তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৪৪

🔗 Original Chapter Link: https://xossipy.com/thread-68445-post-5942481.html#pid5942481

🕰️ Posted on May 10, 2025 by ✍️ Choton (Profile)

🏷️ Tags:
📖 1235 words / 6 min read

Parent
(৪৪) প্রেম বলে যে যুগে যুগে     জয়তী বুঝল, ঈশিতা নিজেকে ফের সৌমাভ সরকারের স্ত্রী এবং কুট্টি-মুট্টির মা হিসেবেই পরিচিত করে তুলতে চাইছে। যেটা এত বছরে করেনি। ও চুপ করে পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে বলল, ‘‘ওদিকে চল, তোকে কয়েকটা জিনিস দেখাই।’’ বলে একটু এগিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাশাপাশি বিরাট তিনটে নিমগাছের একটার নিচে দাঁড়িয়ে ঈশিতাকে বলল, ‘‘উপরে গাছটার নাম লেখা আছে, পড়।’’ ঈশিতা উপরে তাকিয়ে ধাক্কা খেল, গাছটার গায়ে একটা টিনের বোর্ড তার দিয়ে আটকানো, তাতে লাল কালিতে লেখা ‘ঈশিতা’। চমকে উঠে জয়তীর দিকে তাকাতেই বলল, ‘‘এবার পাশের গাছ দুটো দেখ। পরপর গাছগুলো দেখ, বুঝতে পারবি।’’ ঈশিতা দেখল পাশাপাশি অন্য দুটো নিমগাছের গায়ে একই ভাবে তারে বাঁধা টিনের বোর্ডে ‘অরণ্য (কুট্টি), এবং মৃত্তিকা (মিট্টি) লেখা আছে। তার পরের দুটো আমগাছে সুভদ্রা এবং জয়তীর নাম লেখা। ও অবাক হয়ে তাকাতেই জয়তী একটু হেসে বলল, ‘‘ওই বাড়িটা সৌমদার পৈত্রিক বাড়ি। লাগোয়া কিছুটা জমিও। সৌমদা সেই চলে যাওয়ার পরের বছর জানুয়ারিতে ছেলেমেয়ের অন্নপ্রাশনের সময় কলকাতায় এসে কাজ মিটিয়ে ওদের আমার ফ্ল্যাটে আমার আর সুভদ্রার কাছে রেখে এখানে এসে বাড়িটা উদ্ধার করে। সারায়। সেই সঙ্গে আরও জমি কিনে পরপর পাঁচটা গাছ লাগায়। তখনই নামগুলো লিখে রেখেছিল। পরে যখনই আসত অনেক গাছ লাগাত। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার পরে এখানে প্রায়ই আসত। এবার নভেম্বরে এসে আর কলকাতায় ফেরেনি। একাই থাকত বেশির ভাগ সময় গাছগুলোকে নিয়ে। আমাদের অফিস, ছেলেমেয়ের কলেজ, আমার ছেলেটার কলেজ। সব মিলিয়ে আমরা বেশি আসতে পারতাম না। তবে ডিসেম্বরের ছুটিতে যখন সবাই মিলে আসি, তখন সৌমদা বোধহয় বুঝেছিল, সময় এসে গেছে। তখনই পঞ্চায়েত থেকে পার্মিশন করিয়ে নেয়, এই জমিতেই ওর দাহ হবে। আর একটা কথা বলেছিল, কষ্ট পাস না। ও গাছগুলো লাগানোর সময়েই ঠিক করে নিয়েছিল, ওর চিতা সাজানো হবে তোর নাম লেখা গাছটার কাঠ দিয়ে! সেই তখন থেকে ওই গাছটার শুকনো ডাল, ঝড়ে ভেঙে পড়া ডাল, পাতা, সব একজায়গায় রাখা আছে ওদিকে। আর এদিক ওদিক অন্য গাছগুলোর ডাল, পাতাও জড়ো করা আছে অন্য একটা জায়গায়। আর ওর ছাই কোথাও ভাসানো হবে না, এটা সবাইকে বলেছিল। তার বদলে তোর নাম লেখা গাছটার নিচে একটা বেদি মতো করে সব রাখা থাকবে। সৌমদা বলত, ‘‘মরার পরে অন্তত ঈশিতার কোলে শুয়ে থাকতে পারব, তাই এরকম ব্যবস্থা করে রেখেছি’’।’’ একটু পরে সৌমাভকে ঘর থেকে খুব যত্ন করে বাইরে আনল কুট্টি-মুট্টি-সুভদ্রা আর ঈশিতার দুই জামাইবাবু। যত্ন করেই শুইয়ে দেওয়া হল কাছের বিছানায়। গুঞ্জা বা তার বরকে কোথাও দেখা গেল না। সৌমাভর দেহটা বের করে আনার পরে ওর বিছানাটা তুলতে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেল ঈশিতা। ওর আর সৌমাভর একটা বিরাট ছবি। ল্যামিনেট করা! ওর মনে পড়ল, আন্দামানের একজন পরিচিত লোককে দিয়ে এই ছবিটা তুলিয়েছিল সৌমাভ। তখন ওদের প্রতিদিন সুখের ভেলা ভাসত। সেই ছবি? তাও সৌমাভর বিছানার নিচে? ও চোখ তুলতেই জয়তী একটু হেসে বলল, ‘‘সৌমাভদা বারিপদায় থাকতে থাকতে যখন তোর সব ছবি কেটে তোকে পাঠাতে ব্যস্ত, তখন এই ছবিটা আমি টুক করে সরিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। এটার কথা তোর অবশ্য মনেই নেই। সৌমদা অনেকদিন পর্যন্ত ছবিটার কথা বলত। ও ভেবেছিল ছবিটা ওই বেলেঘাটার ফ্ল্যাটেই কোথাও তাড়াহুড়োয় পড়ে গেছে। কলকাতায় আসার পরে একদিন ছবিটা দেখিয়ে বলি, এটার অনেকগুলো প্রিন্ট আমার কাছে আছে, ফলে নষ্ট কোরো না। ও যে ছবিটা এনলার্জ করিয়ে ল্যামিনেট করিয়ে নিজের বিছানার নীচে রেখেছিল, বিশ্বাস কর জানতাম না। সুভদ্রা হয়তো জানত। যাক চল, ওই কাঠের বিছানায় লোকটা শুয়ে। ওর পিঠের নিচে এই বিছানাটা দিয়ে দিই। তা হলে আর কষ্ট পাবে না বোধহয়’’, বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার পর একাই বিছানাটা গুটিয়ে  বেরিয়ে গেল। ১৯ বছর আগের একটা ছবি হাতে নিয়ে ঘরে তখন চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে ঈশিতা। হাসি হাসি মুখের ছবিটায় তখনও যেন জীবন্ত সৌমাভ, ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছে! ওর প্রতি সৌমাভর ভালবাসা কতটা ছিল, ছবিটা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ঈশিতাকে। একটু পরে দুচোখে জল নিয়েই কুট্টি-মুট্টি দু’জনে হাত মিলিয়ে বাবার মুখাগ্নি করল। ঈশিতার নাম লেখা নিম গাছের কাঠের চিতায় জ্বলে উঠল সৌমাভ সরকারের শরীর। তার পরেই কাঁদতে কাঁদতে সুভদ্রাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘‘মামন, তুমি আমাদের এই ভাবে ছেড়ে যেও না, বলে আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদল দু’জনেই অনেকক্ষণ ধরে। ওদের কান্না দেখে সুভদ্রাও খানিক কাঁদল, তার পর বলল, ‘‘তোদের ছেড়ে চলে যেতে গেলে তো আমাকেও মরে যেতে হয়। তাহলে মরে যাই?’’ বলে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল দু’জনকেই। একটু পরে সুভদ্রাকে ছেড়ে জয়তীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘‘তুমি ওই সল্টলেকের বাড়িটা বিক্রি করে এবাড়িতে চলে এস ভাইকে নিয়ে। কোনও কথা শুনব না, বলে দিলাম।’’ বলে জয়তীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঈশিতা, ওর দুই জামাইবাবু, বড়দি-মেজদির দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল, আপনারা একটু চা-মিষ্টি খান। ঈশিতাকে বলল, ‘‘ম্যাডাম, আপনারা সেই সকালে একটু মুড়ি খেয়েছেন। এবারে একটু চা-মিষ্টি খান ততক্ষণ’’, বলেই বুড়িদিদি বলে হাঁক পেরে ওদিকে চলে গেল। ম্যাডাম? নিজের মা জানতে পেরেও এখনও ম্যাডাম বলেই ডাকল? ঈশিতার আর সহ্য হল না। দৌড়ে দিয়ে জয়তীর বুকে আছড়ে পড়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘‘ওদের বল না জয়তীদি, একবার আমাকে মা বলে ডাকতে। আমি তো ওদের মা। আমি খারাপ, নষ্ট মেয়ে, তবু তো ওদের মা, বলো। একবার বলুক আমাকে মা বলে ডেকে। প্লিজ বলো না ওদের।’’ ঈশিতার আকুলতা বুঝল জয়তী, সুভদ্রাও। জয়তী ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘একদিনে বা একবারে হবে না। সময় লাগবে। ওরা দু’জনেই বিশেষ করে কুট্টি বাপের স্বভাব পেয়েছে। মুট্টিও অনেকটা তাই। ফলে সময় লাগবে। শান্তিনিকেতনে থেকে কলকাতায় কোনওদিন না দেখা ছেলেমেয়ের মুখে মা ডাক শোনা অসম্ভব। তোকে চাকরি তো ছাড়তেই হবে, সেই সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে সুভদ্রার ফ্ল্যাটে ওদের সঙ্গে ২৪ ঘন্টা থাকতে হবে। কী খায়, কী পরে, কখন খায়, কতটা খায়, কখন কলেজ যা, কী রং পছন্দ, কেমন খাবার ভালবাসে, কখন কলেজ থেকে ফেরে— সব জানতে হবে, শিখতে হবে, করতেও হবে। সুভদ্রাকেও সেই জমিটা ছাড়তে হবে তোকে, সেটা তোরা দু’জনে মিলে ঠিক করে নিস। তবে আবার বলছি, এতবছর যাকে মা হিসেবে জেনে মামন বলে ডেকেছে, যার কাছে কয়েক ঘন্টা আগেও চড় খেয়ে একটা শব্দও বলেনি, তাকে ওদের থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করিস না। সেটা করলে বরাবরের মতো হারাবি ওদের। সুভদ্রাকে বোন বল, সতীন বল, বন্ধু বল, যে ভাবে হোক মেনে নিয়েই তোকে ওর সঙ্গে একবাড়িতে থাকতে হবে। সেটা যদি পারিস, ওরা একসময় তোকে মা বলেই ডাকবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু যে ভুল, অন্যায় ওদের সঙ্গে এবং ওদের বাবার সঙ্গে এত বছর করেছিস, সেটা শোধরাতে গেলে এটুকু তোকে করতেই হবে। না হলে আশা ছেড়ে দে।’’ জয়তীর বুকে মাথা গুঁজে ঈশিতা বুঝল, একটুও ভুল বলছে না জয়তীদি। ও এবার জয়তীকে ছেড়ে সুভদ্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে বলল, ‘‘তুমিই ওদের মা, মামন, ওদের সব কিছু। তুমি আমাকে একবার সুযোগ দাও। যদি কোনওদিনও নিজের থেকে ওরা মা বলে ডাকে আমাকে, আমি মরেও শান্তি পাব। তুমি যা বলবে, করব, দেখে নিও। প্লিজ, বলে নিচু হয়ে ওর পা ধরতে গেল। সুভদ্রা তাড়াতাড়ি ওকে তুলে ধরে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘‘এখন কটা দিন এখানেই আমরা থাকব। কাজকর্ম মিটলে কলকাতায় ফিরব। তার মধ্যে তুমি সব গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলো। কুট্টিমুট্টির বাবা বিরাট বাড়ি করে দিয়েছে, ফলে থাকার সমস্যা নেই। শুধু এই বারে ওদের মা হওয়ার চেষ্টা করো। আমি কথা দিলাম, তোমাকে সবরকম ভাবে হেল্প করব। তবে সত্যিই অনেক সময় লাগবে। অনেক কথা শোনাবে তোমাকে, সব সহ্য করেই ওদের বুকে টেনে নিতে হবে তোমাকেই। আর চার মাস থেকে বুকে ধরে এত বড় করার পরে আমার পক্ষে ওদের ছেড়ে থাকা কঠিন নয়, অসম্ভব। তাই আমি ওদের কাছেই থাকব। তোমার ভয় নেই, আমি ওদের বা তোমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব না। এবার তুমি ঠিক কর। আমাকে ওদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে, দিদিও বলবে।’’ সৌমাভর দেহটা ছাই হয়ে গেলে কুট্টি এবং আরও কয়েকজন স্থানীয় লোক মিলে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা একটা ৬ ফুট বাই ৩ ফুট অগভীর গর্তে সব ঢেলে দিয়ে মাটি চাপা দিল। তার পর সেখানে অনেকগুলো ধুপ আর মোমবাতি জ্বালিয়ে কুট্টি পুকুরে নেমে স্নান করে নিল। মুট্টি বাথরুমে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে এসে বসল বাবার ঘরটায় তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে। দিদি-জামাইবাবুরা বললেন, ওঁরা আজ আর ফিরবেন না, কাল কালে চলে যাবেন, কাজের দিনে ফিরবেন। গুঞ্জাদের এর মধ্যে খোঁজ মিলল না। ওরা বুঝল, গুঞ্জারা ফিরে গেছে শান্তিনিকেতনে।
Parent