তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৩৫
(৩৫)
ব্যথায় কথায় দিন চলে যায়
ঈশিতা বুঝতে পারছে, সৌমাভ বহু মাস ধরে ওর বদল লক্ষ্য করে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল একটু একটু করে। ও অনেক দেরিতে বুঝলেও সৌমাভকে কাছে টানার চেষ্টা বাপের বাড়িতে থাকার সময় তো বটেই, বেলেঘাটার বাসায় ফিরেও করেনি। অথচ রোজ প্রতিজ্ঞা করত নিজের কাছে। সেই সব প্রতিজ্ঞাগুলো কত ফাঁকা এবং অসাড় ছিল, আজ আবার জয়তীদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে জয়তীদিকে বা ওর ছোট বোন হিসেবে গুঞ্জাকেও এমন বহু মনের কথা বলেছে, যেগুলো আসলে স্ত্রী হিসেবে একমাত্র ওকেই বলার ছিল সৌমাভর। কিন্তু ও শুনতেই চায়নি। ও আসলে সৌমাভকে বোঝেইনি কোনও দিন, সেটা এখন ফের ওর নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ওর ভালবাসার ফাঁকিটা সেদিন রাহুলের সঙ্গে শোয়ার পরের নানা ঘটনায় ধরা পড়েছিল সবার কাছে, আজ জয়তীদি ফের ওকে সবার সামনে প্রায় ল্যাংটো করে দিল! ঈশিতা মাথা তুলতেই পারছিল না। মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছিল। ওর দুই দিদিরও অবস্থা একই।
নিজেকে একটু সামলে জয়তী বলল, ‘‘নভেম্বরের ফার্স্ট উইকে জয়ন্ত খুন হয়। আমি তখন পাগলের মতো সৌমাভদার খোঁজ করেছি। জানতাম, জয়ন্তর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সৌমাভদা। আন্দামানে চিঠি পাঠিয়েছি, সেটা ফেরত এসেছে। দিল্লিতে যোগাযোগ করেও পাইনি। তখন দিল্লি অফিসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলাম, যদি কোনও ভাবে ওকে খবর দেওয়া যায়। ঈশিতা, আমার বয়স বেশি না। তোর থেকে কিছুটা বড়। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছি। স্বামীর আদর-ভালবাসা সবই পেয়েছি। ভরা যৌবন। সৌমাভদাকে দেখে আমারও প্রচন্ড লোভ হয়েছিল, ইচ্ছে হয়েছিল কাছে পেতে। সব খুলে তার সামনেও গেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। বুঝেছিলাম, ওই পাথরে দাগ টানা যাবে না। তা ছাড়া তোকে কতটা ভালবাসত বা এখনও ভালবাসে, সেটা ওই তিন দিনে রাতের দিকে সৌমাভদার অজস্র গান শুনে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সম্পূর্ণ বাইরের লোক হয়ে যেটা বুঝেছিলাম, সেটা তুই কিন্তু কোনওদিনই বুঝিসনি? বোঝার চেষ্টাই করিসনি আসলে। আর তুই দাবি করছিস, তুই নাকি তার স্ত্রী? আমার আচরণে ওকে পাওয়ার জন্য অস্থিরতা বুঝে সৌমাভদা নিজের প্রভাব খাটিয়ে আমাকে তড়িঘড়ি কলকাতায় পাঠিয়ে দিল। অথচ আমার চাকরি পাওয়ার চিঠি এসেছিল বারিপদায়। সৌমাভদা কলকাতায় আমাকে পাঠিয়ে দেয়, কারণ এই শহরটা আমার কাছে নিরাপদ, আমার নিজের শহর। বহু চেনাজানা লোক আছে। এত ভাবতে পারে লোকটা! সৌমাভদা দেবতা রে, অন্তত আমার কাছে। যে লোকটা কোনও দিন কোনও নেশা করেনি, সে এখন দিনে তিন-চার প্যাকেট সিগারেট খায়! মদও ধরেছে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমোয় কম। সারাদিন কুট্টি-মুট্টিকে নিয়ে চিন্তা করে। আমি লোকটার সর্বনাশ টের পেয়েছি, তাই বলে ফেললাম। যদিও এ সবে তোর কিছুই যায় আসে না, তবু।’’ তার পরেই একটা কথা বলল জয়তী, ‘‘একটা কথা বলছি, অন্য ভাবে নিস না। জয়ন্তর কাছে শুনতাম, ও জঙ্গল, গাছ, মাটি খুব ভাল করে চিনত। সে কারণে বহু সময় জঙ্গলে সার্ভে করতে গিয়ে গাছের নড়াচড়া, মাটির গন্ধ, বাতাস শুঁকে বিপদের গন্ধও টের পেত। অনেকবারই এমন ঘটনা নাকি ঘটেছে। জয়ন্ত নিজে কতবার তার সাক্ষী। আমার শুনে বিশ্বাস হত না। কিন্তু তোর ঘটনা শোনার পরে অনেক ভেবে একদিন মনে হয়েছিল, ও হয়তো তোদের মধ্যেকার ভাঙনের গন্ধটা টের পেয়েছিল। না হলে সেদিনই কেন ফাইল ফেলে যাবে, কেন তোকে না ডেকে নিজেই গেট খুলে ঘরে ঢুকবে, কেনই বা তার আগের দিন অবধি তোকে ঠিক মতো ছোঁবেও না, কেনই বা তোর বাপের বাড়িতে কি একটা ঘটনার পরে তোর সঙ্গে ওই বাড়িতে বহু দিন এক ঘরে থাকলেও এক বিছানায় শোয়া তো দূর, বিছানাটাও নাকি ছুঁত না, কেনই বা নিজের শরীর খারাপের কথাটাও তোর কাছে গোপন রাখবে— অনেক প্রশ্ন জানিস। ও মনে হয় গন্ধ পেয়েছিল তুই ওকে ঠকাতে পারিস। তাই নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিল।’’ কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেশ কিছুক্ষণ নীরবে কাঁদল। গোটা ঘরের বাকি তিনটে লোক যেন পাথর তখন। এক সময় উঠে চোখ মুছে বাইরে দাঁড়ানো ঈশিতার দুই জামাইবাবু এবং গুঞ্জাকে নিজে হাত ধরে ঘরে ঢুকিয়ে আবার চা করে আনল।
সবাইকে চা-মিষ্টি দিয়ে নিজে ঈশিতার পিছনে দাঁড়িয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘‘কিছু মনে করিস না রে। তুই আমার ছোট বোনের মতো, অনেক কথা বলে ফেলেছি। রাগ-অভিমান সব এক হয়ে গিয়েছিল। ওই লোকটা, সত্যি করেই একটা ভগবান। ভগবানকে সবাই পায় না, অনেকে পেয়েও হারিয়ে ফেলে। তুই হারিয়ে ফেলেছিস। নিজের দোষে, নিজের শরীরের খিদেয়, নিজের কামনায় অন্ধ হয়ে। জানি তোর খারাপ লাগছে, কিন্তু লোকটাকে মনে হয় না তুই আর কখনও খুঁজে পাবি। পেলেও চিনতেও পারবি না। এমনকি নিজের ছেলেমেয়েদেরও চিনতে পারবি না হয়তো কোনও দিন। আজ আমার কথাগুলো তোর বা তোদের সবার খারাপ লেগেছে জানি, কিন্তু বিশ্বাস কর, এগুলো তোর জানা উচিত ছিল। আমি কুট্টি-মুট্টিকে নিয়ে সারাদিন থাকতাম, খেলা করতাম। দেখতাম সৌমাভদা একা মনে চুপ করে বসে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে। ভাল করে খেতও না। কত রাত অবধি জেগে থেকে একা একা কত গান গাইত। অথচ জয়ন্তর কাছে তো শুনতাম, কী ভীষণ মজা করত, হাসিঠাট্টা করা ছেলে। খুব কষ্ট পেয়েছি রে, তাই তোকে এ সব বললাম। মনে করিস না কিছু,’’ ওর চোখের জলে তখন ঈশিতার কাঁধ ভিজে গেছে। নিজেকে একটু সামলে জয়তী বলল, ‘‘প্রার্থনা করি, তুই যেন খুব শিগগিরই ওদের খুঁজে পাস। যে ভুল করেছিস, তার জন্য যেন আর কষ্ট পেতে না হয় তোদের। বিশেষ করে কুট্টি-মুট্টির জন্য খুব কষ্ট হয় রে। ওইটুকু দুটো শিশু, নিজেদের মাকেই পায় না!’’ বলে আবার কেঁদে ফেলল।
এতক্ষণ ধরে নীরব হয়ে থাকা ঈশিতার মেজ জামাইবাবু এ বার বললেন, ‘‘কিছু মনে করবেন না, আপনি অনেক কিছু জানেন। কিন্তু ও কোথায় আছে এখন বলতে পারেন? দরকারে আমরা সবাই যাব। ঈশিতা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে। সব ঠিক। আমরাও করেছি। আমরা সবাই মিলে ক্ষমা চেয়ে যে করেই হোক ওদের ফিরিয়ে আনব।’’ জয়তী একটু হেসে মাথা নেড়ে বলল, ‘‘কোথায় গেছে জানি না। বলেনি। হয়তো ভয় ছিল, যদি আপনাদের বলে দিই। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওর যোগাযোগ অনেক দূর। আমার মতো সাধারণ একজন ক্লার্কের পক্ষে সেটা জানা কঠিন। এমনকি আমাদের বড়বাবু অবধি জানেন না। কারণ ওর সবটাই কন্ট্রোল করে দিল্লি। ও যেখানে চাইবে, একঘন্টার মধ্যে চলে যেতে পারবে, এতটাই ওর ক্ষমতা।’’
বারবার সৌমাভ এবং কুট্টি-মুট্টির কথা শুনতে শুনতে নীরবে কেঁদেই যাচ্ছিল ঈশিতা। ও জানে, জয়তীদি যা বলেছে একটুও মিথ্যে না, ভুল তো নয়ই। ও বুঝতে পারছে, কুট্টি-মুট্টিকে আর কোনও দিন কোলে নেওয়া তো দূর, ও দেখলেও চিনতে পারবে না। নিজের সন্তানদেরই ও আর কোনওদিন কাছে পাবে না হয়তো। সৌমাভকেও কি পাবে? সৌমাভ সিগারেট খাচ্ছে? তা-ও এতগুলো করে? জয়তীর কথাগুলো ওর ভিতরটা তখন তোলপাড় করে দিচ্ছে। ও আর পারল না, চেয়ারে বসে বসেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
ঈশিতার এই অবস্থা দেখে চমকে গেল জয়তী। সৌমাভর কাছে অ্যালবামে দেখা ছবির থেকে অনেক বদলে গেছে ঈশিতা। চেহারা খারাপ হয়েছে, পোশাকও অতি সাধারণ বলতে যা বোঝায় তাই। শুধু কপালে সিঁদুর আর হাতে শাঁখা ছাড়া শরীরে একটা গয়নাও নেই। ও তাড়াতাড়ি করে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে ঈশিতার জ্ঞান ফেরাল। জ্ঞান ফিরতেই আচমকাই মাটিতে আছড়ে পড়ে জয়তীর পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ঈশিতা। বলতে লাগল, ‘‘একবার তুমি আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চল জয়তীদি, যা বলবে করব। আমি অন্যায় করেছি, ভুল করেছি। কিন্তু এ ভাবে আমার সব শেষ হলে আমি বাঁচব কী নিয়ে?’’ কথাগুলো বলতে বলতে হাঁফাতে লাগল ঈশিতা। জয়তীরও কান্না পেল খুব। ও নিচু হয়ে বসে ঈশিতাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলল, ‘‘তোর ভুলটা এত বড় আর সেটা লোকটার এমন জায়গায় আঘাত করেছে যে, সেটা আর বোধহয় ঠিক হবে না রে। আমি তোকে মিথ্যে আশা দিচ্ছি না, তবু বলছি, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব সৌমাভদাকে খুঁজে পেতে। তবে আজ-কাল-পরশু নয়, হয়তো দু’তিন বছর বা তারও অনেক বেশি সময় লেগে যেতে পারে। তবে চেষ্টা করব রে। ততদিন তোকে অপেক্ষা করতে হবে, ওটাই তোর প্রায়শ্চিত্ত। কী করবি বল? সবচেয়ে বড় কথা কি জানিস, তুই কলকাতায় ফিরে অবধি শুধু ওকে দিনের পর দিন উপেক্ষা করিসনি, স্ত্রী হিসেবে ওর প্রতি কোনও দায়িত্বই পালন করিসনি একদিনের জন্যও। অথচ তুই সবচেয়ে বেশি এবং সবচেয়ে ভাল করে জানতিস, তুই ছাড়া লোকটার নিজের কেউ নেই। একটা লোকও না। তা-ও কুট্টি-মুট্টি হওয়ার পরে তোকে নিয়ে তিনজন ছিলি ওর প্রাণ। সেই তুই সব জেনেও তার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন তো দূর, বন্ধুর দায়িত্বও পালন করিসনি। এমনকি ও অফিস বেড়িয়ে যাওয়ার পরেই রাহুলকে ঘরে ডেকে এত ভয়ঙ্কর নোংরামি করেছিস এবং সেটাও এমন কুৎসিৎ ভাবে, যে সে ধাক্কা সামলানো যে কারও পক্ষেই অসম্ভব। তোর নিজের ক্ষেত্রে হলেও তুই এই কাজই করতিস। তবু বাচ্চাদুটোর জন্যই আমি চেষ্টা করব। জানি না সৌমাভদার সঙ্গে যদি দেখা হয়ও, আমার কথা শুনবে কি না বা রাখবে কিনা। আমি তার বন্ধুর স্ত্রী, সেই বন্ধু আবার নিজেই মারা গেছে। ফলে আমার তো তার উপরে কোনও জোরই নেই। তবু তোকে বলছি, আমি চেষ্টা করব শুধু কুট্টি-মুট্টির জন্যই। আর একটা কথা, এর মাঝে যদি বিয়ে করিস, আমাকে একটি বার জানাস। তা হলে আর এই সব করার দরকার হবে না।’’ জয়তীর মুখে বিয়ের কথা শুনে ফের হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল ঈশিতা। বলল, ‘‘আমার সব কিছুর দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি সারাজীবন ওদের জন্য অপেক্ষা করব। আমি সব কিছু করতে রাজি। যা বলবে, সব। শুধু একবার ওদের এনে দাও।’’ জয়তী অনেক কষ্টে ওকে ঠান্ডা করে খোঁজ নেব বলে আশ্বাস দিয়ে ওদের বাড়ির ফোন নম্বর নিয়ে সবাইকে বাড়ি পাঠাল।
প্রায় দুঘন্টার বেশি সময় ধরে অফিসের ফোন থেকে করা এসটিডি কলটা ধরে রেখেছিল সৌমাভ। ঈশিতারা বেড়িয়ে যেতেই দরজা ভাল করে আটকে এ বারে রিসিভারটা তুলে প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠল জয়তী। কেঁদেও ফেলল। সৌমাভকে বলল, ‘‘শুনলে সব? বিশ্বাস করো, এই ঈশিতাকে দেখলে তুমিও চিনতে পারবে না! কঙ্কাল হয়ে গেছে ও! সাজপোশাক, চোখমুখ— সব কিছু দেখে ওকে চেনা কঠিন। এটা ঠিক ও অন্যায় করেছে, প্রথমে আমাকে মিথ্যেও বলেছে। কিন্তু এতবড় শাস্তিটা এ বার তুমি ভাবো প্লিজ সৌমদা, প্লিজ’’, বলতে বলতে কেঁদে ফেলল জয়তী।
ওপ্রান্তে বেশ কিছুক্ষণ পরে কথা বলল সৌমাভ। ওর গলাটা ধরা ধরা। শুধু বলল, ‘‘রাখছি। পরে কথা হবে। কাল সন্ধ্যায় ফোন করব।’’ জয়তী বুঝল, এতক্ষণ ধরে বলা সব কথা এবং ঘটনা-কান্নাকাটি শুনে হয়তো নিজেও চোখের জল ফেলেছে সৌমাভ। ওর কি মনে হল, ঈশিতাদের বাড়ির নম্বরে ফোন করল। ফোন ধরল গুঞ্জা। ও হ্যালো বলতেই গুঞ্জা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার পরে একটু সামলে ঈশিতাকে ডেকে দিল। জয়তী ওকে পরের দিন বিকেলে ওর ফ্ল্যাটে আসতে বলল। জয়তী ঠিক করে নিয়েছে, একবার শেষ চেষ্টা ও করবে।