দ্রুত গোছগাছ সেরে নিল। তার পর জয়তী এক এক করে সুভদ্রাকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদল। কেঁদে ফেলল সুভদ্রাও। ওকে প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনে নিজের বড় দিদির মতো করে রেখেছিল জয়তী। তার পর কুট্টি-মুট্টিকেও অনেক আদর করল। শেষে সুভদ্রার সামনেই সৌমাভকে বুকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কাঁদল কিছুক্ষণ। হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে সৌমাভ জয়তীকে বলল, জানুয়ারির শেষ দিকে কুট্টি-মুট্টির মুখেভাত। ফলে ওকে আসতেই হবে। সেই মতো দু’তিন দিনের ছুটি ম্যানেজ করে প্লেনের টিকিট যেন কলকাতায় ফিরেই কেটে নেয়। এর পরে আর দেরি না করে আর একপ্রস্ত আদর করে ওরা নেমে গেল। জয়তী নিজের ব্যাগ নিয়ে নামবে এ বার, ওর গাড়িও এসে যাবে কিছুক্ষণ পরে।