যেমন করে চাই তুমি তাই/কামদেব - অধ্যায় ৫০
।।৫০।।
সবাই বসে গেছে খাবার টেবিলে,নাদিয়া বেগমের দেখা নেই। পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে সকলে কি ব্যাপার? অগত্যা গুলনার ডাকতে গেলেন মাকে। নাদিয়া বেগম বই মুখে নিয়ে বসে আছেন। গুলনারকে আসতে দেখে গভীর মনোযোগ দিলেন বইয়ে।
— মা,খাইতে আসো। সবাই বসে আছে।
— তুমি আমারে মা কইবা না।
মুচকি হেসে গুলনার বলেন, ঠিক আছে কমু না,খাইতে আসো।
— আমার ক্ষুধা নাই।
— আমার পরে রাগ করছো?
— ক্যান? তুমি আমার কে,তোমার পরে রাগ করতে যাবো ক্যান? অখন যাও,আমার শরীর ভাল না। আমারে বকাইও না।
গুলনার হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন। মামুন জিজ্ঞেস করলো,কি আইল না?
ড.এহসান বললেন,না আসে থাক। একদিন না খাইলে কিছু হইবো না।
সবাই খেতে শুরু করল।বলদেব এদিক-ওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, আমি একবার চেষ্টা করতে পারি? সবাই অবাক হয়ে দেবের দিকে তাকায়। এখনো ভাল করে আলাপ হলনা বলে কি না চেষ্টা করবে?গুলনার ভাবেন এ কোন বলদের পাল্লায় পড়ল।ড রিয়াজ বললেন, না বাবা তুমি খাও। আমার বেগম ভারী জিদ্দি। একবার জিদ করলে কারো ক্ষমতা নাই তারে বুঝায়।
— আব্বু ওনারে একটা সুযোগ দিয়া দেখেন। সাধ হইছে যখন সেইটা পুরণ হোক।মজা করে বললেন গুলনার।
বলদেব ধীরে ধীরে নাদিয়া বেগমের দরজার কাছে গিয়ে বলে,মা আমি কি ভিতরে আসতে পারি?
নাদিয়া বেগম অবাক হয়ে চোখ তুলে দেখে বলেন,আমারে মা কও কোন সুবাদে? তোমারে কে পাঠাইল ডাক্তার না তার বেটি?
— জ্বি কেউ পাঠায় নাই। আমি নিজেই আসছি। করিম আপনেরে মা কয় সেই সুবাদে আমিও বললাম।
— করিম? সেতো কাজের লোক।
— ধরেন আমিও তাই।
নাদিয়া বেগমের কথা বলতে খারাপ লাগে না বলেন,আসো ভিতরে আসো। কি বলতে আসছো?
— আমি একটু আসতেছি। দেব চলে গেল।
নাদিয়া বেগম অবাক বলে ভিতরে আসতে চায় যেই বলল আসো। তখন বলে একটু আসতেছি। দেব খাবার ঘরে এসে বলল,আপনারা খেয়ে নিন। আমি মার সাথে খাবো।
— আমরা খেয়ে নেবো মানে? ড.রিয়াজ মনে মনে ভাবেন পাগলে কয় কি?
দেব দাঁড়ায় না আবার চলে গেল। এবার সরাসরি নাদিয়া বেগমের ঘরে। দেবকে আড়চোখে দেখে নাদিয়া বেগম বলেন,কি বলতে চাও বলো।
— মা সবাই আপনাকে গোপন করছে,আমি কিছু গোপন করি নাই। যা জানতে চান বলেন অপছন্দ হলেও আমি মিথ্যা কথা বলবো না।
নাদিয়া বেগম সুযোগটা হাতছাড়া করা সমীচীন মনে করেন না। একটু ইতস্তত করেন, জিজ্ঞেস করলেই কি সত্যি কথা বলবে? এমন কৌশলে জিজ্ঞেস করবেন,যাতে পেটের কথা বেরিয়ে আসে।
— বাড়িতে তোমার কে কে আছে?
— মা আমরা বড় গরীব। আমার থাকার মধ্যে ছিল মা। লোকের বাড়ি ঢেকিতে পাড় দিয়ে চাল ঝেড়ে বহু কষ্টে আমারে বড় করছে।
হায় হায় এ তো হাভাতে ঘরের পোলা। কথার কোন রাখঢাক নাই? জিজ্ঞেস করেন, তোমার মা কি বিধবা?
— সধবা হয়েও বলতে পারেন বিধবা। আমার বাপে মায়রে ফেলায়ে চলে গেছে। আমার বয়স তখন নয় কি দশ।
নাদিয়া বেগম অবাক হন,কৌশল না করতেই সব কেমন গড়্গড় করে বলে যাচ্ছে। মনে হয় না মিথ্যে বলছে।
— তুমি কি কাজ করতা?
— জ্বি নির্দিষ্ট কোন কাজ না যখন যেমন পেতাম– ।
— যখন যেমন পাইতাম মানে?
— ঘর ছাওয়া রাস্তার মাটি কাটা বাগান করা ম্যাসেজ করা শেষে ডিএম অফিসে পিয়ন।
নাদিয়া বেগমের চোখ ছানা বড়া। আহা কামের কি ছিরি। বলে কি লোকটা? মণ্টি শ্যাষে একটা পিয়নরে বিয়া করল? তাইলে এত ল্যাখাপড়া পাশ করার কি দরকার ছিল? গলার স্বর বদলে জিজ্ঞেস করেন,কি বললা পিয়ন?
— জ্বি। একজন মেট্রিক পাস ছেলেকে অফিসারের কাজ কেন দেবে?
নাদিয়া বেগম চোখে অন্ধকার দেখেন। এত খবর তার জানা ছিল না। কপাল চাপড়ে বলেন,হায় আল্লা কচি মেয়েটার সব্বোনাশ করাইছো তাতেও তোমার আশ মিটে নাই? নসিবে আর কি কি আছে কে জানে? সেইসব দেখার জন্য আমার বাঁচার ইচ্ছা নাই– ।
— সব্বোনাশ কেন বলছেন মা। এতো নিছক দুর্ঘটনা।
নাদিয়া বেগম স্থির দৃষ্টিতে দেবকে দেখেন। কোন দুর্ঘটনার কথা বলতেছে? তুমি কোন দুর্ঘটনার কথা কও?
— ঐ যে জানোয়ার গুলো যা করেছে। তার জন্য মণ্টির কি দোষ বলেন?
— তুমি সেই সব শুনছো?
— আমি তো হাসপাতালে গেছিলাম ডিএম সাহেবার সঙ্গে। এক জানোয়ার হাসপাতালে এসেছিল তারে ধরেছি। ডিএম সাহেবা সব কটাকে ধরেছেন।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেবকে দেখেন যেন ভুত দেখছেন। সব জানে,জেনে শুনেও বিয়া করছে। নাদিয়া বেগম এর আগে এমন মানুষ দেখেন নাই। দেবের সম্পর্কে কৌতুহল বাড়ে, জিজ্ঞেস করেন,তুমি নাপাক জেনেও তারে বিয়া করছো?
— মা, শরীর নাপাক হয়না ধুইলে ময়লা সাফ হয়ে যায়,নাপাক হয় মন। মন্টির মত মন খুজলে আপনি হাজারটা পাইবেন না।
নাদিয়া বেগম একটু নরম হলেন,তোমার মা নাই কইলা না?
— আম্মুর কাছে আমি সেই স্নেহ পেয়েছি।
— আম্মু আবার কে?
— দারোগাসাহেবের বিবি। আগে ওনার কাছে থাকতাম,আমারে ব্যাটার মত ভালবাসেন। জানেন মা, মন্টি আমারে গ্রাজুয়েট করেছে। অধ্যাপক করতে চায়।
— তোমাদের বিয়ে হয়েছে কবে?
— এই স্কুলে যোগ দেবার আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে।
এতকাল বিয়ে হয়েছে তাকে কেউ বিন্দু বিসর্গ জানায় নি? অভিমানে চোখে পানি এসে যায়। মায়ের মন তবু ধন্দ কাটেনা,অর্থের লোভে বিয়া করে নাই তো?
— আমাদের অবস্থা তুমি জানতা?
— -কি করে জানবো। মন্টি তো কিছু বলে নাই। জানেন মা,আমি পাস করেছি সেইটাও আমারে বলে নাই।
— তোমার রাগ হয় নাই?
— মন্টির উপর আমি রাগ করতে পারি না।
— তুমি খাইছো?
— মা না খাইলে কেমন করে খাবো?
— ওইদিকে দেখো মা খায় নাই আর বাপ বেটির সেই খেয়াল থাকলে তোীর
— না মা অরাও খাইতেছিল না। আমি বললাম আপনারা খাইয়া নেন। আমি মার সঙ্গে খাবো।
ফিক করে হেসে নাদিয়া বেগম বলেন,তুমি একটা ডাকাইত।
— ডাকাইত বললেন কেন মা? কি ডাকাতি করলাম?
— তুমি আমার মাইয়াডারে ডাকাতি করছো। চলো অখন খাইয়া নাও ম্যালা রাইত হইছে। দেখো তো ওদের খাওয়া হইল কি না?
দেব ডাইনিং রুমে এসে দেখল খাওয়া শেষ হলেও সবাই বসে আছে। দেব ঢুকতেই সকলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। বলদেব বলে,আপনাদের হলে টেবিল খালি করলে ভাল হয়। এখন আমরা খেতে বসবো।
দেব ফিরে যেতে মামুন বলেন,অপা তুমি কারে বিয়া করছো?
— এতো দেখি ম্যাজিসিয়ান,ড.রিয়াজ বলেন।
গুলনারও অবাক কম হয়নি। শোবার সময় জিজ্ঞেস করতে হবে কি ভাবে মাকে ম্যানেজ করলেন? একে একে তারা হাত-মুখ ধুয়ে যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ায়। করিম টেবিল পরিস্কার করে। আড়াল থেকে গুলনার দেখেন,দেব আর মা আসতেছে।
ডাইনিং হলে ঢুকে নাদিয়া বেগম বলেন,তুমি বসো বাবা। বেশি রাইত কইরা খাইলে শরীর খারাপ হয়। করিম ডাইনিং টেবিলে একটা প্লেট এনে দিল। বলদেব বলে, একটা প্লেটে দুইজন খাবো? আর একটা প্লেট আনো।
করিম আর একটা প্লেট আনে,বলদেব দুদিকে দুটো প্লেট রাখে।
— কাচাকাছি রাখো,নাইলে দিমু কেমনে? নাদিয়ে বেগম বলেন।
অগত্যা বলদেব প্লেটদুটি সেইভাবে রাখলো। দুজনে খেতে বসলো সামনা সামনি। একজন বাইরের পুরুষ মানুষের সঙ্গে একাকী এর আগে মাকে খেতে দেখেন নি গুলনার। প্লেটে ভাত তুলে দিচ্ছেন মা। দেব মাথা নীচু করে খেতে থাকে। সস্নেহ দৃষ্টিতে দেবের খাওয়া দেখছেন মা।
— তোমারে আর একটু ভাত দেই।
— দিতে পারেন,আমি একটু বেশি খাই।
নাদিয়া বেগম গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, খাও বাবা– যোয়ান বয়স এই সময় তো খাইবা।
গুলনার ঢুকে বলেন,পিয়নটারে অত আস্কারা দিও না।
— তুই এখানে ক্যান আসছস। আড়াল থিকা কথা শুনা বদ অইভ্যাস আমি পছন্দ করিনা।
— আমি পানি নিতে আসছি।
— তুমি কিছু মনে কইরো না বাবা। অর কথা ওইরকম।
— মা আপনি গুরুজন। দেখেন কে কি কইল সেইটা বড় কথা না সেই কথার ভাবটা হল আসল কথা।
— বাবা তোমার উপর আমার খুব ভরসা তুমি মাইটারে দেইখো। নাদিয়া বেগম আন্তরিকতার সঙ্গে বলেন।
— ওনারে কে দেখে তার ঠিক নাই উনি দেখবো আমারে? গুলনার পানিই ভরতে ভরতে বলেন।
— তু এইখান থিকা যাবি? আমাগো কথার মইধ্যে তরে কে ডাকছে কথা কইতে?
গুলনার পানি নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে করিমকে বলেন, আমরা আসি? তুই খাইয়া সব ঠীকঠাক কইরা রাখিস।
— জ্বি আপনে কুনো চিন্তা কইরবেন,আপনে আসেন। করিম বলে।
গুলনার বেগম ঘরে বসে ভাবছেন,এক্টু আগে মজা করে বলেছিল আপনার ব্যক্তিত্ব নাই।যার এত আত্মবিশ্বাস তাকে ব্যক্তিত্বহীন কিভাবে বলা যায়।সবে এক পলক দেখেছে কি দেখেনি মাকে কিভাবে সেই মাকে টেবিলে এনে ছাড়লো।দেবকে যত জানছে তার ধারণাগুলো চুর চুর ভেঙ্গে পড়ছে।