তার ছিঁড়ে গেছে কবে - অধ্যায় ৪৮
(৪৬)
‘কাছে তার যাই যদি’
সুভদ্রা যাওয়ার আগে কুট্টি-মুট্টির ঘর দুটো দেখিয়ে দিল। কুট্টি রাতে একাই শোয়, মুট্টি শোয় সুভদ্রার কাছে। পিসি, মানে জয়তী এলে ওরা তিনজনে একসঙ্গে শোয়। গত কয়েক বছর সেই সময়গুলো জয়তীর ছেলে কুট্টির সঙ্গে ঘুমোয়। সুভদ্রা জানাল, সেই প্রথম দিন থেকে দু’জনেই ওর কাছে শুত। ও কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে আসার পরে দুই ভাইবোন তাদের বাবার কাছে ঘুমোত। পরে সৌমাভ কলকাতায় চলে এলে ছেলেমেয়ের ১৫ বছর বয়স অবধি ওরা সুভদ্রার কাছেই ঘুমোত। এর মধ্যে জয়তীর ডিভোর্সের পরে ও সল্টলেকের বাড়িতে ছেলে নিয়ে চলে এলে প্রায়ই নিউটাউনের বাড়িতে রাতে চলে আসে। তখনই একদিন জয়তীর কথায় কুট্টির বিছানা আলাদা করে দেওয়া হয়। ১৮ হয়ে গেলে ঘরও আলাদা করে দেওয়া হয়। তবে এখনও সকালে ঘুম থেকে টেনে তোলার সময় কুট্টি বেশ কিছুক্ষণ তার মামনের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমের আমেজ কাটায়। মুট্টির অবশ্য এতটা আদর জোটে না। বেশির ভাগ দিন ঘুম থেকে উঠতে না চাইলে হয় মামন নয় দাদাই এসে চুলের মুঠি ধরে ওকে টেনে তোলে। পিসি অবশ্য খুব আদর করে তোলে। সে জন্য পিসিকেও কত মুখ করে সবাই, পিসি গায়েই মাখে না!
সুভদ্রার আপনমনে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনতে শুনতে ঈশিতা বুঝতে পারছিল, ওর হারানোর পাল্লাটা কত ভারী! নিজের ছেলেমেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে শোয়াটাও ওর সেভাবে প্রথম কয়েক দিনের পর থেকে আর হয়নি! খাওয়া বাদে বেশিরভাগ সময়ই কটে ঘুমোত ওরা। থাকতও অন্যদের কোলে কোলেই। আর সেদিন তো বাইরের ঘরের কটে শোয়ানো অবস্থাতেই ওর নোংরামি টের পেয়ে দু’জনকে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল সৌমাভ। ছেলেমেয়েগুলোর জায়গা হয়েছিল জয়তীর বাড়িতে কোথাকার কোন অচেনা, অজানা, এক আদিবাসী মেয়ের কোলে। সেই মেয়েই আজ ওদের মা, মামন। তার কাছেই ওদের সব আব্দার, শাসন। সেটা আজও চলছে। ওর কোল সেদিনও শূন্য ছিল, আজও শূন্যই আছে! আজ এতগুলো বছর!
সুভদ্রা কথাগুলো বলে চলে গেলে দুচোখ ছাপানো জল আর বুকের মধ্যে অনন্ত ধুকপুকুনি নিয়ে কুট্টির ঘরের দরজা খুলে ঢুকল ঈশিতা। খাটের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। অবিকল যেন সৌমাভ! ওর মনে পড়ল, আন্দামানে ওরা প্রথম শরীরি মিলনের দিন থেকে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে শুত। কলকাতায় আসার প্রথম দিন থেকে সেটা সেই যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর কোনওদিন হয়নি। আর তো হবেও না। ও বেলেঘাটার ফ্ল্যাটে প্রথম দিকের কয়েক দিন দেখেছিল, সৌমাভ একা ঘুমোলে একটা কোলবালিশকে জাপ্টে ধরে ঘুমোয়। যেন সেটাই ওর বউ! তখন শীতকাল বলে গায়ের উপর একটা কম্বল থাকত। কুট্টির শোয়ার ভঙ্গিটা সেই একই রকম। গায়ে সেই একই ভাবে একটা কম্বল চাপা দেওয়া। ও সারা শরীরে কাঁপুনি নিয়ে কুট্টির মাথার কাছে বসে কিছুক্ষণ দম নিল। তার পরে আস্তে আস্তে চুলগুলো ধরে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে খুব আলতো করে ডাকল, ‘‘সকাল হয়েছে, এবার ওঠ সোনাবাবা।’’ নিজের গলার আওয়াজে নিজেই চমকে উঠল! মাতৃত্বের এই চিরকালীন ডাক ওর মধ্যে কোথায় ছিল এতদিন? ওই অবস্থাতেই দুচোখের জল মুছে ঘুমন্ত কুট্টির কপালে একটা চুমু খেয়ে ওর মাথাটা বালিশ থেকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে এলো। ওর দুচোখ ছাপিয়ে তখনও জল নামছে।
উফফ! মামনটা রোজ সকালে জ্বালায়! তার মধ্যে এই ঠান্ডায় লেপ ছেড়ে উঠতে ভাল লাগে? ধুর! কুট্টি ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করতে করতে কোলের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দিল। টের পেল নরম হাতে ওর মাথার চুলগুলো ঘেঁটে মামন আদর করে দিচ্ছে। দুহাত দিয়ে কোমরটা আরও চেপে ধরে রোজকার মতো মুখটা গুঁজে দিল। এত আরামের কোল ছেড়ে, এত আদর করে চুল মালিশ ছেড়ে ওঠা যায়? ধুর। চড়থাপ্পড় মারলে তখন দেখা যাবে। ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে আরাম খেতে খেতে হঠাৎ গালের উপরে যেন একফোটা গরম জল পড়ল! ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল, মামন নয়, ওর মাথাটা অন্য একটা কোলে। পিসি? উঠে বসে তাকিয়েই চমকে উঠল।
কুট্টি বুঝতে পারল, ওর মাথাটা যার কোলে ছিল এতক্ষণ, যে ওর চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে আদর করছিল, সেই মহিলা ওর আর বোনের আসল মা। এই মুহূর্তে বোন বাদ দিলে যার সঙ্গে ওর সরাসরি রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। যাঁর সম্পর্কে কয়েক মাস আগে সবকথাই ওদের জন্মদিনের দিন বাবা, তার পরে পিসি এবং শেষে মামন বলেছে। এঁকে দেখার জন্য, এঁর বুকে মাথা রাখার জন্য একটা পাগলামি সেই সময় থেকে ওর আর বোনের মধ্যে কাজ করেছে পরশু বিকেল অবধি। তার পরে আর মনে হয়নি। ঝড়ের মতো সময় কেটে গেছে। কত ঘটনা! কাল বাবা চলে গেছে চিরকালের মতো। আজ ওদের দুই ভাইবোনের থাকার মধ্যে আছে শুধু মামন আর পিসি। অথচ দু’জনের কারও সঙ্গেই নাকি ওদের রক্তের সম্পর্ক নেই? মনে মনে হেসে ফেলল। রক্তের সম্পর্কের যিনি, তিনি তো ওদের কোলের মধ্যে নিয়েই শোননি কোনওদিন! আর রক্তের সম্পর্ক না থাকা মামনই আজও ওদের বুকের মধ্যে নিয়ে ঘুমোয়। তবে মামন আর পিসি কাল একফাঁকে ওদের মাথায় হাত দিয়ে দিব্যি করিয়ে নিয়েছে, ওনাকে যেন ম্যাডাম বলে ডেকে অপমান না করে। উনিই ওদের মা। ওদের গর্ভধারিনী। তাঁকে সেই সম্মানটা না দিলে ওদের বাবার অপমান তো বটেই পিসি-মামনের গ্রুমিংয়েরও নাকি অপমান। ওরা মেনে নিয়েছে। ও মুখটা একটু অপ্রস্তুত করে বলল, ‘‘সরি, বুঝতে পারিনি। আমি মামন মনে করেছিলাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।’’ বলে ঠোঁটের কোনে মুচকি হেসে গালে এসে পড়া চোখের জলের বিন্দুটা আলতো করে মুখে মেখে নিল।
ওর কোল থেকে কুট্টির ধড়মড় করে উঠে বসা আর মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে থেকে ওই কথাগুলো বলা ঈশিতাকে ফের বোঝাল, বাবার মতোই অভিমানের পাহাড় জমে আছে। একই সঙ্গে খেয়াল করল, ওর মুচকি হাসিটার মধ্যে অবিকল যেন সৌমাভর ছায়া। নিজের অভিমান, কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা সব আড়াল করতে এক সময় সৌমাভও বহু বার, বহু দিন এই ভাবেই মুচকি হেসে অনেক কিছু না বলা কথা বুঝিযে দিত ওকে। ও বুঝেও নিজের মনে জমে থাকা অপরাধবোধের কারণেই কিছু করতে পারেনি সেই সময়। আর একটা জিনিস খেয়াল করল। ওর চোখের জলে উঠে বসে কথাগুলো বলে মুচকি হাসলেও চোখের জলটা মুছে ফেলল না কুট্টি। সেটা নিজের গালে মেখে নিয়েছে, যেন কত ভালবাসার জিনিস! আজ আর ও ১৮ বছর আগের ‘আজ করব, কাল দেখব’-র মতো ভুল করল না। নিজের অপরাধবোধ লোকানোরও চেষ্টা করল না। সোজা হয়ে বসা ছেলের চুলের মুঠি ধরে নিজের কোলে টেনে ওকে আগের মতো শুইয়ে দিয়ে ওর উপরে দুহাত মেলে ওকে জাপটে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘‘আমি তোদের খুব খারাপ আর নোংরা মা। আমি ভাল না, আমি নোংরা। তবু তো তোদের পেটে ধরেছি। বিশ্বাস কর, তখন আমি এত নোংরা ছিলাম না। তোদের বাবা জানত। আমাকে ক্ষমা করতে পারিস না সোনা? মা বলে ডাকতে পারিস না? মা বলে আমার কোলে শুতে পারিস না? আমার কাছে কিছু বলতে পারিস না? আমি খারাপ, তোরা তো নোস। তোদের বাবা, মামন, পিসি তোদের কত যত্ন করে বড় করেছে। তোরা পারবি না আমাকে তোদের কাছে টেনে নিতে? বল না সোনা?’’ ওর আকুল কান্না আর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে ওরই কোলে মুখ গুঁজে থাকা কুট্টির পিঠ।
জয়তীর ঘুম ভেঙে গেছিল। বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে কুট্টির ঘরে ঢুকতে গিয়ে ঈশিতার আকুল কান্না ওর কানে। এল। দরজার বাইরে থেকেই দৃশ্যটা দেখে ওর মনটা কেঁদে উঠল। মেয়েটা কম বয়সের একটা অন্যায়ের মাসুল আজ কতদিন ধরে দিচ্ছে! ও দেখল, কুট্টির সারা শরীরের উপর কম্বল চাপানো থাকলেও পিঠটা উদোম। বরাবরই খালি গায়ে শোয়া অভ্যাস কুট্টির। আজ সেই পিঠ মায়ের চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে ছেলেটার। কুট্টি চুপ করে শুয়ে ওর কোলে, কোনও নড়াচড়া নেই। অনেকক্ষণ কেঁদে হাঁপিয়ে গেল ঈশিতা। ওই অবস্থাতেই ছেলের পিঠের উপরে উপুড় হয়ে নীরবে কেঁদে চলল। জয়তী ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে ঈশিতার চোখের জলে ভেসে যাওয়া মুখটাকে নিজের বুকে টেনে নিল। তার পর একহাত দিয়ে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকা কুট্টির চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে একটাই কথা বলল, ‘‘মনের সব অভিমান, ক্ষোভ, রাগ উগড়ে দে। মন শান্ত হবে। ভিতরে চেপে রাখিস না, শরীর, মন দুইই খারাপ হবে। কেউ নিজের ভুল বুঝে কাছে আসতে চাইলে, তাকে বুকে টেনে নেওয়ার শিক্ষা তোর ভিতরেই আছে। একটু খোঁজ, পেয়ে যাবি।’’ তার পর ঈশিতাকে বলল, ‘‘এ বার ওঠ, ওঘরের বাঁদরিটাকে তোল।’’ বলে ওকে তুলে দিয়ে কুট্টির মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে খাটের উপরে বসল।
ঈশিতা পাশের ঘরে ঢুকে দেখল, মেয়েটা কম্বলের ভিতরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এই মেয়েটা ওর সঙ্গে এক বাড়িতে এক ছাদের নীচে বেশ কয়েক ঘন্টা থাকলেও ও সেদিন এই মেয়েটাকে চিনতেই পারেনি। এমনকি একটা অচেনা বাড়িতে তাকে ঘুমনোর জন্য একটা গোটা ঘর ছেড়ে দিয়েছিল, তবু নিজের কাছে নিয়ে শোয়নি! কাল সৌমাভর কথা যতবার মনে পড়েছে, ততবার নিজের করা প্রতিটা অন্যায়ের জন্য নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা বেড়েছে হুহু করে। আজ সকাল থেকে ছেলেমেয়ের ব্যাপারে প্রতি পদে নিজের মাতৃত্বের অবহেলা, শূন্যতা টের পাচ্ছে। কিন্তু ওর জেদ চেপে গেছে। যে করেই হোক, নিজের শূন্য কোল ভরাতেই হবে। ও জানে, সবটা ভরবে না। ভাগাভাগি হবে সুভদ্রার সঙ্গে। হয়তো জয়তীর সঙ্গেও। তবু তো কিছুটা পাবে। আজকের মতো নিঃস্ব হয়ে থাকতে হবে না।
কুট্টির মতোই মেয়ের ঘরে ঢুকে ওর মাথাটাও নিজের কোলে টেনে একই ভাবে ডেকে মাথাভর্তি ঘন পিঠ ছাপানো চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিতে লাগল। দাদার মতো মুট্টি কিন্তু মাথায় ওর হাত পড়তেই উঠে পড়ল কোল ছেড়ে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তার পর দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল। ঈশিতা বুঝল, ভীষণ দ্বিধায় পড়ে গেছে। ও আর দেরি করল না। কুট্টির মতোই মেয়ের মাথাটাও জোর করে নিজের কোলের উপরে টেনে একই ভাবে কেঁদে ফেলল। মা হয়ে ছেলের মতো মেয়ের কাছেও ক্ষমা চাইতে লাগল আকুল হয়ে। একটু পরে টের পেল, ওর কোলটা ভিজে লাগছে। বুঝল মেয়ে কাঁদছে। এ কান্না অনেক অভিমানের, অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণার, অনেক হারানোর।
নিজের মনের আগলগুলো কাল এবাড়িতে পা রাখার কয়েক ঘণ্টা পরেই একটু একটু করে খুলে ফেলেছিল ঈশিতা। রাতে নিজের মনের অনেক কালি, অনেক যন্ত্রণা কিছুটা হলেও মুছতে পেরেছিল প্রথমে জয়তী আর পরে সুভদ্রার কাছে। তার পর সকালে ছেলেকে বুকে টেনে কেঁদে ও নিজের ভিতরেই অনেকটা হাল্কা বোধ করছিল। ভয় ছিল মেয়েকে নিয়েও। তারও যে স্বভাব বাপের মতোই, সেটা ও শুনেছে। মেয়ের কান্নায় এবারে ভেঙে পড়ল ঈশিতা নামের পুরো খোলসটাই। এই প্রথম সব ছাপিয়ে ওর ভিতরে জেগে উঠল মরে যাওয়া সেই মা, কুট্টি-মুট্টির মা। নতুন আলোর রেখা দেখার মতো করে মেয়েকে জড়িয়ে খাটে গড়িয়ে গেল। তার পরে ওই অবস্থাতেই মেয়েকে বুকের উপর টেনে নিল। তার পর একেবারে ভেউভেউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠে মেয়েকে এমন ভাবে আঁকড়ে ধরল যে, হাত একটু আলগা হলেই যেন মেয়ে কোথাও হারিয়ে যাবে। টের পেল ওর বুক থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করছে না মেয়ে, বরং বুকটা ভিজে যাচ্ছে। মেয়ের চোখের এই জল ওকে যেন কোথাও অনেকটা শান্তি দিল। মেয়েকে বুকের উপরে রেখেই চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল ওকে। একসময় মেয়েকে খাটে ফেলে ওর বুকে মাথা রেখে আদর করতে করতে অস্ফূটে অনেকবার কাঁদল, ক্ষমা চাইল, আবার আদর করল।