তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৩২
(৩২)
আশায় বাঁধি বুক
অ্যাবর্শন করে ফেরার পথে ঈশিতার ওই কান্নায় মন খারাপ হয়েছিল ওর মেজদির। তিনি বাড়ি ফিরে সোজা নিজের বরকে ডেকে পাঠিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললেন। তার পর বড়দিকে এবং বড় জামাইবাবুকেও ডেকে নিয়ে চার জনে বিস্তর কথা হল। জানা গেল, সৌমাভর ওই ঘটনার দিন কয়েক পরেই দুই জামাইবাবু হাজরা অফিসে গেছিলেন, কিন্তু কোনও কাজের কাজ হয়নি। সৌমাভর খোঁজ কেউই দিতে পারেননি। বিস্তর ধরাধরি করে শুধু এটুকু জানা গেছে, সে দিন আচমকাই বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ দিল্লি থেকে ওর রিলিজ অর্ডার চেয়ে পাঠানো হয়। দিল্লির বিশেষ অর্ডারে একঘন্টার নোটিসে ও হাজরা অফিস থেকে রিলিজ পেয়েছে, তাও সেই অর্ডার সোজা দিল্লিতে গেছে। তবে একটুকু জানা গেছে, ও চাকরি ছাড়েনি। এর পরে আরও কয়েকটা জায়গায় ওঁরা খোঁজ নিয়েছেন, এমনকি দিল্লিতেও দু’দিনের জন্য গিয়েছিলেন দু’জনে মিলে। খুঁজে খুঁজে সৌমাভদের ফরেস্টের অফিসেও গিয়েছিলেন এমনকি দু’দিন প্রায় সারা সকাল-দুপুর-বিকেল সেই অফিসের নীচে অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু সৌমাভর খোঁজ পাননি। ওই সময় বহু দিন সবাই ঈশিতাকে নিয়ে, ওর নতুন জায়গায় ভর্তি ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত ছিল। তা ছাড়া দুই দিদির সংসারও রয়েছে। এর মধ্যেই জানুয়ারিতে বিশ্বজিৎবাবু আচমকা কাকদ্বীপে বদলি হয়ে চলে গেছেন। তাঁর সেই যাওয়াও বেশ নাটকীয়। সকালে সবাই যখন জলখাবার খেতে বসেছে, সে সময় নিজের একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে বেরনোর সময় সবাইকে চমকে দিয়ে শুধু স্ত্রীকে বলেছেন, ‘‘আমি অন্যত্র ট্রান্সফার হয়ে চলে যাচ্ছি। মরে গেলে তোমরা খবর পাবে, তুমি পেনশনও পাবে। সব ব্যবস্থা করা আছে। আর পারলে ওখানে গিয়ে নতুন করে আমার মুখ পুডি়য়ো না। বাকি কটা দিন একটু সম্মান, একটু শান্তি নিয়ে বাঁচতে দিও।’’ স্ত্রীর কান্না, মেয়েদের চোখের জল কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই ট্যাক্সিতে চেপে বসেছিলেন। তার পর থেকে মাসে একলাইনের একটি চিঠি আসে বাড়ির ঠিকানায়— ‘ভাল আছি’। ব্যাস, আর একটিও বাড়তি শব্দ থাকে না। ঈশিতা বোঝে, ওর জন্যই ওর নিজের সংসার তো বটেই, হাসিখুসিতে ভরা এই সংসারটাও ধ্বংস হতে বসেছে। মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলে।
ঈশিতার অ্যাবর্শনের দিন ওই কান্নার পরে সেদিন কথাবার্তার সময় দুই জামাইবাবু জানালেন তাঁরা কতদূর কি করেছেন। যদিও তাতে লাভ কিছু হয়নি। এ নিয়ে দুই দিদি মুখ ঝামটা দিলে চার জনে বেশ কিছুটা কথাকাটাকাটিও হল। ঠিক হল, পরের দিনই ফের হাজরা অফিসে গিয়ে একবার খোঁজ নেওয়া হবে। সেদিন ওর যে ড্রাইভার ছিল, তাকে যদি খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলে অনেক তথ্য মিলবে বলে আশাবাদী হলেন সবাই। আগের দিন বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও সেই ড্রাইভারকে ধরা যায়নি। পরের দিন সকাল ১১টা নাগাদ ছ’জনে মিলে হানা দিলেন হাজরা অফিসে। গুঞ্জাকে একরকম জোর করেই নিয়ে গেছিল মেজদি। কারণ ও বুঝে গেছিল, দু’জনের মধ্যে অন্য রকম কেমিস্ট্রি আছে। তাই আর গুঞ্জাও ওদের সঙ্গে গেলে হয়তো কোনও আলো দেখা যাবে।
হাজরা অফিসে পৌঁছে আলাদা করে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে দুই জামাইবাবু সেই ড্রাইভারের খোঁজ পেলেন। তাকে ডেকে তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বাবু সেদিন শিয়ালদা অবধি গিয়ে দুটো ফাইলের জন্য ফেরত গিয়েছিলেন বেলেঘাটায়। তখন ১১টা। তার পরে একগাদা ব্যাগ, ফাইল আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে নীচে নেমে ওকে উল্টোডাঙ্গা যেতে বলেছিল। সেখানে একটা বাড়িতে নেমে ওর হাতে কিছু টাকা আর একগাদা ফা্ইল নিয়ে বডবাবুকে দিতে বলেছিল। তবে বাবুকে সেদিন নিচে নামার পরে অন্যদিনের চেয়ে আলাদা লেগেছিল। বারবার দুহাতে বাচ্চাদুটোকে আঁকড়ে ধরছিল, এমনকি কয়েকবার নিজের মুখ ঢেকেও বসেছিল। কেন কে জানে। ও আর কিছু জানে না। ড্রাইভারকে অনেক অনুরোধ করার পরে সে জানাল, ও গলিটা চেনে, কিন্তু বাড়িতো চেনে না।
উল্টোডাঙ্গা? সেখানে কে থাকে? ঈশিতা কখনও উল্টোডাঙ্গায় ওর কেউ থাকে বলে শোনেনি। কথাটা মেজদিকে বলতেই সে পাল্টা বলে উঠল, ‘‘তুই? তুই ওর কিছু জানার চেষ্টাই কোনওদিন করিসনি। ফলে ওর কে কোথায় চেনাশোনা আছে, সে সব তুই কি করে জানবি? হুঁ! এ সব ফালতু ভান করা ছাড়।’’ ঈশিতাকে সবার সামনে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে গুঞ্জার হাত ধরে বলল, ‘‘সোনা বোন আমার, এখন রাগ করে থাকিস না। তোর সৌমদাকে খুঁজতেই হবে। তুই জানিস কিছু? উল্টোডাঙার কথা তোকে কোনওদিন কিছু বলেছে?’’ ঈশিতা বুঝল, স্ত্রী হিসেবে ওর যা দাবি, তার থেকেও যেন বেশি দাবি গুঞ্জার। কিন্তু গুঞ্জাও বলল, ও কোনওদিন এটা শোনেনি। এই বারে সবাই আতান্তরে পড়ল। গুঞ্জাকে বাইরে রেখে পাঁচ জনে আলাদা করে ফের ভিতরে ঢুকে নানা টেবিলে বসা লোকেদের কাছে সৌমাভ সরকারের খোঁজ নিতে লাগল। কিন্তু কেউই কিছু বলতে পারল না। জনাচারেক লোক জানালেন, আন্দামান থেকে এখানে এসে মাত্র ১১ মাস কাজ করেছিলেন। এই অফিসের অনেকের অনেক পেন্ডিং কাজও সৌমাভস্যার করে দিয়েছিলেন পুজোর পরে। কালীপুজোর সময় প্রচন্ড জ্বর হওয়ায় বেশ কয়েক দিন অফিস ছুটি নিয়েছিলেন, তবে পরে সেই সময়কার কাজও সেরে গেছেন।
কালীপুজোর সময় সৌমাভর প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল? ঈশিতা এখন আর অবাক হয় না বা কাঁদে না এ সব শুনে। তবে এই খবরটায় ওর চোখে জল এল। সেটা দেখে দুই জামাইবাবু ওকে নিয়ে নীচে এসে বললেন, ওঁরা দেখতে গেছিলেন বেলেঘাটায়। বোঝাই যাচ্ছিল, সৌমাভ প্রচন্ড অসুস্থ। কিন্তু অনেক অনুরোধ করার পরেও ও কাঁকুরগাছির বাড়িতে যেতে রাজি হয়নি, উল্টে ওঁদের অনুরোধ করেছিল কাউকে যেন না বলে! ঈশিতা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ওর মনে হল, জন্মদিনের দিন তো বটেই, তার পরেও কয়েকটা দিন জ্বরে প্রায় বেঁহুশ হয়ে একাএকা পড়েছিল সৌমাভ, কিন্তু কাউকে জানতে পর্যন্ত দেয়নি! ও যেন জানতে না পারে, সে কারণেই দুই জামাইবাবুকে ওই ভাবে বলেছিল বোধহয়! আর সে দিন ও কত আনন্দ করেছিল বাড়িতে! কিন্তু সৌমাভ কেন এল না, সে কথা ওর মনেই পড়েনি! ওই সময় টানা তিন-চার দিন সৌমাভ না আসার পরে ওর একটু উদ্বেগ হলেও দিন সাতেক পরে সৌমাভকে দেখে আর কিছু মনে হয়নি। দু’চোখে জল নিয়ে দেখল, এই প্রথম গুঞ্জার চোখেও জল। ওকে প্রশ্ন করে দিদিরা বুঝল, এই খবরটা গুঞ্জাকেও দেয়নি সৌমাভ। ওর ভয় ছিল, যদি গুঞ্জা বলে দেয়! ঈশিতা বুঝল, ভালবাসা তো দূর, ও সৌমাভর স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনি কোনওদিন। আন্দামানে তবু যেটুকু পেরেছিল, কলকাতায় পা দিয়ে সেটুকুও হেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিল নিজের খেয়ালখুশিতে!
ওরা চুপচাপ সবাই দাঁড়িয়ে এ বার কী করা যায় ভাবছে, এমন সময় ঈশিতার মনে হল উপর থেকে নীচে নামছেন এক মহিলা, যার মুখ যেন ওর খুব চেনা চেনা লাগছে! কোথায় যেন দেখেছে? ও দ্রুত হেঁটে মহিলার সামনে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘‘দিদি, আপনি কি এই অফিসেয কাজ করেন? মানে, আমার খুব চেনা লাগছে আপনাকে। আসলে...’’, কী বলবে বুঝতে পারছিল না ঈশিতা। ওর মনে হল, মহিলা ওর চেয়ে কিছুটা বড় তবে ওর দুই দিদির থেকে ছোট। সিঁথি সাদা, মানে হয়তো এখনও বিয়ে করেননি। মহিলা ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলে কলেজের নামটা বলতেই এবার ঈশিতার মনে পড়ল, আরে উচ্চমাধ্যমিকের সময় তো কে যেন বলেছিল, ওদের কলেজের জয়তীদির নাকি বিয়ে হয়েছে এক ফরেস্ট অফিসারের সঙ্গে! কিন্তু ওরা তো উড়িষ্যায় থাকত? তা হলে কি ডিভোর্স হয়ে গেছে? না হলে সিঁথিতে সিঁদুর নেই কেন? এই সব ভাবনার মধ্যেই জয়তী হেসে বলল, ‘‘তুই কি ঈশিতা?’’ এ বারে চমকে উঠল ছ’জনই! ঈশিতার নাম জানেন এই মহিলা? জয়তী খুব আস্তে করে বলল, ‘‘আমার হাজব্যান্ড জয়ন্ত গত বছর নভেম্বরে উড়িষ্যায় খুন হন। কাঠচোররা খুন করেছিল। তার পরে আমি এই চাকরিটা পাই, এখন এখানেই কাজ করি। জানুয়ারি থেকে। কিন্তু তুই এখানে কেন? চাকরি হয়েছে? আরে দারুণ ব্যাপার তো’’, বলে পিঠটা চাপড়ে দিল।
ঈশিতার মনে পড়ল, সেই সর্বনাশা শুক্রবার সকালে সৌমাভ একটা ফোন পেয়ে খুব আপসেট হয়ে পড়েছিল। ওকে বলেছিল, ‘‘আমার এক বন্ধুকে কাঠচোরেরা গুলি করে খুন করেছে।’’ সেই বন্ধুই কি জয়তীদির বর জয়ন্ত? ও প্রশ্নটা করেই ফেলল। বলল, ‘‘জয়ন্তদার কাছে সৌমাভ সরকার বলে কোনও বন্ধুর কথা শুনেছো?’’ এই বারে হেসে ফেলল জয়তী। বলল, ‘‘শুধু শুনেছি না, খুব ভাল করে চিনিও। তবে এখন কথা বলতে পারব না। এই আমার ঠিকানা, কাছেই একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। একাই থাকি। বিকেলে আয় কথা হবে।’’ বলে উপরে উঠে গেল।