তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৪১
(৪১)
মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই
ঈশিতার পা কাঁপছে থরথর করে। কুট্টি-মুট্টির বাবা মানে কি সৌমাভ? ওর স্বামী? ও কিছু ভাবতে পারছিল না। দাওয়া থেকে হেঁটে ঘরটার মধ্যে ঢুকতে যাবে, সেই সময় খুব চেনা একটা গলা ওকে যেন পাথর করে দিল। জয়তীদি? এখানে? জয়তী তখন বলে যাচ্ছে আপন মনেই যেন, ‘‘সেদিন ঈশিতাকে রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বাঁচানোর জন্য হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনেছিল। তার পরে ওর হাত ধরেই ওকে একটা দোকানে নিয়ে বসিয়েছিল। জলও দিয়েছিল। কিন্তু ঈশিতা ওকে চিনতেই পারেনি বুঝে ওখান থেকে সরে এসে একটু পরে আমাকে ফোন করে বলল, জয়তী, আমি একটা প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলাম না। আমি ঈশিতাকে আজ স্পর্শ করে ফেলেছি। আমি এই বার হেরে গেলাম গো। তার পরেই ফোনটা কেটে দেয়। আমি আর ফোনে পাই না। কুট্টিকে ফোন করি, নট রিচেবল। মুট্টির ফোনও তাই। একদিন পরে হাসপাতাল থেকে বন্ড দিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরে শুনলাম, আমাকে ফোনের একটু পরেই রাস্তার মধ্যে হার্টঅ্যাটাক হয়। ম্যাসিভ। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু ওখানকার লোকজন লোকাল হেল্থসেন্টার ঘুরে যখন হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ঈশিতা যে ওকে চিনতেই পারেনি, ওর স্পর্শও চিনতে পারেনি, এটা মেনে নিতে পারেনি সৌমদা। সে কারণেই এতবড় ধাক্কাটা আর সামলাতে পারল না।’’ তার পরেই গলায় একরাশ ব্যঙ্গ মেশানো জয়তীর গলা ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এল আবার, ‘‘কীরে! গিয়ে তো পেন্নাম করলি, প্রোগ্রামের মান বাঁচাতে বাপের ঢঙে গান করলি, বাপের ঢঙে গানের ইতিহাস বললি, কবিতা বললি, এমনকি মুট্টি তো প্রায় ১২ ঘন্টা এক ছাদের নীচেই রইল। কিন্তু সে কি তোদের চিনতে পারল? পারেনি। যে তোদের জন্মের পর থেকে সেভাবে ছুঁতই না, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত, তোদের জন্মের পর থেকে ভাল করে কোলে পর্যন্ত নিত না, নিজের ফিগার ঠিক রাখার জন্য বুকের দুধের বদলে তোদের কৌটোর দুধ খাওয়াত, সে তোদের ১৮ বছর পরে চিনতে পারবে, এমন পাগলামি তোদের মাথায় এল কী করে? কেন করতে গেলি এ সব ন্যাকামো? জানোয়ার কোথাকার! মাঝখান থেকে...’’ কথাটা শেষ করতে পারল না জয়তী। ওর কথাগুলো এবং এবারে ডুকড়ে ওঠা কান্না ততক্ষণে দাওয়ায় দাঁড়ানো ঈশিতা, গুঞ্জা, তার দুই দিদি-জামাইবাবু, এমনকি গুঞ্জার বরকেও যেন পাথর করে দিয়েছে।
ঈশিতা আর পারল না, ও এই বারে সব বুঝে গেছে। ওর চোখের সামনে যেন ১৮ বছর আগের সেই দিনটা ফিরে এল। সেদিনও সব শেষ হওয়ার পরে ও বুঝেছিল কী সর্বনাশ হয়ে গেছে! আজ তো সত্যি করেই সব শেষ হয়ে গেল! আজ ও সত্যি করে স্বামীহারা হল। ও নিজের ছেলেমেয়েকে চিনতে পর্যন্ত পারেনি? এমনকি ১৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া স্বামী ওর হাত ধরলেও ও বুঝতেই পারেনি? সেবারে ছিল কলেজের প্রোগ্রাম, এবারে নিজের কাজের জায়গার প্রোগ্রাম। সেবারে ছিল রাহুলের শরীরে শরীর মেলানোর উন্মত্ত কামনা, এবারে আবার বিয়ে করে শরীরের খিদে মেটানো এবং নতুন করে সংসারের চিন্তা— কি অদ্ভুত মিল! ও আর ভাবতে পারছিল না। চোখ দুটো ব্যথা করছে, অথচ কাঁদতেও পারছে না! ঈশিতা ওখানেই ধপ করে বসে পড়ল, তার পরে মাটিতে মাথা রেখে শুয়ে জ্ঞান হারাল।
এই সময় ঘরের মধ্যে কিছু ফিসফাস, গুঞ্জন কানে এল বাকিদের। সেটা থেমেও গেল। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বাইরে এল জয়তী। এসেই ওদের সবাইকে দেখে এবং ঈশিতাকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল। তার পর দ্রুত কুট্টি-মুট্টিকে ডেকে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে তুলে বসাল ঈশিতাকে। তার পর কুট্টি-মুট্টিকে ঘরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে বাবার কাছে থাকতে বলে ভাল করে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘‘হাজরায় আমার ফ্ল্যাটে পরপর দু’দিন তুই এসেছিলি। প্রথমদিন এদের সবাইকে নিয়ে। দ্বিতীয়দিন একা। সেদিন তোকে অনেক কথা বলেছিলাম। মনে কর, তোকে সেদিনই বলেছিলাম, কলকাতায় পা রেখে অবধি সৌমাভদাকে তুই এত অবহেলা আর উপেক্ষা করেছিস যে, সৌমাভদা ফিরে এসে তোকে কোনওদিন রাস্তায় হাত ধরলেও তুই বুঝতেই পারবি না। এমনকি নিজের ছেলেমেয়ের স্পর্শও তুই বুঝতে পারবি না। চলে যাওয়ার আগে তুই প্রায় চ্যালেঞ্জ করে আমাকে বলেছিলি, সারা জীবন অপেক্ষা করব ওদের জন্য! পেরেছিস তো সফল হতে? না পারিসনি? এবার বুঝতে পারছিস ঈশিতা, তোর ভালবাসা আসলে কতটা নাটক ছিল? কতটা নকল ছিল? যাক শুনলাম, তোর বোন, গুঞ্জা, যাকে সৌমাভ নিজের বোনের মতো ভালবাসত, সবচেয়ে বেশি বন্ধু ভাবত, সে তোর বিয়ে ঠিক করেছে? বাহ! গুড! কনগ্র্যাচুলেশনস। আর তো বিয়ে করার সমস্যা রইল না। এই ভয়ও রইল না যে সৌমাভদা হঠাৎ এসে হাজির হয়ে যাবে তোর বিয়ের আসরে বা তোর বিয়ের পরের সংসারে! এবার বিয়ে করে ফেল তোর ছোট বোনের অনেক খুঁজে আনা পাত্রকে। নেমন্তন্ন করিস কিন্তু। কুট্টি-মুট্টিকেও করিস। ওরা অন্তত মায়ের বিয়ে খেতে যাবে। অবশ্য মা ঠিক না, জন্ম দিয়েছিল যে মহিলা, তার বিয়ে। ওদের মা আলাদা।’’ প্রতিটি কথায় তীক্ষ্ণ শ্লেষ আর বিদ্রুপ মিশিয়ে একই সঙ্গে ঈশিতা ও গুঞ্জাকে বিঁধেই চলেছে জয়তী। একসময় চোখের কোন থেকে জলটা মুছে পাশ ফিরে হতভম্ব হয়ে থাকা গুঞ্জার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কীরে ঐশী, ওরফে গুঞ্জা, সৌমাভ সরকার তো মরে গেল, এবার তো দিদির বিয়ে দিতে তোর আর সমস্যা রইল না। আঙটি বদলও তো শুনলাম হয়ে গেছে তোর উদ্যোগে। তা দিদির বিয়েতে নেমন্তন্ন করবি তো আমাদের?’’
গুঞ্জা মুখ খোলার আগেই ওর গালে ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ল। মেজদি। দুচোখে আগুন আগুন জ্বলছে যেন। মেজদির এই চোখমুখ কোনওদিন দেখেনি গুঞ্জা। ১৭ বছর আগের এক রাতে ঈশিতা দেখেছিল। সেই গুঞ্জা বিয়ের এত বছর পরে বয়সে দ্বিগুণ বড় মেজদির চড় খেয়ে থমকে গেল। মেজদি থামল না। গনগনে গলায় বলে উঠল, ‘‘মিতুনের বিয়ে ঠিক করেছিস এমন ছেলের সঙ্গে যার মাসতুতো ভাইয়ের নাম রাহুল দুবে? বাহ। আর খুব অঙ্ক কষে দিনগুলো বেছেছিলি না তুই? কালীপুজো, অর্থাৎ সৌমাভর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন পরে, ভাইফোটার পরের দিনটায়। মিতুন ছাড়া সৌমাভ তোকেই একমাত্র বিশ্বাস করত, পরের দিকে মিতুনের থেকেও বেশি। তাই তোকে অনেক কিছু দিয়েছিল। এমনকি বিয়ের পরেও। তার পর থেকে আর দেয়নি। ও বুঝে গেছিল, তুইও মিতুনের মতোই হয়ে গেছিস। ও তোকে বোনের মতো দেখত। যদিও ওকে কোনওদিন ফোঁটা তো দিসইনি, জন্মদিনটাও মনে রাখিসনি ইচ্ছে করেই। তাই রাহুল দুবের সম্পর্কে ভাইয়ের সঙ্গেই মিতুনের বিয়ের পাকাদেখা করালি সেই দিনে, যেদিন সৌমাভ বরাবরের মতো সংসার ছেড়েছিল তোর দিদির নোংরামি দেখে! তোর সেদিনের জেদ আর ইচ্ছে দেখে আমার আর দিদির পাশাপাশি দুই জামাইবাবুরও খারাপ লেগেছিল। আমরা কেউ ভাবিনি তুই এমন করবি। মিতুন ওকে বিয়ের একমাস পরে পিঠে ছুরি মেরেছিল। তবু ও মরেনি। সেটা দেখে তুই মিতুনের মতই একই ভাবে একটু কায়দা করেই ওর পিঠে আরও একটা ছুরি মারলি, তাও ১৮ বছর অপেক্ষা করে? ভেবেছিলি সবাই ভুলে যাবে? সৌমাভর সেদিনের লেখা চিঠি আজও আমার আলমারিতে যত্ন করে রাখা আছে। সে কারণেই তোর সব চালাকি ধরা পড়ে গেছে আমাদের চার জনের কাছে।’’ গুঞ্জা এই সময় কিছু একটা বলতে যেতেই ফের একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে মেজদি বলল, ‘‘ওহ, মিতুনের জন্য যে পাত্রকে দেখেছিস, সে যে একটা বাড়ির উপরতলা কিনেছে, সেটা তো জানিস। যদিও ঠিক কেনেনি, ওকে ১ টাকার বিনিময়ে ৩৩ মাসের জন্য ভাড়া দিয়েছে বাড়ির মালিক। তবে জানিয়েছে, চাবিটা পরে দেবে ওর হাতে। মালিকের নামটা না জানলেও ও যে সেটায় থাকবে পরের প্রায় তিন বছর, সেটা তো জানিস? আবার মিথ্যে বলিস না যে জানি না। কারণ ও নিজেই বলেছে, ব্যাপারটা একমাত্র তোকেই বলেছে। তবে বাড়িটা ভাল, জানিস। বিশেষ করে মিতুনের খুব চেনা বাড়ি ওটা।’’
ঈশিতা এতক্ষণ চুপ করে কথাগুলো শুনছিল আর গুঞ্জার কথা ভাবছিল। সৌমাভ ওকে কী প্রচন্ড বিশ্বাস করত, ভালবাসত। অবশ্য ঈশিতাকেও বাসত। ঈশিতাই তার মর্যাদা দেয়নি, সেটা ও নিজে সবচেয়ে বেশি জানে। যদিও গত কয়েক বছরে ও প্রায় ভুলেই গেছিল, সৌমাভর সঙ্গে ও কি রকম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা করেছিল। কিন্তু গুঞ্জা? যে গুঞ্জা সৌমাভ চলে যাওয়ার পরে বহুদিন ওর সঙ্গে কথাই বলেনি, ওকে ঘেন্না করত রীতিমতো। একঘরে শুত পর্যন্ত না। তবে এখানে এসে বিয়ে করার পরে সেই তিক্ততাটা রাখেনি আর। সেই গুঞ্জা যে রাহুল দুবের সম্পর্কিত ভাইকে ওর জন্য পাত্র হিসেবে বেছেছে, এটা জেনে স্তম্ভিত হতেও ভুলে গেছিল ও। সেই রাহুল দুবে, যার জন্য ওর সংসার, সন্তান, স্বামী সব হারিয়ে গেছে বরাবরের মতো! কিন্তু কোন বাড়ির কথা বলছে মেজদি? ওর বুকটা কাঁপতে লাগল। এর মধ্যেই ওকে চমকে দিয়ে মেজদি বলল, ‘‘প্রথম দিন থেকেই তোর উৎসাহ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। পরে খোঁজখবর করে জানতে পারি, এই ছেলের প্রচুর পয়সা। এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে ভাল যোগাযোগ। একে ধরতে পারলে ডিপার্টমেন্টে উঁচু পদ পাবি, তাই একটুও দেরি করতে চাসনি, তাই না? শুধু তাই নয়, ও যে ফ্ল্যাটটা কিনেছে, সেটা কাল দেখে এলাম জানিস? ও প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, আসলে চাবিটা হাতে পায়নি তো। ওর ইচ্ছে ছিল, মিতুনকে বিয়ে করে একেবারে ওই ফ্ল্যাটটায় ঢুকবে, ওই বিছানায় ফুলশয্যাও করবে! কী ভাল বল! তা গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটটায় তালা। তালা মানে একেবারে সিল করা যাকে বলে। ডাবল ইয়েল লক, কোলাপসিবল গেট, সেটাতেও তালা। কোন বাড়িটা, কোন ফ্ল্যাটটা সেটাও বোধহয় তুই জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবি। যে ফ্ল্যাটে মিতুনকে নিয়ে কলকাতায় এসে প্রথম উঠেছিল আর এগারো মাস ধরে অনেক কিছু সহ্য করে শেষে নিজের বিছানায় মিতুনকে রাহুলের সঙ্গে চূড়ান্ত নোংরামি করা অবস্থায় ধরে ফেলে বরাবরের মতো ছেড়ে চলে গিয়েছিল সৌমাভ, সেই বাড়িটার সেই নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটাই তিন বছরের জন্য ও লিজ নিয়েছে, তাও সৌমাভরই কাছ থেকে! ওকে নিশ্চয়ই রাহুল দুবে ওই বাড়িটা দেখিয়ে ওটা কেনার বুদ্ধিটা দিয়েছিল। কিন্তু তোর দেখা পাত্র তো জানত না যে, চলে যাওয়ার পরের মাসেই ছেলেমেয়ের মুখেভাত দিতে কলকাতায় এসে ফ্ল্যাটটা সমেত গোটা বাড়িটা কিনে নিয়েছিল সৌমাভ। তার পরে তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটা পুরো সিল করে দিয়েছিল। তাই সৌমাভ যেদিন শুনেছিল মিতুন আবার বিয়ে করতে চলেছে, সেদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে যখন ছেলের পরিচয় জানতে পেরেছিল নানা উপায়ে, তখন ওকে বাড়িটা না, শুধু ওই ফ্ল্যাটটা ১ টাকার বিনিময়ে ৩৩ মাসের জন্য লিজ দিয়েছে। ভাল না?’’ বলেই জয়তীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘সৌমাভ তো তোকে সবই বলেছে, তাই চাবিটা গুঞ্জাকেই দিয়ে দে। তুই তো জানিস, ওই ফ্ল্যাটের একটা কুটোও নাড়ায়নি সৌমাভ, সেই একই অবস্থায় পড়ে আছে। এমনকি সেই খাটের চাদরটাও আছে, সেই ম্যাক্সিটাও আছে, এমনকি সোফাটাও নাড়ায়নি। দুধের বাটি, ছোট গ্যাস, ফ্রিজ, খাবার টেবিল— সব ক’টা জিনিস তেমনই আছে। সেই খাটেই মিতুন আবার শোবে, তবে এবার অন্য আর একটা ছেলের সঙ্গে! কী কপাল বল তো জয়ী?’’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল মেজদি। বড়দিও। দুই জামাইবাবু থমথমে মুখে বসে। আর সব কথা শুনতে শুনতে গুঞ্জার বরের চোখমুখ যে প্রচন্ড ভাবে বদলে গেছে, সেটা কেউই খেয়াল করেনি।