যেমন করে চাই তুমি তাই/কামদেব - অধ্যায় ৬৭
।।৬৭।।
খাওয়া দাওয়ার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছেন গুলনার এহসান। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। দেবের ক্লাস রুটিনের একটা নকল চেয়ে নিয়েছেন। চোখ বুলিয়ে দেখেন আজ চারটে-পয়তাল্লিশে শেষ ক্লাস। পাঁচটার একটু আগে পৌছালে হবে। সকলে বলে দেবের খাওয়ার ব্যাপারে কোন বাছবিচার নেই। কাল রাতে ভাল মতন টের পেয়েছেন গুলনার। পেটে বাচ্চা আছে তাই পেটের উপর চড়েনি কিন্তু পাগলের মত শরীরটাকে নিয়ে কি না করেছে। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও বলা যায় না।অথচ প্রায় তিন বছরের উপর হবে এক ফ্লাটে থেকেছে পাশের ঘরে বিয়ে করা বউ একবার উকি দিয়েও দেখেনি।এক একসময় তারই মনে হতো দেব কেন নিষেধ অমান্য করে তার উপর জোর করছে না।দেব তার কাছে বিস্ময়। নুসরত অফিস থেকে ফিরে কত গল্প করতো দেবকে নিয়ে,গুলনারের মনে হয়েছিল দেব সম্পর্কে নুসরতের একটা দুর্বলতা আছে। পরে তার ভুল ভাঙ্গে। মেয়েটি ভদ্র কি ব্যাপারে বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বাড়ি ছেড়ে চাকরি করতে এসেছিল। এখন কোথায় আছে কে জানে?মাথার উপর পাখা ঘুরছে ক্লান্তিহীন। বাড়িতে এখন মা ছাড়া কেউ নেই। মামুন হাসপাতালে যায় নাই,ট্যাক্সি নিয়ে বন্ধুদের সংগে আড্ডা দিতে গেছে। কাল চলে যাবে ভেবে মনটা খারাপ লাগে। মা খালি ওর জামা কাপড় গুছায়। গুছানোটা অজুহাত,আসলে মামুনের জামা কাপড় ঘাটতে ভাল লাগে। আব্বু চাপা মানুষ বাইরে থেকে তাকে বোঝা যায় না। সবসময় মুখে নির্বিকার ভাব আটা। মামুন একমাত্র বংশধর। তার প্রতি আব্বুর টান থাকা স্বাভাবিক। গুলনার কি চিরকাল বাপের বাড়িতে থেকে যাবেন? এই ব্যাপারে দেবকে দোষ দেওয়া যায়না। গুলনার জানেন ওকে বললেই বলবে সেইটা ঠিক কথা। চলো আমরা অন্য কোথাও যাই। নিরাপত্তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই সব অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। নীচে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল,সম্ভবত মুস্তাক ফিরে এসেছে। কলেজে পুচকে পুচকে মেয়েগুলোর আলোচ্য হয়ে উঠেছে দেব। পছন্দ না হলেও গুলনার বোঝেন কারণটা কি? দেব এমনভাবে কথা বলে কথা বলার স্টাইলটাই হৃদয়কে স্পর্শ করে। বয়স ইত্যাদির ব্যবধান লজ্জা সংকোচের পর্দা খসে যায়। নিজেও বুঝেছেন মর্মে মর্মে। একটা অচেনা অজানা মানুষ তাই সহজে আম্মুর এত কাছের হয়ে যেতে পারল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন সাড়ে তিনটে বাজে। এবার তৈরী হওয়া যাক। বিছানা ঘেষটে নামতে গিয়ে পাছায় জ্বালা অনুভব করেন। উঃ রাক্ষসটা এমন কামড়েছে দাত বসিয়ে দিয়েছে।
সালোয়ার কামিজ পরবেন আজ। চুল আচড়ে পিছনে একটা বাঁধন দিলেন। বেশি সাজগোজ তার পছন্দ না। বার কয়েক পেটের উপর হাত বুলিয়ে আয়নার দিকে দেখলেন। দেবের আম্মু বলছিলেন,পরীর মত দেখতে। অবশ্য তার রুপ নিয়ে দেবের কোন মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সে চেনে কেবল মণ্টিকে। মণ্টির কাছেই তার সব রকমের প্রত্যাশা। মামুন সকাল সকাল আজ বাড়ি ফিরবে বলে গেছে।নার্সিং হোমে গেলেও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।
মায়ের ঘরে উকি দিয়ে দেখলেন,ঘুমোচ্ছে। করিমকে বলল,মাকে বলিস অপা কলেজে গেছে। সিড়ি দিয়ে নেমে দেখলেন,মুস্তাক গাড়ির মধ্যেই বসে আছে। তাকে দেখে দরজা খুলে দিল। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হল না,মিনিট দশেকের মধ্যে নজরে পড়ল সাদা পায়জামা গেরুয়া পাঞ্জাবি কাধে কালো ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগটা গুলনারের দেওয়া দেখে চিনতে পারেন।
— কাধে ব্যাগ কেন?
— অফ পিরিয়ডে সময় কাটেনা তাই বই রাখি।
— বই? কি বই?
— দর্শন না মনস্তত্বেরবই,বেশ ভাল লাগছে জানো। মনস্তাত্বিক জ্ঞান থাকলে কমুনিকেট করতে অনেক সুবিধে হয়।
তারপর হেসে বলে,জানো যারা পথে ঘাটে পকেট মারে চুরি করে তাদেরও বেশ মনস্তাত্বিক জ্ঞান আছে।
— তুমি চুরি করবা নাকি?
— তা বলতে পারো। তবে টাকা পয়সা না– ।
মণ্টি মুখ তুলে তাকায়, দেব নীচু হয়ে বলে,তোমার মন।
— শোনো চুরি করতে করতে লোভ বাড়ে অন্যমনের দিকে যদি হাত বাড়াও– ।
কথা শেষ করতে না দিয়ে দেব বলে,চুরি করে কোথায় রাখবো বলো? তোমার মন আমার হৃদয়জুড়ে আছে আর জায়গা থাকলে তো।
নার্সিং হোমে যখন পৌছালো ভিজিটিং আউয়ারস তখনো শুরু হয়নি। নীচে লোকজন অপেক্ষমান। ভীড়ের মধ্যে নুসরতকে দেখে অবাক হয় গুলনার। ও এখানে কেন? কেউ কি আছেন এখানে? তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে নুসরত,মণ্টিদি কেমন আছো?
বলদেব অন্য একজনকে দেখে মনে করার চেষ্টা করে ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছে, চেনা চেনা মনে হচ্ছে। মনে পড়ে যায় জয়নাল দারোগা, যিনি সুপারিশ করে তাকে পাঠিয়েছিলেন।
— স্যর আপনি এখানে?
জয়নাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। বলদেব বলে,আমি বলদেব। চিনতে পারছেন না?
জয়নাল ভুত দেখার মত চমকে উঠে বলেন,হ্যা হ্যা কেমন আছো? কি করো?
— আমি একটা কলেজে পড়াই।
জয়নাল মনে মনে ভাবেন তার ভুল হচ্ছে নাতো? আমতা আমতা করে বলেন, আপনাকে দারোগাবাড়িতে রিজানুর সাহেবের বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম?
— হ্যা,আমি এখন এখানে থাকি।
— আট-ন বছর আগের কথা। অনেক বদলে গেছে। আপনি অধ্যাপনা করেন?
— জ্বি। বিবাহ করেছি। আগের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।
— মইদুল খবর দিল ভাবীজান এখানে ভর্তি হয়েছেন।রিজানুরের খবর জানতাম না।
এমন সময় নুসরত এল গুলনারকে নিয়ে,আব্বু মণ্টি-দি ড.রিয়াজের মেয়ে। আমার বন্ধুর মত। একসময় আমরা একসঙ্গে থাকতাম।
গুলনার এবং জয়নাল দারোগা আলাপ করে। দেবের পুরানো অনেক কথা বলেন জয়নাল। ইতিমধ্যে সময় হয়ে গেল,একে একে সবাই উপরে উঠতে লাগল। মুমুতাজ সায়েদও এসে পড়েছে। একেবারে শেষে দেব আর নুসরত উপরে উঠল।
নুসরত জিজ্ঞেস করে,দেব তুমি কেমন আছো? বেশ দেখতে লাগছে তোমাকে।
— প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই আপনি দিয়ে দিলেন। আমার বলার কিছু থাকলো না।
নুসরত হেসে বলে,তোমার সঙ্গে স্যরের দেখা হয়? উনি এখন ঢাকায় আছেন।
বলদেব এক মুহুর্ত ভেবে বলে,উদ্দেশ্য না থাকলে দেখা হয়না তা বলবো না কিন্তু কদাচিৎ। যেমন আজ তোমার স্যরি আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া বা আপনার বাবার দেখা হওয়া। আমার জীবনে আপনার বাবার গুরুত্বপুর্ণ একটা ভুমিকা আমি অস্বীকার করতে পারিনা।
জয়নাল দারোগা অত্যাচারী মারকুট্টে বলে শুনে এসেছে। আজ দেবের কাছে বাবার অন্য এক পরিচয় জেনে নিজেকে লজ্জিত বোধ করে নুসরত।
— তুমি এখন অধ্যাপক আমাকে ‘তুমি’ বলতে পারো।
— ধন্যবাদ। অবস্থান মানুষের সম্পর্ককে এভাবে বদলে দেয়।
— একটা কথা তুমি হয়তো জানো না,ম্যাডাম তোমাকে ভালবাসতেন।
— দেখ নুসরত আমার ইচ্ছে করছে কোথাও বসে তোমার সঙ্গে অনেক্ষন কথা বলি। কিন্তু– কিন্তু– ।
— চলো না ওদিকটায় লোকজন কম।
দুজনে নার্সিংহোমের শেষ প্রান্তে স্বল্প পরিসর একটা জায়গায় এসে বসলো। বলদেব শুরু করে, তুমি ভালবাসার কথা তুললে। এই শব্দটা নিয়ে আমার বেশ ধন্দ্ব আছে। প্রেম ভালবাসা অতি পবিত্র এবং চিরস্থায়ী একটা সম্পর্ক এরকম আমরা মনে করি। কিন্তু বাস্তবিকই কি তাই?
— তাই নয় বলছো?
— আমি কিছুই বলতে চাই না,আমি জানতে চাই। ধরো একটি মেয়ে একটি ছেলের প্রেমে পড়ল। তার মনে হল ছেলেটিকে ছাড়া বাঁচবে না। বাড়ির লোকজন তাকে বোঝালো,ছেলেটির আর্থিক অবস্থা শিক্ষা উপার্জন তেমন ভাল নয়। বিকল্প হিসেবে অন্য একটি ছেলেকে উপস্থিত করলো যার শিক্ষা আর্থিক অবস্থা আগের ছেলেটির তুলনায় অনেকগুণ উন্নত। মেয়েটির মনে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হল বিরুপতা সে দ্বিতীয় ছেলেটিকে ভালবেসে ফেলল। প্রেমের স্থায়ীত্ব সম্পর্কে এর পর আস্থা রাখা যায় কি?
— দেব তুমি খুব নির্মম। হেসে বলে নুসরত জাহান।
— আবার ভুল করছো,কেউ নৃশংস ঘটনা ঘটালো আর যে সেই ঘটনার বিবরণ দিল তাকে বলবো নির্মমতা? মেয়েটি ছেলেটিকে প্রত্যাখ্যান করলো তার দোষ নেই একে বলে ভাবের ঘোরে চুরি করা। এবার আসি জেনিফার ম্যাডামের কথায়। আগের কথা জানিনা কিন্তু যখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয় তাতে আমার মনে হয়েছে,উনি যে কারণেই হোক পুরুষ বিদ্বেষী। তুমি দেখোনি পুরুষ আসামীদের কি প্রচণ্ড অত্যাচার করতেন। জুতো পায়ে পুরুষাঙ্গ পিষ্ঠ করে আমোদ পেতেন। উনি ছিলেন ডোমিনেটিং টাইপ যার ফলে কখনো ক্ষিপ্ত হয়ে আত্ম নিগ্রহও করতেন। এসবের পিছনে কারণ হতাশার জ্বালা।
নুসরতের চোখে মুগ্ধতা।কত জটিল বিষয় কত সহজ করে বলে যাচ্ছে দেব।নিজের মত জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয় কেবল বিষয়টাকে ছবির মত উপস্থিত করা।এবার তোমার বিবেচনা।
গুলনারের খেয়াল হয় দেবকে দেখছেন না,কোথায় গেল? রহিমা বেগমের ঘর থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখেন।একটু অন্যমনস্ক হয়েছো কি উধাও।স্থির হয়ে এক জায়গায় থাকতে পারেনা।